আয়নিত জীবন
রেল লাইনের পাশটি ঘেঁষে একটা দেয়াল আমাদের। সেখানে রাত কি দিন, প্রায়ই আমি গিযে থাকি। সেদিন বিকাল কি দুপুর ঠিক খেযাল করিনি। জনা পাঁচ কি ছয়জনায় বসে ছিল সেখানে। এক কোনায় বসে আরেক কোনায় বসে থাকা রসিকতায় ব্যস্ত ধ্রুব দাদার গোঁফগুলোও দেখতে পাচ্ছিলাম।
আমার যা কপাল, বসলাম একটা মেয়ের পাশেই, বুঝতে পারছিলাম ঠিক কোন মেয়েটা, কিন্তু কথা বলা হয় নাই। সেদিনও আমি খুব একটা কারো দিকে না তাকিয়ে সামনের রেল লাইন বা আশে পাশের দৃশ্য দেখছিলাম। খানিক বাদে মেয়েটা একটু আমার দিকে ঘেঁষে বসার জন্য নড়ে উঠলে আমিও ডান দিকে সরে গেলাম। যাতে ও ওর দরকারি জাযগা নিতে পারে। মেয়েটা আমার দিকে পা দিয়ে ওর বাম পাশের ছেলেটার কোলে মাথা দিয়ে আধশোয়া অবস্থানে চলে গেলো।
ওর এই ফন্দি আমি বুঝতে না পারার কারণে ওর স্যান্ডেল পরা পা দুটো আমার জামায় আর আমিও ভাবলেশহীন ভাবে সেখানেই, এক চুলও নড়লাম না।
আমার মনে হয় পা দুটো টান টান না করার আগ পর্যন্ত ওর আরামটা ক্লিয়ার হচ্ছিলো না বলেই কিছু সময় পরে সে আমার পায়ের ওপর দিয়ে ওর পা দুটো সোজা চালিয়ে দিলো।
আমি কিছুই মনে করলাম না। আরেকটু পর সে ইশারায় আমাকে বললো, আমি চাইলে ওর গায়ে হেলান দিয়েও বসতে পারি।
আমি বরাবরের মত বুভুক্ষ হওয়ায় কোন সময় নষ্ট না করে বাম দিকে ঝুঁকে গিয়ে ওর নিতম্বে একটু হেলাম দিলাম, কি আছে জীবনে। কিন্তু ঠিক যুতসই না হবার কারণে আমি অন্য দিকে ফিরে দেযালের ওপর পা উঠিয়ে দিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালপালার দেখছিলাম। তখনই সবকিছু বদলে যেতে শুরু করলো। মেয়েটা রানাকে ছেড়ে আমার ঘাড়ে ওর থুতনিটা ছোঁয়ালো। আমি বুঝতে পারছিলাম, দেয়ালের দুই পাশে পা ঝুলিযে দিয়েছে ও ততক্ষণে। আমি আপত্তি না করে ওকে সম্মতিসূচক শারীরিক ইঙ্গিত দিচ্ছিলাম ওর প্রতিটি আহ্বানে।
যখন আমরা শব্দ চালাচালি শুরু করলাম তখন আমিও দেয়ালের দুই পাশে পা ঝুলিয়েছি, বলা যেতে পারে মটর সাইকেল পজিশনে তখন আমরা।
ও পেছন থেকে দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িযে ধরে রেখেছে আর ঠিক আমার কানের কাছে ঠোঁটদুটো। আমি জিগ্যেস করলাম, তোমার নাম কি। ও মৃদু হেসে উত্তর দিলো, চমকা। আমি বললাম, আমি জানতাম তুমি ওয়ানডারফুল।
২
মোট তিনটে রুম আমাদের নতুন বাসায়। একটা লিভিং রুমও আছে, তাও আবার আলাদা টযলেট সহ। তো বোঝাই যাচ্ছে বেশ বড় বাসা। আমরা তিন রুমে তিনজন থাকি আর লিভিং রুমের দিনের আলোয় শুই, বসি, চিল করি। হাউস ওয়ারমিং পার্টি দেবার জন্য আমি তখনও প্রস্তুত হয়ে উঠিনি, কিন্তু আমার রুমমেট এবং বিশেষ করে বন্ধুরা একটা হাউস পার্টির জন্য মরেই যাচ্ছে। আচ্ছা ঠিক আছে, হোক পার্টি।
একদা পাশের শহরে একটা হাউস পার্টির নিমন্ত্রণে গিযেছিলাম। আয়োজক লেনিন আমার বন্ধুর বন্ধু হবার সুবাদে ওদের বাসাতেই রাত এবং পরের সকালটি কাটিয়ে দেই।
ফলে এরকম একটা পার্টির ফলাফলে কি দাঁড়ায় সেটি আমি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছি। তবু ঠিক আছে- হোক পার্টি। এই কথা বলে যেই না গেছি বাথরুমে চান করতে, সেই এক দুই জন করে অতিথিবৃন্দ হাজির হতে শুরু করলো।
আমি স্নান সেরে এসে দেখি লিভিং রুমে কয়েক বাক্স বিয়ার আর বাসা উপচে পড়ছে অতিথিব্রিন্দের সমাগমে। আমি ঝুঁকে পড়ে বিয়ারের বাক্সগুলো সরাচ্ছি, এমন সময় টের পেলাম কেউ একজন আমার পিঠের ওপর একটা
সবুজ রঙের বিয়ারের বোতল ভাঙল। ঘুরে দেখি আরিফ। আমি আর কুডি না কে যেন, ওকে জিগ্যেস করলাম, তুই এই বোতল কেন আমার শিরদাঁড়ার ওপর ভাঙলি? তো আরিফ বললো, পাশের রুমে একটা ছেলের
সাথে ওর ক্যাচাল হবার কারণে ও এই রুমে এসে এই কাজটি করেছে।
আমি আমার দুই রুমমেটের সাথে একটু কথা বলে বুঝতে পারলাম, ওরা কোনো যাচাই বাছাই ছাড়াই ঢালাও ভাবে গোটা শহরকে নেমন্তন্ন করেছে। ভাবলাম, বাহ, দুই রুমমেট আমার ব্যাপক উদার মানসিকতার অধিকারী।
৩
আমি আসলে নিজের জন্য ছাড়া অন্য কারুর জন্য কিছু করি না। আমি আলসে সেই কারণেই হবে। কিন্তু রণন আর রূপান্তরের সাথে ওঠা বসার শুরু থেকেই বিষয়টা একটু অন্যরকম হতে শুরু করে। আমি ওদেরকে কোথায় পাই বা কিভাবে পাই ঠিক মনে পড়ে না। শুধু কোন এক আবছা অন্ধকার এলাকার কথা মনে পড়ে। আমরা অনেকটা সাবলীল ভাবে অপারেশন চালিয়ে যেতে থাকি। রণন ঠিক কিভাবে যেন নিত্য নতুন ফন্দি ফিকির আবিষ্কার করে চমকে দ্যায়। রূপান্তর নকশা আঁকে। আর আমি বাস্তবায়নের নানান ঝক্কি ঝামেলা পোহাই।
সেদিন ওরা যখন একটা নতুন ফন্দি আঁকছিল তখন আমি মাত্র এসে পৌঁছেছি। ডেরায় ঢুকেই দেখি বিরাট ব্যাপার স্যাপার। বসে পড়ে শুনতে লাগলাম। কিন্তু অর্ধেক শুনে কিছুই ধরতে পারলাম না। ওরা আমাকে বলল, তুমি মনপাড়া থেকে ঘুরে এসো। আসার সময় দুটো ব্যারেল নিয়ে আসবে আর একটু দেখে আসবে ওদিকের মানুষদের ভিতর কোন উত্তেজনা কাজ করছে কি না।
আমি মনপাড়ায় গিয়ে ত্যামন কিছু দেখতে পেলাম না। মানুষেরা সৈকতের বালিতে পড়ে আছে। বাচ্চাকাচ্চারা গায়ে কাদা মাখছে আর মেয়েরা বসে ধানাই পানাই কিছু একটা নিয়ে আলাপ করছে। আসন্ন সংকট নিয়ে কেউ উত্তেজিত বলে মনে হল না।
আমি দুটো মাছের ব্যারেল ম্যানেজ করে নিয়ে ফিরে এলাম।
মাছ ধরা বা রান্না করার মত কাজ গুলোতে আমার খুব অনিচ্ছা থাকলেও এসব কাজে আমার তেমন অসুবিধা হয় না। তবু কেন আমি এসব করি ঠিক বুঝি না। এতদিন সব কিছু ঠিক ছিল কিন্তু এখন শ্বেতগ্রাসের কবলে পড়ে নানান নতুন প্রশ্ন আমাকে আক্রান্ত করে। আসলে জীবন সম্পর্কে কোন অর্থবহ ভাবনায় আমি কোনোদিন নিজেকে জড়াতে পারিনি। খাওয়া দাওয়া, আমোদ আহ্লাদ আর বিকেল বেলার শকুন্তলার দেয়ালটাই আমার দিনগুলোকে বেশ সন্তুষ্টি দিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু মহাবিশ্বে কেন এই ভীষণ অদরকারী ঘটনাটা ঘটতে শুরু করলো এরই মাঝে? আমি আর কদিনই বা বাঁচতাম। যদিও পুরো সোলার সিস্টেম একটা বরফের দলায় পরিণত হতে এখনও বহু বছর, তবুও, জীবনের ছন্দ পতন হতে এটুকু জানাই যথেষ্ট। এখনও সব ঠিক আছে, শুধু মাঝে মাঝে সব কিছু একটু বদলে যায়, গাছের পাতা গুলো ক্যামন শক্ত একটা বস্তুতে পরিণত হয়, রাস্তার ধুলো বালির কণারা বেশ ভারি এক একটা মারবেলের মত হয়ে ওঠে আর সব কিছু দেখতে শাদা পাথরের মত মনে হয়।
মনে আছে, প্রথম বার যখন এই ঘটনা আমরা দেখতে পাই, তখনও আমি ঠাকুরমার সাথে মনপাড়ার একটা বাসায় থাকি আর মাছ ধরার নৌকা নিয়ে বেরোই। শকুন্তলার দেয়ালে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বসে গোপাল বিড়ি খাই আর খেঁক খেঁক করে হাসি।
আমার জামার বোতামগুলোও আমার মত বিকেল কাটাতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে ততদিনে। একদিন কৃষ্ণচূড়ার একটা ডাল চড়াৎ করে ভেঙ্গে পড়ে আর আশে পাশের বাচ্চা গুলো কিছু ফুল ছিঁড়ে সেগুলো নিয়ে খেলতে থাকে। আমি দেখতে পাই সেগুলো ক্যামন সাদাটে হয়ে গ্যাছে, ঠিক লাল নেই। আমরা বেশ একটু অবাক হয়ে দেখি যে পাতা আর ফুলগুলো একটু স্বাভাবিকের চাইতে একটু ভারী।
আমরা এদিকটায় একটু গা ছেড়ে দিয়ে দিন কাটাই বলে আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু ততদিনে আরও কিছু জায়গায় এই ঘটনা ঘটেছে এবং আরও কিছুদিন পর গোটা গ্রহবাসী বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। আমাদের এদিকটায় সাময়িক উত্তেজনা কাটিয়ে উঠে আমরা ব্যাপারটা একরকম ইগ্নোর করেই দিন কাটানো শুরু করি। ঠাকুরমা অবশ্য তার ত্রিভুবনের পিতা ঈশ্বরের কাছে দৈনিক কান্নাকাটির আসরে আরও ঘণ্টা খানেক যোগ করে এবং আমার ধারণা বেচারি এই এক্সট্রা প্রার্থনার ধকল সামলাতে না পেরেই কয়েক মাসের মাথায় মারা যায়। সৈকতের একটা নির্জন দিকে একটা গর্ত খুঁড়ে একত্রিশ বছরের চামড়া ঘোচকানো থুরথুরে দেহটাকে কোন রকমে পুতে রেখে এসে একটু বিরক্তই লাগতে শুরু করে আমার। শুরুর দিকে ব্যাপারটা একটু ফানিই ছিল। আমি বলতাম, বাইবেল বিশ্বাস করো নাই তোমরা, এইবার বোঝো অ্যাপোক্যালিপ্স কি জিনিস। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু বুড়িটার কেন কান্না কাটি করে মরতে হল। এখন কে আমাকে রান্না করে খাওয়াবে! জীবনটা তামা তামা।
মন্তব্য করুন