বিবিধ স্মৃতি বহন করে দু'বছর পরই ৫০ হবো, সেঞ্চুরির স্বপ্নও দেখি! (পর্ব-২)
৭. ভুট্টো সরকার সেখানে অবস্থানরত বাঙালিদের জন্য পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিতে অপশানের সুযোগ দিল। বাবা তাঁর ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে (সম্ভবত, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার কারণে বৈষম্যের শিকার হতে পারে- এমন আশঙ্কা করে) পাকিস্তানে থাকার অপশান দিলেন। শুনে মায়ের দিন-রাত কান্নাকাটি চলতে থাকলো। দেশের আপনজন ছাড়া ভিনদেশে থেকে যাওয়া তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। বাবাও দ্বিধায় পড়লেন। অফিসের বসরা তাঁকে স্নেহ করতেন। তাঁদের তালে পড়ে অপশান দিয়েছিলেন। মায়ের কান্নাকাটিতে আবার অপশানের ফরম পূরণ করে বাসায় এসে ঘোষণা দিলেন অপশান দুটোই দেওয়া থাকলো, ভাগ্যে যেটা হবে তা-ই মেনে নেব।
৮. বাবা মূল চাকরির খোঁজ না রেখে পার্টটাইমে রেডিওর চাকরিতে ব্যস্ত থাকলেন। বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে খোঁজ রাখছিলেন না। মা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে চলেছেন, দেশে যেন ফিরতে পারেন। খবর পাচ্ছিলেন অনেক বাঙালি পরিবার জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে দেশে ফিরছেন। '৭২ ছাড়িয়ে '৭৩ চলছে আমাদের জন্য খবর নেই। দ্বিধাগ্রস্ত বাবার উৎসাহও নেই, অনীহাও নেই। বছরের শেষ দিকে, কয়েকজন বাঙালির একটি দল অনেক খুঁজে বাসায় হাজির হয়ে জানতে চাইলেন, আমরা দেশে ফিরতে চাই কি-না? বাবা বাসায় ছিলেন না, আমি তাঁদের কথা মাকে বলতেই তিনি দৌঁড়ে দরজায় এসে বললেন, 'হ্যা, হ্যা, আমরা দেশে ফিরতে চাই। আমাদের জন্য ব্যবস্থা করুন।' তাঁরা আন্তরিকতার পাশাপাশি ক্ষোভ দেখালেন, "দেশে যেতে চান- অথচ জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট অফিসে কোনো খোঁজ রাখেননি। বেশীর ভাগ মানুষ চলে গেছে, এখন শেষ বারের মত আমরা খুঁজতে নেমেছি কাগজ ধরে ধরে। কালকেই আপনার হাজব্যান্ডকে পাঠাবেন, না হলে পাকিস্তানি হয়েই থাকতে হবে।"
৯. তল্পিতল্পা গুছিয়ে আমরা জাতিসংঘের ক্যাম্পে গিয়ে উঠলাম। সেখানকার গণরান্না খেয়ে ফ্লাইটের অপেক্ষা। একটা হাড়ি নিয়ে কিশোর আমি খাবার আনতে যেতাম (দেশে বন্যা হলে আশ্রয় শিবিরে যে রকম হয়ে থাকে)। আমাদের পরিবার কয়েকবার প্লেনে ওঠার জন্য গিয়েও ফিরে এসেছি। একেবারে শেষ পর্যায়ে সুযোগ হলো, দেশে ফিরলাম। তেজগাঁও বিমানবন্দরে নেমে আবার ক্যাম্পে ওঠার পালা। সাবধানী বাবা ক্যাম্পে ওঠা নিরাপদ মনে করলেন না। ক্যাম্প অফিস থেকে সামান্য যে হাত খরচ দেওয়া হলো তা নিয়ে সরাসরি বাড়ীতে যাওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু, অফিসিয়াল কিছু কাজ না সারলে চাকরির অসুবিধা হবে। তাই কয়েকটা দিন ঢাকায় থাকা দরকার।
১০. রেফারেন্সের মাধ্যমে আমরা আশ্রয় নিলাম ধানমণ্ডির এক বাড়ির বারান্দায়। সেই পরিবারটি আমাদেরকে উটকো ঝামেলা মনে করে বিরক্ত হচ্ছিলেন। ছোট ভাইবোনদের নোংরা কাপড়-চোপড় পরিস্কার করা নিয়ে মায়ের খুব কষ্ট হচ্ছিল। মা স্বচ্ছল পরিবারের আদরের দুলালি ছিলেন। অথচ, ধানমণ্ডির এই পরিবারটির অপমানজনক আচরণে কষ্ট পাচ্ছিলেন। তবে দেশে ফেরার সুখে আচ্ছন্নও ছিলেন, আর অপেক্ষায় ছিলেন কবে বাড়ি যাবেন। আমরা ছোট ভাইবোনরা বারান্দায় ঘুর ঘুর করি, জানালা দিয়ে উকি দিয়ে বড়লোক পরিবার চলাফেরা দেখা চেষ্টা করি। মা ধমকে উঠেন, যদি তাঁরা অপমান করেন!
১১. বাবা সারাদিন অফিস থেকে অফিসে ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার পর কিছু খাবার টাবার নিয়ে আসেন। আমরা বারান্দাতেই কম্বলে ঢেকে রাত পার করি। তাঁরা বোধ হয় প্রথম দিকে দু-এক বেলা খাবার দিয়েছিলেন, তাঁদের মনোভাব দেখে মা বললেন, আমাদের খাবার দিতে হবে না, থাকতে দিচ্ছেন এই যথেষ্ট। তারা বললেন, যত তাড়াতাড়ি পারেন চলে যান। পরের দিকে অপমানজনক আচরণ বেড়ে গেলে বাবা বললেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ অথচ পরস্পরকে এটুকু সহযোগিতা করতে চান না! ঠিক আছে, আমরা কালই চলে যাচ্ছি। অফিসের কাজ ঠিকঠাক না করেই পর দিন আমরা গ্রামের বাড়ীর উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। তবে পরবর্তীতে বাবার চাকরিতে ঝামেলা হয়েছিল।
১২. করাচি থেকে সেই পলায়নের পর গ্রামের বাড়ীতে বাবা কোনো যোগাযোগ রাখতে পারেননি। দাদুর কান্নাকাটিতে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বাড়ীর মসজিদে পড়ে থাকেন। আল্লাহর কাছ বলতে থাকেন, আমার ছেলে বেঁচে আছে কি-না, অন্তত এইটুকু খবর এনে দাও। আয়না পড়া, দোয়া তদবির কিছু বাকি রাখেন না। অবশেষে একদিন তাঁর ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল, এশার নামাজ শেষে মোনাজাতে বলতে থাকেন, আল্লাহ তোমাকে এত ডাকি, অথচ আমার ছেলের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ঠিক আছে, আর তোমার কাছে প্রার্থনা করবো না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি মসজিদ থেকে বের হতে এক পা বাইরে রাখতেই, তাঁর ভাতিজার চিৎকার শুনলেন, বড় ভাই এসেছে। দাদু তাড়াতাড়ি মসজিদের ভিতরে ফেরত গিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইলেন, শুকরিয়া জানালেন।
১৩. পুরো ইউনিয়নে প্রথম মেট্রিক পাশ এবং খুব মিশুক হিসেবে বাবা ছিলেন পুরো গ্রামের প্রিয় মুখ। সেই রাতে সবাই ছুটে এল তাঁকে দেখতে। আমরা ভাইবোনরা হতবাক এত সমাদরে। অথচ একদিন আগেও ধানমণ্ডির সেই বারান্দায় আমরা বস্তির জীবন-যাপন করছিলাম। পাশের গ্রামেই নানা বাড়ি। সেখান থেকে তাঁরাও ছুটে এলেন। পরদিন প্রিয় নানা বাড়িতে গেলাম। সব ছারখার হয়ে আছে। আমার নানা, খুব সখ করে কয়েক বছর সময় নিয়ে বিশাল তিন তলা কাঠের ঘর নির্মাণ করেছিলেন।
১৪. নানাবাড়ির ঐ প্রধান ঘরটি ছিল এলাকার মধ্যে সবচেয়ে দর্শনীয়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের আশ্রিত এক লোক ও তার ছেলে রাজাকার দলে যোগ দিয়ে পুরো সম্পত্তি দখলের পায়তার করল। এরই প্রথম পর্যায় হিসেবে একদিন দুপুরে সেই রাজাকারের সশস্র দল বাড়ীতে লুটপাট করলো। এরপর নানাকে অস্ত্রের মুখে রেখে ঘরটিতে আগুন লাগানো হল। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকলো। নানা বলতে থাকলেন, "আমার ঘরটি না পুড়ে তোমরা দখল করে নাও। না হয়, আমাকে মেরে ফেল"। সেই রাজাকার বলল, "মারার কথা বলতে হবে না, সবই সময় মতো হবে"। উঠতি বয়সের মামারা যে যেভাবে পারে বাঁচার চেষ্টা করলো। মুক্তিযুদ্ধের পর দেখা গেল, নানাবাড়িতে জানে কেউ মারা না গেলেও মানসিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত। মামাদের লেখাপড়া হলো না। আমার নানা সারাদিন ঝিমাতেন। কথা বলতেন খুব কম। সারাদিনে একবার খেতেন। অর্থাৎ বিষণ্ণতায় তাঁরা শেষ। স্বাধীনতা যুদ্ধে এভাবে যে কত পরিবারের সম্ভাবনময় মানুষগুলো নিঃশেষ হয়েছে তা চিরকাল হিসেবের বাইরে থাকবে। মামাদের বেশীরভাগই এখন দরিদ্রের কাতারে চলে গেছে।
১৫. গ্রামে কয়েকদিন থেকে বাবা সরকারি চাকরি ফিরে পেতে ঢাকায় এলেন। চাকরিতে সেট হতে সমস্যা হচ্ছিল, কিন্তু তিনি আমাদের খুলে বলতেন না। এখন বুঝি, তিনি এসব আশঙ্কার কারণেই পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার অপশান দিয়েছিলেন। যেহেতু, তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি, তাই বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন। বাস্তবেও তাই হলো। অথচ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বাবা বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই কাজ করেছেন। আইউব খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। এখন ধারণা করি, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে অনেকের মতো যুদ্ধে অংশ না নেওয়ায় বাবাকে খোটা শুনতে হয়েছে। আমাদের ফেলে রেখে এসে যুদ্ধে অংশ নিলে খুব গর্বের হতো, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা ওখানে পঁচে মরতাম। আমাদের বাঁচানোকে প্রধান্য দিয়ে বাবা অন্যায় করেননি। বাবাকে ধন্যবাদ।
১৬. চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে আমরা খুব ভুগেছি। বাবার চাকরি তখনও ঝামেলামুক্তি হয়নি। অফিসে যান, কিন্তু বেতন ঠিক মত পান না। থাকতাম মগবাজারের নয়াটোলায়। আমি বড় ছেলে। দোকান থেকে সওদা আনা আমার দায়িত্ব। বাকিতে সওদা আনতে কি খারাপ লাগতো! অনেক ধরণা দেয়ার পর দোকানদার হয়ত দিত। অনেক সময় খালি হাতেই ফিরতাম। তখন সীমিত আয়ের মানুষের জন্য রেশন কার্ড ছিল চাকরি পাওয়ার চেয়েও কঠিন। বাবার শুভাকাঙ্খী বন্ধু, আমাদের খুবই প্রিয় এক কাকা ছিলেন, বাবাকে না জানিয়ে আমাদের জন্য রেশন কার্ড সংগ্রহের চেষ্টা করলেন। আমাকে নিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট অফিসে গেলেন। অনেক ভিড়। আমার হাতে কাগজ-পত্র ধরিয়ে শিখিয়ে দিলেন। কর্মকর্তার কাছে অনুনয় বিনয় করতে হবে, স্যার আমরা খুব কষ্টে আছি, ভাই-বোন না খেয়ে থাকি, আমাদের রেশন কার্ড দিন। আমি তাঁর শেখানো মতো বলতে পারিনি, সংকোচে গলা আটকে আসছিল। কর্মকর্তা ফিরিয়ে দিলেন। সেই কাকা খুব বকলেন। যাও এবার বাসায় গিয়ে সবাই মিলে না খেয়ে থাকো। সেই কাকা কোথায় আছেন জানি না। তাঁর আন্তরিক চেষ্টা আর সহযোগিতার কথা আমৃত্যু মনে থাকবে। ভালো থাকুন, কাকা।
ভালো লাগছে, আমার জন্ম স্বাধীনতার অনেক পরে হলেও সে সময়ের অনেক কিছুই বাবা মার কাছে শুনেছি। বিশেষ করে ৭৪ এর দূর্ভীক্ষের কথা। ভয়াবহ সময় ছিলো সেটা।
ভালো লেগেছে
মাহমুদ
কস্ট করে নাম টাইপ করার দর্কার নাই ভাই, আপনের নাম আপনার কমেন্টের উপ্রেই আছে।
সাথে আছি
পড়ছি।
শুভকামনা -
চলুক...
পড়ছি। ভালো লাগছে। লিখে যান। আপনার ছেলেদের অবশ্যই পড়াবেন, শোনাবেন।
- সজীব
মন্তব্য করুন