বিবিধ স্মৃতি : আড়তদারি ব্যবসায়ের অভিজ্ঞতা
আগের দুই পর্বে একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতি অনেকের একঘেয়েমি লাগতে পারে। তাই বিষয়ভিত্তিক স্মৃতি লেখার কথা ভাবছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, আড়তদারি ব্যবসায়ের অভিজ্ঞতা, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে, পার্বত্য চট্টগ্রামে রাবার বাগান গড়ার চেষ্টা, গার্মেন্টস শিল্পে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর এক্সপেরিমেন্ট, বাংলাদেশে ইন্টারনেটের সূচনা, প্রথম আলোতে ১১ বছর, ইত্যাদি।
১. ৮৬ সালের কথা। ব্যবসায়ী হওয়ার প্রবল বাসনা দিনে দিনে প্রবলতর হলো। এর আগে টুকিটাকি ব্যবসায়ে যে শিক্ষা হয়েছে, তা থেকে সিদ্ধান্তে এলাম আবশ্যিক পণ্যের ব্যবসা করাটাই নিরাপদ। বাবা এতদিনে কর্মস্থলে স্থিতিশীল হয়েছেন। তাঁর কাজের দক্ষতাকে বসরা মূল্যায়ন করছিলেন। একপর্যায়ে সচিবালয়ের সরকারি বাসস্থান পরিদপ্তরের চাকরি থেকে জটিল সব প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে বদলি হলেন। সব মিলিয়ে আমরা মোটামুটি সুস্থির জীবনযাপন করছিলাম। বাবা ভবিষ্যতে দূতাবাসে পোস্টিং পেলে আমারও বিদেশে গিয়ে কিছু একটা করার ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকলেও খুব আশাবাদী বা উৎসাহী ছিলাম না। শৈশবের করাচির অভিজ্ঞতাতেই বিদেশের যাওয়া মোহ কেটে গেছে।
২. '৮৭ সাল নাগাদ বাবাকে অনেক বুঝিয়ে তাঁর এক ব্যাংকার বন্ধুর মাধ্যমে ১০ লাখ টাকার লোনের ব্যবস্থা হলো। তখন মোহাম্মদপুরে কৃষিমার্কেট নির্মাণ শেষ হয়েছে মাত্র। এখানে চাউলের আড়ত চালু করা হবে। মহা উৎসাহে একটা আড়তের বরাদ্দ পেতে ঢাকা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে (পরবর্তীতে সিটি কর্পো.) আনাগোনা করতে লাগলাম। টেন্ডারে অংশ নিলাম, সফল হলাম না। পরে বেশী দামে আরেক জনের বরাদ্দ কিনলাম। ভালো লোকেশান দেখে আরো একটি আড়ত ভাড়াও নেয়া হলো। দুই গদিতে শুরু হলো চালের ব্যবসা। প্রতি কেজিতে ১০ পয়সা করে উভয়পক্ষের কাছ থেকে কমিশন। অর্থাৎ জেলা পর্যায়ের মোকাম থেকে যেসব ব্যাপারি চাল নিয়ে আসে তা আমাদের মাধ্যমে বিক্রি হলে প্রতি কেজিতে ১০ পয়সা কমিশন। রাজধানীর খুচরা ব্যবসায়ীরা দু/এক বস্তা যা-ই কিনুক তার জন্যও ১০ পয়সা কমিশন দেন। শত শত বছর ধরে এটাই হচ্ছে আড়তদারি ব্যবসায়ের নিয়ম।
৩. এখানে ব্যাপারিদের কত যে কদর করতে হয়। একটি গদিতে কোনো রকমে ৪০/৫০ বস্তা চাল উঠানোর পর শুরু হয় তাকে জামাই আদর। তার খাওয়া ফ্রি, থাকা ফ্রি। ক্যাশের পাশে বসে বিকেল বেলা আড্ডা দেয় আর বিভিন্ন নাস্তার ফরমায়েশ দেয়। ক্যাশ সরকারও যথারীতি তা তামিল করে। রাতে হিসাব মেলানোর পর দেখা যায় আপ্যায়ন বাবদ ১০০/১৫০ খরচ। আপত্তি করার পর জানা গেল, এটা সবাই করে, রেওয়াজ। এত করেও দেখা যায় ব্যাপারি আমার আড়তে চাল বেশী দেয় না, অন্যদের বেশী দেয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেসব গদি থেকে অগ্রিম দেয়া হয়। আমাদেরকেও দিতে হলো।
৪. পরে চিন্তা করলাম, নিজেরাই মোকাম থেকে চাল এনে বিক্রি করি। বিশ্বস্ত মনে করে, একজনকে পাঠানো হলো। তখনতো আর মোবাইল ছিল না, যোগাযোগ ঘাটতির কারণে এমন হতো যে, ওখানে যে দামে কেনা হলো এখানে তার চেয়ে দাম কম। ট্রাকে চাল আসার পর দেখা যাচ্ছে, লাভতো দূরের কথা সমান সমান থাকে না। ম্যানেজারকে বললাম, কিছু লাভ না হলে বিক্রি বন্ধ থাক। অভিজ্ঞ ম্যানেজারের কথা, এটাতো চাল ব্যবসায়ের নিয়ম না। চলতি দরেই বিক্রি করা উচিত। লাভ লোকসান পরে হিসাব হবে। জানতে চাইলাম, পৃথিবীর কোথাও আছে কেনা, দামের চেয়ে কমে বিক্রি করতে হয়! সে পান খাওয়া মুখে হেসে বলল, চালের ব্যবসায়ে এটাই নিয়ম। নূরু ব্যাপারি নামে একজন নীতিকথা শোনালো- মাঝে মাঝে লস না দিলে আপনার প্রফিট হালাল হবে না। বুঝুন ঠ্যালা।
৫. একদিন বিকেল বেলা আড়তে বসে আছি। একজন সিনিয়র আড়তদার এলেন। ম্যানেজার তাঁর কাছে আমাকে মহাজন হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে তিনি কিছুক্ষণ আমার চোখে তাকিয়ে বললেন, এত কম বয়সে মহাজন হওয়া কিন্তু ভালো কথা নয়। বললাম, আপনার মতো সিনিয়ররা শিখালে ব্যর্থ হবো না। তিনি বললেন, এখানে এসে শিখলে চলবে কেন, আসার আগেই শিখতে হবে। তা নাহলে শিখতে শিখতে পুঁজি শেষ। তবে টিকে থাকতে পারলে এর চেয়ে বড় ব্যবসা আর নেই।
৬. চালের ব্যবসায়ীরা দুই ফসল ওঠার মাঝখানে দাম বাড়ার সুযোগ নিয়ে থাকে। আমার ম্যানেজারের পরামর্শে সব পুঁজি দিয়ে চাল কিনে রাখা হলো, এক মাস পরই বিক্রি করা হবে। সব ব্যবসায়ীরা এটা করে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। সে সময়ে ক্ষমতায় এরশাদ। তার দিন ঘনিয়ে আসছে। আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে, কিন্তু তা ফলবতী হয় না। মহা ধূর্ত এরশাদ এক পর্যায়ে ম্যানেজ করে ফেলে। এভাবেই চলে আসছে কয়েক বছর ধরে। ৮৮-এর বন্যার আগের বছরটিতে নানা রকম তৎপরতার মাধ্যমে এরশাদ সাপ-লুডু খেলে চলেছে। বিরোধী দলগুলো হয়ত ভাবছিল মানুষ আরেকটু অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেই সরকারকে বেকায়দায় ফেলা যাবে। কিন্তু এরশাদ ঠিকই পাবলিককে ম্যানেজ করে করে নয় বছর পার করেছে।
৭. চালের কেজি ৮/৯ টাকা চলছিল। ব্যবসায়ীরা মনে করছিলাম, এটা খুব তাড়াতাড়ি ১১/১২ টাকা হয়ে যাবে। কিন্তু মহাচালাক এরশাদের কৌশল ছিল, দেশ বিক্রি করে হলেও চালের দাম কম রাখতে হবে। সেটা পারলে বিরোধী দল কিছুই করতে পারবে না। তাঁর প্রশাসনের প্রস্তুতি ছিল। প্রচুর চাল আমদানি করে দাম বাড়ার আগে আগে ভর্তুকি দিয়ে বাজারে ছাড়া শুরু হলো। সপ্তাহ যায়, চালের দাম বাড়ার দূরের কথা, আরো কমছে। আমাদের মাথায় হাত। সবার অপেক্ষা দাম বাড়ুক, তারপর ছাড়বে। এভাবে দেড় মাস পর দেখা গেল দাম আর বাড়বে না, নতুন ফসল উঠবে। আড়তের স্তুপ করা বস্তা খুলে দেখা গেল চাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আসলে এ চাল বেশি দিন সংরক্ষণের উপযোগী ছিল না। শত শত বস্তা চাল ৫ টাকা কেজিতেও বিক্রি করা গেল না। আমাদের মত ছোট পুঁজির ব্যবসায়ীরা শেষ হলাম। এ নিয়ে তখনকার ইত্তেফাকে চিঠিপত্র কলাম একটা চিঠি লিখে সরকারের মনোযোগ আকর্ষণ করলাম, বাজার নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, কিন্তু ছোট পুঁজির ব্যবসায়ীদের নির্মূল করা ঠিক নয়। এটা করা হলে বড় পুঁজির ব্যবসায়ীরা বাজারকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করে ফেলে। তখন ক্রেতাদের ভুগতে হয়। যা এখন চলছে।
পরেরটা নিশ্চয় পালিয়ে বিয়ে করার কাহিনী।


তাড়াতাড়ি লিখুন।
যা বুঝলাম আপনি ব্যবসার কোনরকম হিসাব কিতাব না করেই শুধু মনের খাতায় হিসাব করে ব্যবসায় নেমেছিলেন
ইস সেই সময় আপনার সঙ্গে যদি পরিচয় থাকতো। নির্ঘাত আপনাকে উপদেষ্টা বানাতাম। তবে এখন আমাকে যে কোন কাজে উপদেষ্টা বানাতে পারেন। ......
সবার অপেক্ষা দাম বাড়ুক, তারপর ছাড়বে।
আড়তের স্তুপ করা বস্তা খুলে দেখা গেল চাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আসলে এ চাল বেশি দিন সংরক্ষণের উপযোগী ছিল না।
আমি আসলে এই ব্যবসায় নিয়ে কিছু জানি না, তাই প্রশ্ন জাগছে, যখন দাম বাড়ার জন্য সবাই অপেক্ষা করছিলো তারপর চাল ছাড়বে; এই সময় কি গুদামের চাল পরীক্ষা করা হয় নাই ?
স্যাঁত স্যাঁতে গুদাম আর চাল পুরোপুরি শুকনা না হয়ে হালকা ( যা খালি চোখে সাধারন লোক বুঝবে না ) থাকলে চাল নস্ট হবে খুব তাড়াতাড়ি, নইলে বছর খানেক ভালো ভাবেই রেখে দেয়া যায়।
বাইরের দিকে বস্তাগুলোতে বোঝা যায়নি। ভাইরে, এখানে আসল ঘটনা হলো সব ব্যবসা সবার জন্য না। আড়তদারিতে অনেক বছর চাকরি করে তবেই নিজের ব্যবসা করা উচিত।
ওহ! বুঝছি।
যেকোন কাজেই অভিগগতা একটা জরুরি ব্যাপার। শুধু ব্যবসা না
এইটা কি কন? তাইলে কি পয়লা বিয়া করার আগেও আরেকটা বিয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করা লাগবে??

খরাপ হয় না।
ভাইডি, এরকম বিশেষ ক্ষেত্রে পরোক্ষ অভিজ্ঞতার শর্ত প্রযোজ্য। অভিজ্ঞতা মাস্ট। নইলে আমার মতো ১০ লাখার পুঁজি হারাইয়া শিখবেন।
আপনে করছেন আড়তদারি।
আমি করতেছি শেয়ার। পেরায় একই রকম অবস্থা।
শেয়ার ব্যবসাও করছিলাম। সেই শুরুর দিকে। বাটা সু আইপিও ছাড়লো। শখে শখে বাবার কাছ থেকে তিন হাজার টাকা নিয়া আবেদন করলাম। ১০ টাকার ৩০০ শেয়ার। লটারিতে পুরাটাই পেলাম। ঘরে পড়ে থাকলো বছর দুই। মাঝে মাঝে পত্রিকায় শেয়ার মূল্য দেখি। কিন্তু পুরা ক্লিয়ার না বিষয়টা। একসময় টাকার দরকার হওয়ায় বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলাম। পত্রিকায় দাম দেখলাম ১৩০ টাকা। মতিঝিলের এক ব্রোকার হাউজে গেলাম। দাম হয় ৩৯ হাজার টাকা। আমার কিন্তু আগাগোড়া বিশ্বাস হচ্ছিল না, ১০ টাকার শেয়ার ১৩০ টাকা করে কিনবে! ভাবলাম, নিশ্চয়ই কোনো ফাঁক-ফোকড় দেখিয়ে কিছু টাকা ধরিয়ে দেবে। কিন্তু সবশেষে নগদ ৩৯ হাজার টাকা হাতে নিয়ে বিস্মিত হলাম। ৩ হাজার টাকার জিনিস ৩৯ হাজার টাকা হতে পারে! এখনো বিষয়টা আমার কাছে অবাক লাগে। তাই সেকেন্ডারি মার্কেটে আগ্রহ পাইনা। ভাই বেঁচে গেছি।
আপনার লেখা সিরিজগুলো ভাল লাগছে। নিয়মিত লিখবেন, আশা করি।
চেষ্টা করবো। ধন্যবাদ।
আপনার এই সিরিজটা আগ্রহ নিয়ে পড়ি। চালিয়ে যাবেন আশা করি......।
মন্তব্য করুন