মাই লিটল ম্যাজিশিয়ান ও পিএসসি সার্টিফিকেট
আমার ছোট্ট মেয়েটির নাম জারা সুপ্রীতি। এখনো চোখের সামনে দেখতে পাই ওর জন্মদিন বা জন্মমুহূর্ত। দেখি ওর টলমলে পায়ে প্রথম হাঁটার দৃশ্য। প্রথম প্রথম কথার অস্ফুট উচ্চারণ, পুরো একটি শব্দ বলতে পারত না ও, প্রত্যেক শব্দের প্রথম অক্ষর উচ্চারণ করে নিজের মনের কথা বোঝাতে পেরেছে এমন ভঙ্গি করে সবার দিকে তাকিয়ে বোদ্ধার মতো ওর ঝাকড়া চুলের মাথা দোলাত। যেমন কোককে বলত “কো” বা পাপাকে “পা”, তেমনি বোনকে দিদি বলা শেখানোর চেষ্টায় সে শুধু “দি” বলে নিজের দায়িত্ব শেষ করত। এখন ও পূর্ণাঙ্গ শব্দ উচ্চারণ করলেও বোনকে সেই আগের মতোই “ দি” বলে ডাকে।
জারা এই বছর পিএসসি পরীক্ষা দেবে। লম্বায় সে আমাকে ছুঁয়ে ফেলেছে। আমি ওকে বুকে জড়িয়ে যখন বলি, কেমন লম্বা হয়ে যাচ্ছিস বলতো?
জারা বলে, ভালো তো, তোমাকে আর মাথা নিচু করে কথা বলতে হবে না। মাথা উঁচু করে কথা বলবে এখন থেকে।
জারার বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম ওর খেলার সামগ্রীর প্রতি তীব্র ঝোঁক। কোনো খেলনার দাম ওর কখনো মাথা ব্যাথার কারণ যেমন হয়না তেমনি কোনো কিছু একবার চাইলে তা না পাওয়া পর্যন্ত বাসার কারোকে শান্তিও দেয়না। আর এই অবিরত অশান্তির অনশন করে কিছু পাবার ব্যাপারে ওকে সব সময় উৎসাহ দেয় পাপার যেভাবে হোক মেয়ের আব্দার রক্ষা করবার মন। আমি অনেক সময় বলি, বাদ দাও, দু’একদিন গেলে ও ওর ডিমান্ড ভুলে যাবে। মেয়ে ভুলে যাবে কী, বাপই তো ভুলে না। মেয়ে বায়না বিস্মৃত হবার আগেই বাপ মেয়ের আব্দারের খেলনা নিয়ে হাজির। তখন সে খেলনা নিয়ে হয়ত বাপ-মেয়েতে খেলাধুলা চলে, চলে ঝগড়া-ঝাটিও।
আমাদের বাসায় আমার বড়ো মেয়ের যতনা খেলনা তারচে’ ছোটোজনের খেলনার স্তুপ অনেক বেশি। জারা একটি খেলনা দিয়ে বেশিদিন খেলতে পছন্দ করেনা, কয়েকদিন খেলার পর সেগুলো সারা ঘরে পায়ে পায়ে ফুটবলের মতো গড়াগড়ি খায়। মেয়ের বাপ বলে, দেখছো, দেখছো! মেয়ে এত দামী খেলনার কোনো যত্নই করে না। আমি আর ওকে কিছু কিনে দেব না। মেয়ে বাপের কথা পাত্তাই দেয়না, সে নিজের জগতে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। প্রথমে যে খেলনা আমি সহ্য করতে পারতাম না এক সময় সে খেলনার মায়া আমাকে খুব বেশি আঁকড়ে ধরে, মেয়ের খেলনা বলে নাকি দাম দিয়ে কিনেছে বলে বুঝি না, আমি চাকা খসা রেসিং কার জমাই, মাথার ওপর থেকে প্যাঁ-পোঁর বাতি খুলে ঝুলতে থাকা পুলিশ গাড়ি জমাই, ডানাভাঙা হেলিকপ্টার শোকেসে বাসন-কোসনের ঢাঁইয়ের ওপর সাজিয়ে রাখি, দুই চাকার স্কুটার এক চাকা হারিয়ে আরো বেকার সেটা যত্ন করে মুছে-টুছে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে রাখার আপ্রান চেষ্টা করে যাই। আমার মেয়ে এসব কিছুর দিকে ফিরেও তাকায় না। জারা হয়ত তখন ব্যস্ত সবাইকে ম্যাজিক দেখানোতে, টিভিতে ট্রিক এ- ট্রিকস্ দেখে শেখা ম্যাজিক সবাইকে দেখাচ্ছে আর প্রসংশা পাবার জন্য সবার দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। বেশির ভাগ সময় আমরা ওর ট্রিকস ধরে ফেললেও না বোঝার মতো করে বলি, ওয়াও! কী চমৎকার ম্যাজিক!
জারার পছন্দের টিশার্ট হলো, সুপারম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা এইসব। ঘড়ি আর সানগ্লাসের জন্য পাগল আমার এই মেয়েটি। এসবের কালেকশনও আছে ওর। নিজের একটি ছোটো ক্যামেরা আছে, ছবি তোলার হাত ভালো। আমার অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি ওর সে ক্যামেরায় তোলা।
নিত্য নতুন প্ল্যান করে পাপাকে দিয়ে ওর বায়নার জিনিস কেনানোর, ওর পিএসপি নাই; সেটা চাই। পিএসপি আসার পর ওর ট্যাব নাই সেটা চাই, তাও এলো। কিছুদিন পর দেখলাম বাপ-মেয়ে দু’জনের মন খারাপ, আমি আর আমার বড়ো মেয়ে গোয়েন্দাগিরী আরম্ভ করি, ওদের মন খারাপ কেনো জানতে হবে। আমাদের চেষ্টাকে বেশি দূর এগোতে দিল না, বাপ ছোটো মেয়ের জন্য বড়ো এক সাইকেল নিয়ে এসে আমার আর আমার বড়ো মেয়ের গোয়েন্দাগিরীতে পানি ঢেলে দেয়। আমি কিছু বলি না, আমার কিছু বলা মানায় না; শুধু ভাবলাম; দুই চাকার সাইকেল এক চাকার হলে এটাকে ঘরের কোথায় স্থান দেবো। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে সাইকেলের ওপর থেকে জারার মন সরে না, গ্যারেজে সাইকেল চালায় এবং ছোট্ট পরিধির মধ্যে বেশ ভালোই চালায়। তারপর বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার সময় এলো, আমার ঘরেও বিশ্বকাপ ফুটবলের হাওয়া ঢুকলো হুড়মুড়িয়ে, পতাকা এলো, এক নম্বর পছন্দের পতাকা, দুই নম্বর পছন্দের পতাকা, তিন নম্বর পছন্দের পতাকা ক্রমানুসারে। জার্সি এলো: এক নম্বর পছন্দের জার্সি, দুই নম্বর পছন্দের জার্সি, তিন নম্বর পছন্দের জার্সি ক্রমানুসারে। এর পর এলো বল; বাজুকা বল; ফ্লোরে ড্রপ করলে সিলিং পর্যন্ত ওঠে যায় আর আমি চোখ গোল গোল করে দেখি কখন ফ্যানে আঘাত করে অঘটন ঘটায়। এরপর দরকার খেলোয়াড়দের মতো দুই কালারের দুই জুতা..একেই বলে বিশ্বকাপ ফিভার!
আমার মেয়ের সাইকেল গ্যারেজে ধুলায় মাখামাখি, ট্যাব নিজের বাক্সে পলিথিনের জ্যাকেট গায়ে শুয়ে রয়েছে, ক্যামেরা বাক্স বন্দী জীবন যাপন করছে, বাজুকা বল খাটের নিচে ঘাপটি মেরে বসে আছে কখন ওর মালিক পা দিয়ে ওকে ছুঁয়ে দেবে, জারা পড়ার টেবিল থেকে হয়ত আড় চোখে একবার বলের দিকে তাকায় কিন্তু খেলে না। স্কুল বা কোচিং থেকে আসা-যাওয়ার পথে সাইকেলের দিকে তাকায় কী তাকায় না, ওর কি আমার ওপর অভিমান? মাম্মা ওকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করছে ভেবে? আমার মনটাও কেমন অস্থির হয়ে ওঠে খেলনা বা শখের জিনিসের প্রতি ওর এই নির্লিপ্ততা দেখে। আমিই বা কী করবো, আমার মেয়ের সামনে পিএসসি পরীক্ষা। ওকে পরীক্ষায় ভালো করতে হবে, জিপিএ ফাইভ না পেলে কেমনে চলে! ওর বড়ো বোন গত বছর জিপিএ ফাইভ পেয়েছে, ওর ছয় সাবজেক্টের পরীক্ষার জন্য আমরা সারা বছর গাধা-গাধীর মতো ল্যাজ তুলে কখনো স্যারের বাসায় কখনো বা কোচিং সেন্টারে দৌড়েছি। আমাদের সারা বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর পরীক্ষার আগের দিন জানতে পারি প্রশ্নপত্র আউট হয়ে গেছে! ক্লাশ ফাইভের প্রশ্নপত্র আউট হবার যোগ্যতা রাখে কিনা আমার মাথায় যেমন ধরেনি এখনও ধরে না ক্লাশ ফাইভের সার্টিফিকেট একজন শিশুর শৈশব কেড়ে নিয়ে কতখানি প্রয়োজনীয় তার ভবিষ্যত জীবন তৈরীর জন্য। এই সার্টিফিকেটের লোভে লোভে আমাদের কী অধিকার আছে ওদের স্বপ্নের রঙধনুর রঙ কেড়ে নেবার?
পিএসসি পরীক্ষার ডেট ২৩শে নভেম্বর। আমি আমার মেয়ের মুখের দিকে তাকালে দেখি ওর কালো দুই চোখের নিচে আরো একটু কালি জমে আছে, টেনশনের কালি। আমি কিসের লোভে পড়ে আমার মেয়ের চোখের নিচে কালি জমতে দিচ্ছি! এই কি একজন শিক্ষিত মায়ের ভূমিকা নাকি একজন জ্ঞানপাপী’র মতো বিহেভ করছি আমি? বিখ্যাতজনের উক্তি, তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি শিক্ষিত জাতি দেবো। মাঝে মাঝে মনে হয় দরকার নেই আমার একটি শিক্ষিত মেয়ের। দরকার নেই আমার মেয়ের পিএসসির সার্টিফিকেট। ভবিষতে এই সার্টিফিকেট দিয়ে কী হবে জানিনা, তবে সার্টিফিকেটের পাকচক্রে না পড়ে আমার মেয়ে যদি আবার ওর শখের খেলনা নিয়ে আমাদের বাসা অস্থির করে তুলে তবে ভবিষতে আমি নিশ্চয় আরো কিছু ভাঙা খেলনা জমানোর সুযোগ পাবো।
মা’রে দরকার নেই তোর অনেক ভালো রেজাল্ট করার, মোটামুটি পাশ করে খালি ওপরের ক্লাশে ওঠে যা, তাতেই আমি খুশী ।
অনেক অনেক শুভকামনা জারার জন্য। বেঁচে থাকো মামনি!
জারার জন্য শুভ কামনা রইল ↓
অনেক শুভ কামনা রইল।
অনেক অনেক শুভকামনা জারার জন্য। বেঁচে থাকো মামনি!
মন্তব্য করুন