সেই ফুলের দল...
এই মুহুর্তে আমি যে ঘরটায় থাকি তাতে একটা জানলা। সেটা দিয়ে বেশ দূরে হাইওয়ে দেখা যায়। সেখান দিয়ে দিনরাত বিরামহীন হুস হুস করে চকচকে গাড়ি যায়, বিশাল বিশাল ট্রাক যায়, বাস যায়, পিকাপ যায়। আমি বড় একটা হোটেলের ছোট্ট জানালায় একা দাঁড়িয়ে গাড়ি দেখতে থাকি।
জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম প্রিয় মানুষের মৃত্যু নিয়ে।
গত সপ্তাহে খবর পেলাম প্রিয় লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে । ডিমেনশিয়া আক্রান্ত এই লেখক আর লিখতে পারবেন না বলে ঘোষনা দিয়েছে তার ভাই। আমরা আর হাতে পাবোনা সহজ সরল ভাষায় লেখা এক জাদুবাস্তবের ল্যাটিন আমেরিকা।
কিছুক্ষন আগে শুনলাম আমাদের প্রিয় লেখক হূমায়ুন আহমেদ মারা গিয়েছেন। কষ্টে বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। বাংলাদেশের সাহিত্য তার হাতে ধরেই এসেছিলো আমাদের মননে, আমাদের ঘরে। তার আগে পর্যন্ত ভারতীয় বাংলা লেখকরাই দখল করে রেখছিলো আমাদের মন। আমার মনে আছে ১২ বছরের জন্মদিনে এক মামার দেয়া দুইটি বই- মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য, আর অনীশ। প্রথম বইটাতেই তো মনে হয় একটা মেয়ে ছিলো যে সব সময় সবুজ শাড়ি পড়ে, তার দুইটা কুকুর আছে, যে কোন সময় তারা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে মিসির আলীর উপরে। আহা! তারপর থেকে আর কখনো থামেনি হূমায়ুনের দেখানো পথে আমাদের দাপাদাপি। তারপর কত কত প্রিয় মানুষের সাথে পরিচয়। হিমু, শুভ্র, নীলা, আনিস, হাসান, পুতুল, বোতলভূত! বোতলভূত বইটি আমি কয়েক শ’ বার পড়েছি জানেন? সেখানকার ক্ষুদে বিজ্ঞানী অরু আপা, যে কিনা কিছুতেই মানতে চায়না হোমিওপ্যাথির অষুধের বোতলে ভুত আছে। ওজন মাপায়, রঙ পরীক্ষা। আরো কত কিছু। মনেপড়ে নিউটনের ভূল সূত্র! বা খাদক বজলু! অথবা নান্দাইলের ইউনুস! অথবা, কোথাও কেউ নেই এর মনীষা, বা বাকের ভাই, বদি, সৈয়দ বংশের ছেলে কাদের, ছোট মির্জা, এলাচি, লবংগ, মাঝি থেকে জমিদার হয়ে ওঠা কাসেম, নিবারন, কঙ্কা, তিতলি!
এছাড়া আছে তার প্রবাসের গল্প। মধ্যবিত্ত বাংলাদেশী ছেলেটা যখন আমেরিকা আসলো, তখনকার ঘটনা! হুমায়ুন আহমেদ, আমরা সবাই প্রথম আমেরিকা এসেছি আপনার হাত ধরে। আমরা সবাই হোটেল গ্রেভারইনে থেকেছি, আপনার মেয়েদের সাথে লায়ন কিং দেখেছি, ফ্লোরিডার সমুদ্রসৈকতে বিরহী প্রেমিকের জন্য মন খারাপ করেছি, ডিজনী’র প্যারেডে রংবেরঙ্গয়ের চরিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে থেকেছি।
আপনি আমাদের খুব প্রিয় মানুষ হূমায়ূন। এত প্রিয়! এই বিদায় মানা যায়না। জানলায় দাঁড়িয়ে চোখ ভরে পানি আসে। গাড়িগুলো ঝাপসা হয়ে আসে। হাইওয়ে থেকে কেউ দেখতে পায় না আমাকে।
অরু আপা, ইমু, পুতুল, বিলু, নিলু তোমরা সবাই ভালো থেকো। অনেক ভালবাসি তোমাদেরকে। এই লাইনটা দেখে মনে পড়লো আমরা সবাই আজ সত্যি সত্যি বড় হয়ে গেলাম। ছেলেবেলার আনন্দকে সত্যিই সাথে করে নিয়ে গেলেন হূমায়ুন।
তার 'নীল হাতি' আমার লাইফে উপহার পাওয়া প্রথম বই।
আমার শৈশবের একটা বিকেল বাসার বাইরের ঘরে চুপচাপ বসে কেটে গিয়েছিল মুগ্ধতায়,
উনার কথা শুনতে শুনতে।
বইটার ২য় পাতায় তার নাম কেবলি নীল একটা স্মৃতি হয়ে গেল হঠাত্.. :'(
বড় মামার কাছ থেকে উপহার পাওয়া ''আমার ছেলেবেলা'' এবং ''পিপলী বেগম'' দিয়ে হুমায়ুন আহমেদের সাথে পরিচয় তাও সে বছর বিশেক আগের কথা। তারপরে কত অলস দুপুর, বিকাল , সন্ধ্যা রাত কেটেছে তার বই পড়ে। আমার প্রথম উপার্জনের ৫৬ টাকা দিয়ে তারই বই কিনেছিলাম ''জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুল'' আজ তিনি নেই। এই ধরনে বিষন্নমাখা সকাল বোধহয় এই জীবনে পার করি নাই।
পরম করুনাময় তাকে শান্তি দিন।
চুপ করে ঝাপসা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকি...
অসাধারন উনার লেখা মধ্যাহ্ন!!
কস্ট পাইছি অনেক বেশী
ছোটবেলার অনেকটাই এই লোকের বইয়ের সাথে। প্রথম পড়ছিলাম বোতল ভূত, আমার এক কাজিনের বাসায়...দাওয়াত ছিল ওই বাসায়, দাওয়াত টাওয়াত ছোটবেলা থেইকাই অসহ্য কিন্তু ওই বাসা ছিল অসম্ভব প্রিয়, কারণ ফুপা জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে চাকরি করতো, অসংখ্য বই ছিল। স্বভাবমতন বই খোঁজা শুরু করলাম, সাদা রঙের কভারে একটা বোতলের ছবি, তার মধ্যে একটা ভূত, যদ্দুর মনে পড়ে। বড়রা সবাই গপ্পে ব্যস্ত, আমি এক কোনায় বসে নিশ্চিন্ত মনে পড়তেছি, যেই বগা ভাই ওদের থেকে বোতল ভূত ছিনতাই করে নিয়ে গ্যালো অমনি খাওয়ার ডাক। খাওয়া পর ফিরে আইসা দেখি ওই বই আর নাই। কাজিনরে জিগ্গেস করলাম (বদটা আমার সমবয়সী), সে এমন এক উদাস ভাব করলো যেন এই বই সে কস্মিনকালেও দেখেনাই। বুঝলাম আমি যদি নিয়ে যাইতে চাই এই ভয়ে লুকায় ফেলছে। ওই ছোট বয়সে বেশ ভালই দুঃখ পাইছিলাম মনে আছে। তারপর কোনো এক পরীক্ষার পর বাপজান বই কিনতে নিয়া গেল দোকানে, আমি ঐটাই কিনলাম সবার প্রথমে। এই হইলো বোতল ভুতের কাহিনী। পিপলী বেগম কিনছিলাম কোনো এক বইমেলা থেকে...আর পুতুল মনে হয় জন্মদিনে কিনছিলাম। নীল হাতিও কোনো এক বাসায় বসে পড়ে শেষ করছিলাম। নুহাশ এবং আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগ কিনে দিছিল মামা। কত অসংখ্যবার পড়া, তারপরেও পড়তাম, বারবার বারবার। সেই বইগুলা একটাও আর আমার সাথে নাই এখন। ছোটবেলা হারাইতে হারাইতে কিছুই থাকলো না আর। যাব কই!
স্কুলের লাইব্রেরি ছাড়াও, স্কুলের ক্যান্টিনে বই রাখা হতো বিক্রির জন্যে, প্রতি স্পতাহে নতুন বই আসতো, কিনে কুলানো যায় কতো.। স্কুলে বাসে ২টা শিফট ছিলো, প্রথম শিফটে সেই ভোরবেলা যেতাম কেবল ক্যান্টিনের মামুর থেকে চেয়ে নিয়ে বই পড়ার জন্যে, পড়ে আবার টিফিনের আগে ফেরত দিতে হতো।। সেইবেলাতে বইয়ের জন্যে এতো আগ্রহ জাগিয়েছিলো সেবার তিনগোয়েন্দা আর হুমায়ূন আহমেদ!
সব ছাপিয়েও মন খারাপ লাগা কমে না
দেবী নামেও একটা অসাধারণ উপন্যাস আছে
হ্যা , পড়সি।
হুস হুস করে চকচকে গাড়ি যায় '
হু, তা যাইতো বটে।
আরেকজন ফাঁকিবাজ!
ওমা! ছেলের কতা শুনেচ??
আর নয়তো কি? শুনি? হুহ..
মন্তব্য করুন