ইউজার লগইন

এ বাংলার, শাশ্বত শীত প্রকৃতির গল্প ঃ `ঝরা পাতার গান ' পর্ব-১

কুয়াশার অন্ধকারে হাজার বছর ধরে শীত কন্যা আসে ষড়ঋতুর লীলা বৈচিত্রের হেমন্তের ফসলে আঁকা মেঠো পথ ধরে। স্থান, কাল ভেদে এ শীত কন্যায় রূপ নানা অঞ্চলের দেব-দেবীর মত নানা সজ্জায় সজ্জিত হয়। হেমন্তের মাড়াই করা ধান বড় বড় কড়াওয়ালা মাটির হাড়িতে রাখতেই শীত রূপসী শীতের নানা উপকরণ কুয়াশার চাদরে ঢেকে এনে রাখে গৃহস্তের আঙ্গিনায়; কড়াওয়ালা মাটির হাড়িতে টোকা দিয়ে বলে, ‘এই গৃহস্ত আমি এসেছি ; চল, পিঠা-পুলি-পায়েস বানাই।’

হেমন্ত আর বসন্তের মাঝে শীত আসে শূন্য মাঠের পথে, নিরবে। প্রকৃতি যেন, মানুষের মত কাঁপতে থাকে ভীত সন্ত্রস্ত পদভারে। বৃক্ষ তার সমস্ত পত্র অর্ঘ হিসাবে অর্পন করে শীত দেবীর পদতলে। গাছে পাতা নেই, ফুল নেই, মাঠে ফসল নেই। প্রকৃতি যেন ধ্যানমগ্ন ভিক্ষু সন্নাসীর মত সব সম্পদ দান করে দীর্ঘ উপাসের মধ্য দিয়ে পরম বৈরাগ্য লাভ করে। শীতের রাত যেন, শেষ হতে চায় না। নির্ঘুম একটা রাত যেন, হাজার বছরের রাত। কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল; কোনদিন সারাদিনেও সূর্য নেই; শুধু মাঝে মাঝে কুয়াশার মধ্য দিয়ে হালকা লাল আভায় উঁকি দিয়ে যায়। পাহাড় দেশের মেঘ যেন, কুয়াশা রূপ নিয়ে শীত দেবীর রথে চড়ে দূর কোন পাহাড় থেকে প্লাবিত হয়ে আসে ভাটি বাংলার দেশে।

প্রতিবেশী কারো কাঁপানো, ভাঙ্গা গলার ডাক শুনে হাড় কাঁপানো শীতে আমি চাদর মুড়ী দিয়ে দরজা খুলতেই একরাস কুয়াশা ঢুকে পড়ল আমার ঘরে। দরজা-জানালা সব বন্ধ করলেও কুয়াশা ঢুকে খড়-ধঞ্চে-পাটখড়ীর বেড়া-ছন-ছাউনির ফাঁকে ফাঁকে। ‘কামে যাইবা না, ধর তোমার পান্তা-পিয়াজ-মরিচ আর কাস্তে-কোদাল...।’ ঠোঁট ফাঁটা হাসির ফাঁকে কত কথাই না বলে যায় বীনা। কথার সাথে সাথে মুখ থেকে বের হওয়া কুয়াশা যেন, না বলা হৃদয়ের কথা অকপটে বলে দেয়। ঘুম ভাঙ্গা হাসিতে কত কথাই না তারে বলি। কে সে মোর, কেন এত আপন, আত্মার সে কি আত্মীয়--আমি জানি না। শুধু তারে না দেখলে মন যেন, কেমন করে। এই তারে দেখি, প্রকৃতির মত নানা রংয়ে, ঢংয়ে, হাসি কান্নায়। কি আশার আলো নিয়ে কুয়াশার অন্ধকারে কাস্তে-কোদাল, পান্তা-মরিচ-পিয়াজ নিয়ে মাঠে চলি নিরবে, একাকী। দু’হাতে কুয়াশা ঠেলে ধীর পায়ে এগিয়ে চলি ঘন শিশির মাখা মেঠো ঘাসের পথ ধরে। চোখে ঘুম লেগে থাকে। কত বেলা বুঝা যায় না।

শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম বাংলার জলাশয় শুকিয়ে আসে। আমারি মত কর্মমুখর মানুষগুলি শীতের সকালে কাজের টানে ছুটে চলে মাঠ-ঘাট-হাওর-বাওর-বিলে। কাজের সাথীরা মাঝে মাঝে মাঠের কাজ না করে অথবা কাজ ফেলে কোথা যেন, ছুটে যায়। হঠাৎ কোন সাথীর ডাক শুনি, ‘কুইক্কা, যাবিনি, ভুইগদার বিলে, কাইলকা দুলাইললা মেলা মাছ ধরছে, যাবিনি?’ গ্রামে যারা বাস করেন তারা জানেন, খোকা থেকে কোকা, কোকা থেকে কুইক্কা--কিভাবে নামের বিবর্তন হয়। যাই হোক, নিজের ক্ষেতের কাজ ফেলে ছুটি চলি সাথীদের সাথে। গ্রাম বাংলার হাওর-বাঁওর-ছোট নদী-নালা-খাল-বিল-ডোবায় মাছ ধরার হিরিক পরে যায়। ভুইগদার বিলে মাছ ধরতে কতবার গিয়েছি। ছয় সাত মাইল হাঁটাপথ। শীত যেন কোথায় পালিয়ে যায় আমার দেহ থেকে। কি টান, কি উদ্দাম--ঠান্ডা পানির মধ্যে মাছ ধরা। শিং মাছের কাঁটা ফুটে কত ক্ষত হয়েছে হাত-পা। বিষকাঁটালী বিরুৎ গাছের পাতা-ডগা দিয়ে কত ঘষেছি ক্ষতস্থান। পল, টাকজাল, জালি, ক্ষেতজাল, টেডা, বড়শী ইত্যাদি দিয়ে টেংরা, বউজ্জা, সিং, মাগুর, কই, পুটি, সৌল টাকি--কত না মাছ ধরেছি! বৃহত্তর ময়মনসিংহের ‘বিল বাওয়া’ উৎসবের মত আমাদের এই অঞ্চলেও ‘মাছের হরিলুট’ উৎসব হত। ঝুড়িতে, সিলভারের হাড়িতে অথবা গামছার আঁচলে মাছ বেঁধে রান্নার স্বাদ নিয়ে কত গল্পই না করেছি সাথীদের সাথে। বিক্রমপুর অঞ্চলের কিছু কিছু বিল-ঝিল-হাওরের গভীর পানি হেমন্তের পরেও থাকে। গ্রীষ্মের চৈত্রমাসে সব শুকিয়ে আসে। কি যাদুর টানে অথবা কি রহস্যময় আনন্দে মাঘ মাসের শীতেও মাছ ধরতে শীত অনুভব হয় না। যেটুকু অনুভব হয়, দু’একটা সিং, কই ধরার পর তাও চলে যায়। মাঝে মাঝে আকিজ বিড়ি, রমনা বিড়ি অথবা যে কোন সুখটানে কোথা যেন শীত চলে যায়। বিল থেকে আসার পথে কলমী শাক, সরিষা পাতা নিয়ে আসি বাড়ীতে, সবাই খুশী হবে বলে। হরিলুটের মাছ পাড়া-প্রতিবেশী, আত্নীয়-স্বজনদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হত। বড় ভাগটা থাকত বীনাদের জন্য। গায়ের কোন পুকুরে মাছ ধরার ডাক পড়লে বীনাকে পুকুর পারে থাকতে বলি। নানা ভংগিতে মাছ ধরি আর ওর হাসি মাখা মুখটা দেখি। মাছ ধরার সেরা কৃতিত্ব নিয়ে শুকনো কাঁদার চটচটে পায়ে মাটির ঘরের আঙিনায় জুড়ী-ডোলার সব মাছ ফেলি। ছোট মাছগুলো রেখে সব দেই প্রতিবেশীদের বিলিয়ে। ঠোঁট চাপা, মুখ ভেংচি আর কথা কাঁটার ভংগি দেখে বুঝি, এই ভাগাভাগি বীনার পছন্দ হয়নি। বলি তারে, ‘আরে, অগো নাচানাচি আর দোয়ায়ইতো এত মাছ ধরলাম।’ বলে সে, ‘তাই বইলা, সব বড় মাছ হেগো দিবা।’

পোস্টটি ৯ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


ভাল, লেখায় শীতের ছোঁয়া পেতে ভালই লাগে। চলুক।

শাশ্বত স্বপন's picture


বিষণ্ণ ভাই, অতি বিষণ্ণে গরীবদের জন্য ছন্দ মিলিয়ে একটা কবিতা লিখুন না।

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


কোন বিষয় ঠিক করে আসলে কিছু লিখতে পারি না। যা মাথায় আসে তাই লিখি। Sad

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


একসময় শীত খুব পছন্দের ঋতু ছিল, এখন আর মজা পাই না!
লেখা ভাল হৈছে।

শাশ্বত স্বপন's picture


নিভৃত ভাই, দয়া করে পুরো লেখাটা পড়বেন। রাজনীতিবিদদের দ্বারা গরীব করে রাখা আমাদের দেশটা যে কত সুন্দর, শুধু ঝরা পাতার গান পড়লেও কিছুটা উপলব্দি করতে পারবেন।

তানবীরা's picture


ভাল, লেখায় শীতের ছোঁয়া পেতে ভালই লাগে। চলুক।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাশ্বত স্বপন's picture

নিজের সম্পর্কে

বাংলা সাহিত্য আমার খুব ভাল লাগে। আমি এখানে লেখতে চাই।