ইউজার লগইন

কোরবানী ইদ ও আমাদের সচেতনতা

‘কোরবানী’ কিংবা ‘বলি প্রথা’ পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কৃতি হিসেবে এখনো টিকে আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন উৎসবে এখনো বলি প্রথার প্রচলন রয়েছে। তবে অনেক রাষ্ট্র কিংবা সমাজ ধর্মের নামে এই প্রথার বিরুদ্ধে কথা বলছে, অনেক জায়গায় এই প্রথার বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। উদাহারণ স্বরূপ বলা যায়;- নেপালে প্রতি পাঁচ বছর পর পর একটি পুরাতন মন্দিরে কয়েক হাজার পশুকে বলি দেওয়া হতো। এই বছর সেই নিয়মটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এছাড়া ভারতের অনেক মন্দিরে কালী পূজায় অতীত ঐতিহ্য হিসেবে বলি প্রথার প্রচলন থাকলেও বিভিন্ন মন্দিরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে বলি প্রথা সম্পূর্ণ যে বিলুপ করতে পেরেছে তা কিন্তু নয়। ভারতের অনেক প্রদেশে দূর্গা পূজায় মহিষ বলি দেওয়ার নিয়ম এখনো আছে। সনাতনীরা গীতাকে ঈশ্বরের বাণী হিসেবে ধরে নেয়। সেই গীতাতে ভগবান বলছেন- "পত্র পুষ্প ফল মূল ভক্তিসহকারে নিবেদন করলে তিনি তা গ্রহণ করেন।' সেই সূত্র ধরে অনেকেই বলে থাকেন ভগবানে খুশি করার জন্য পশু বলির দরকার নেই।

সভ্যতার শুরুতে পোশাক ও শস্য উৎপাদন নারীর আবিষ্কার। শস্য উৎপাদনের পর প্রাচীন মানুষ ভাবতে লাগল; মাটিতে প্রাণ থাকে আর সেই কারণেই মাটি থেকে শস্য জন্ম দেয়। তেমনি মানুষ ভাবত রক্তের মধ্যেও প্রাণ আছে। তাই সূত্র অনুযায়ী মানুষ যদি মাটিকে রক্ত দেয় তাহলে মাটি খুশি হয়ে বাড়তি শস্য প্রদান করবে। সেই ধারণা থেকেই মানুষ প্রাণী বলি দেওয়া শুরু করে। সময়ের পরিক্রমায় একসময় এসব ধারণার সাথে বিভিন্ন মিথ যুক্ত হতে থাকে। সেই মিথের পিঠে ভর করেই এই প্রথা আজকে আমাদের সমাজে ঐতিহ্য কিংবা সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে। সেই সংস্কৃতি আজ আবার অর্থনৈতিক লেনদেনের বড় একটা সেক্টর হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে।

‘কুরবান’ পারস্য শব্দ আর ‘কুরবানী’ হলো উর্দু শব্দ। আরবী শব্দ হলো উধিয়া যার অর্থ হলো রক্ত উৎসর্গ। তার মানে উধিয়া তথা কুরবানী হলো আল্লাহকে সন্তুষ্টির জন্য জন্তু কে জবাই করা। (সূত্র: কুরবানী ও পশুবলি-ভবঘুরে) ইসলাম ধর্মের কোরবানী প্রথা আসে আব্রাহামিক ধর্মের প্রভাবে। আব্রাহামিক ধর্ম বলতে ইহুদি খ্রিস্টান ইসলাম বোঝানো হয়।যাদের মূল উৎস ইব্রাহিম বা আব্রাহাম। ইব্রাহিম আল্লাহ আদেশে নিজের প্রিয় বস্তু সন্তান ইসমাইলকে কোরবানী দিতে নিয়ে যান। কোরবানী দেওয়ার পর দেখা গেল সেখানে তাঁর সন্তান নয় দুম্বা মতান্তরে ভেড়া কোরবানী হয়েছে। সেই মিথকে কেউ আল্লাহ পরীক্ষা ও বান্দার ত্যাগ হিসেবে বিবেচনা করেন। এই মিথটাই ইসলাম ধর্মে ইহুদিনের মতন কোরবানী প্রথা চালু করে। এই পশু কোরবানী প্রথা চালুর আগে পৃথিবীতে মানুষ কোরবানী দেওয়ার প্রচলন ছিল। মানুষ কোরবানী বা বলি দেওয়ার প্রথা ভারতবর্ষে এক সময় ছিল। যা পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায়। মানুষের গলায় বসান ছুরি পশুর গলায় স্থানান্তরিত হয়।

কোরবানী উপলক্ষ্যে ফেসবুক ব্লগ কোরবানীর পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন বাক্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়! তবে এই ক্ষেত্রে আমার কিছু নিজস্ব ভাবনা আছে। কোরবানী প্রথা একদিনে সমাজ থেকে মুছে যাবে না। তার উপর এর সাথে অর্থনৈতিক সর্ম্পক এবং সাথে দামী গরু কেনার দাপট যুক্ত হয়েছে। যারা কোরবানী প্রথার বিরোধী তারা কেউ মনে হয় না সবজিভোজী আন্দোলনে যুক্ত তাদের আপত্তির জায়গাটা হল পশু হত্যা করে উৎসব করা উচিত না। এরা কেউ মাংস খাওয়া কিংবা পশু হত্যার বিরোধী নয়। তারা পশু হত্যার মাধ্যমে উৎসব না করার পক্ষে। আমাদের সমাজে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে সমস্যা পড়তে হয়। বিশেষ করে প্রথমেই আপনাকে বিভিন্ন পক্ষে বিপক্ষে ফেলে দেবে। ছোট বেলায় কালী পূজায় পাঁঠা বলি দেখার জন্য বেশ উৎসাহী ছিলাম। ছোট বেলায় বলির সময় একবার পাঁঠার দুই পা’ও টেনে ধরেছিলাম। তবে ব্যক্তিগতভাবে উৎসবের নামে পশু হত্যার বিরোধী। তবে যেহেতু এটা একটা ঐহিহ্য হিসেবে চলে আসছে সেহেতু যাদের ইচ্ছা তারা দিতেই পারে। তবে এই কোরবানী বা বলিটা আমাদের দেশে যেভাবে দেওয়া হয় তাতে ঘোর আপত্তি আছে। কারণ যে কোন সভ্য সমাজে এসব বলি দেওয়া হয় লোকচক্ষুর আড়ালে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রকাশ্যে শিশুদের সামনে রাস্তার মধ্যে কোরবানী দেওয়া হয়। যা চরম মাত্রায় অবিবেচকের মতন কাজ মনে হয়। কারণ এসব দৃশ্য সবাই সহ্য করতে পারে না এবং অনেক সময় শিশুদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। একজন সাধারণ মানুষ যে ভয় পায় তার একটা কাহিনী বলি; একবার তাজউদ্দীন আহমদ-এর শ্বশুর কোরবানী ইদ উপলক্ষ্যে একটা খাসি কিনে আনেন। জামাইয়ের জেল মুক্তির আনন্দে তিনি উৎফুল্ল। তিনি তাজউদ্দীনকে নিয়ে খাসীটি জবাই করাবেন বলে ঠিক করলেন। এই সংবাদ শোনার পর তাজউদ্দীন আহমদকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে তার কন্যা শারমিন আহমদ পানির ট্যাংকের পেছনে তাজউদ্দীন আহমদকে আবিষ্কার করেন। তিনি সেখানে লুকিয়ে ছিলেন। ধরা পরার পর তাজউদ্দীন আহমদ ব্যথিত স্বরে বললেন-আমি ছোটবেলা থেকেই পশু-পাখির জবাই দেখতে পারি না। যাই হোক শেষ পর্যন্ত তাজউদ্দীনকে খাসি জবাই করতে হয় নি। (সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদ:নেতা ও পিতা-শারমিন আহমদ)

তাই পশু কোরবানীর বিরোধীতা করার চাইতে সবচেয়ে জরুরী উন্মুক্তভাবে যাতে কোরবানী না হয় তার বিরোধীতা করা। কারণ এতে যেমন মানসিক ভীতি আছে তেমনি উন্মুক্তভাবে কোরবানীর পর নোংরা গন্ধ, মশা মাছির ফ্রি উৎপাত তো আছেই। কোরবানী উন্মুক্তভাবে না করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দিলে নিজেদের সচেতনা যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি পরিবেশও নোংরা হয় না। সমস্যা হল এই কথা বলা মাত্র অনেকে তেড়ে আসবে সব খাইতে পার কিন্তু কোরবানী দেখতেই সমস্যা! এদের কী করে বোঝাই, পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ আছে যারা সব খায় কিন্তু একটা মুরগিও জীবনে জবাই দেয় নাই। বিশ্বের সকল দেশেই কোরবানী দেওয়ার সিস্টেম আছে। এবং জবাইগুলো হয় লোক চক্ষুর আড়ালে একটি নির্দিষ্ট স্থানে। সবার সামনে জবাই দিলে সোয়াব বেশি হবে এমন কোন ফতোয়া নাই। আল্লাহ’র উদ্দেশ্য আপনি ত্যাগ করছেন তার জন্য ওপেনলি আপনাকে জবাই করার হুমুক তো দেয় নাই। অনেকে আবার এসব জবাইয়ের ভিডিও করে অনলাইনে ছেড়ে দেয়। যা অসুস্থ মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ড বলে মনে হয়।

এই বছর ঢাকা সিটিকর্পোরেশন ঢাকা শহরকে পরিষ্কার রাখতে একটি চমৎকার নিয়ম চালু করে-কোরবানী দিতে হলে নির্দিষ্ট জায়গায় দিতে হবে। অথচ এমন চমৎকার ও সুস্থ নিয়মের কথা শুনে আমাদের অসুস্থ সমাজের অসুস্থরা ক্ষেপে গেলেন। অনেকে অভিযোগ করে বলছে এটা কোরবানী’র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র! ৩০ অগাস্ট ২০১৫ তারিখে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ছোট ছেলে মাওলানা হাসানাত আমিনী বলেন-ঈদের দিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের পতন হবে। নির্দিষ্টস্থানে কোরবানী দেওয়ার নিয়ম করার প্রেক্ষিতে হাসানাত আমিনীর বলেন, দুই নির্বাচিত মেয়র আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন নাস্তিকদের পরামর্শে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। তিনি আরো বলেন-পাড়ায় মহল্লায় পশু কোরবানির হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে এদেশে কোরবানী নিষিদ্ধের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। তাই নাস্তিক-মুরতাদদের পরামর্শে ধর্মবিদ্বেষী নিয়মনীতি চালু করে কোটি কোটি মুসলমানদের ওয়াজিব বিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

এই মূর্খ্য উম্মাদদের কী করে বোঝাই; একজন সুস্থ মানুষ মাত্রই উন্মুক্তস্থানে কোরবানী’র বিরোধী করবে তার জন্য নাস্তিক হতে হয় না। একজন সচেতনা মানুষ মাত্রই উন্মুক্তস্থানে কোরবানীর বিরোধীতা করবেন। আর ঐতিহ্যের কথা হিসেব করলে অশিক্ষা, কুশিক্ষাও আমাদের ঐতিহ্যের অংশ তাই শিক্ষার উন্নয়ন করা যাবে না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ। আর এই ইমান যদি এরা বিশ্বাস করত তাহলে এমন একটি চমৎকার সিস্টেমকে এরা সবার আগে স্বাগত জানাত।

পোস্টটি ২৫ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মসীহ's picture


কুরব শব্দ থেকে কুরবানী

তানবীরা's picture


যারা মানুষকে ভয় দেখিয়ে ব্যবসা করে খায় তারা তাদের ব্যবসার ওপর আঘাত আসলে হৈ চৈ করবেই। প্রতিটি দেশ, প্রতিটি সমাজ এই ভাঙা গড়ার খেলা থেকে আজকের এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। এখন আমাদের সমাজের বিবেকবান মানুষদের ওপর নির্ভর করছে তারা কতোটুকু সভ্য হবেন বা আদিম যুগে থেকে যাবেন

সুব্রত শুভ's picture


কথা সত্য। এই বিরোধীতা মূলত আয়-ইনকামের জন্য। কারণ এমন সিস্টেম হলে তাদের ইনকাম কমে যাবে।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

সুব্রত শুভ's picture

নিজের সম্পর্কে

অকামের লোক