পদব্রজে চন্দ্র ভ্রমণ
ইহকাল ধরে চন্দ্রে যাত্রা করিবার রাস্তা খুঁজিয়া বেড়াইতেছি। উহু, ভাগ্যদেবীর কোনরকম কৃপাদৃষ্টি এই অভাগার দিকে পড়ে নাই। আমার অদ্যকালের সমস্ত সাধনাই সাড় হইল। কোন রূপ সুফল কিম্বা কুফলের পাপড়ি হৃদয় মেলিয়া সাড়া দিলনা। ইহা কি হইল? ভগ্নহৃদয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি। বাল্যকাল হইতেই চন্দ্র অভিসারের বিরাট দৈত্যাকার স্বপ্ন লালন করিয়া লালিত হইয়াছি। আমার এই দৈত্যাকার স্বপ্ন বুঝি এই বার মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়া দন্ত মুখ এক করিয়া ফেলিল। স্বপ্নের দৈত্যের দন্ত মুখ যথাস্থলে রাখিবার লক্ষে অন্য কসরৎ অবলম্বন আবশ্যক। অন্যমনস্কে ফুলার রোড পদতলে পেষণ করিতেছি। কিন্তক পদ বাবাজীদের যেন আর কথা শুনিবার জো নাই। সেই পূর্বান্ন লগ্ন হইতে হাটিয়া বেড়াইতেছে উহারা। যেন সামনে আগাইতে লজ্জা পাইতেছে। কোন মহৎ উপায় অবলম্বন করা কিঞ্চিৎ জরুরি। কি করা যায়? হঠাৎ রিকশার টুং টাং শব্দ যেন আমার দেহ মনকে আন্দোলিত করিয়া ফেলিল। উহার এক রাশ সুখানুভতি আমাকে ঝঁকিয়া ধরিল। চকিতেই মাথায় খেলিয়া গেল, হায় হায়… চন্দ্রের সাথে মর্ত্যের যদি ডাইরেক্ট কানেকশান রাস্তা তৈয়ার করা যায়! কি আনন্দ, কি আনন্দ! আমার দুনিয়া বসন্ত বাতাসে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। আহা, মধু, মধু! এত বেসম্ভব চমৎকার সৌন্দর্যমন্ডিত চিন্তা আমার মত গবেটের মাথায়! আমি বুঝি বুদ্ধিমান হইয়া গেলুম। ইহকাল পর হয়ত বুদ্ধির তৎপার্য খুঁজিতে বিভিন্ন নামী বিশ্ববিদ্যালয় আমার এই বুদ্ধিমান মস্তিষ্ক ব্যাবচ্ছেদ করিয়া দেখিতে চাহিবে। কি আনন্দ, কি আনন্দ! চন্দ্র টু মর্ত্য ডাইরেক্ট রোডের চারপাশে থাকবে বিশাল বিশাল বট বৃক্ষ, কৃষ্ণচূড়া, কদম্ব, কড়ই, হাসনাহেনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। বসন্তকালে ফুলের সুবাসে মৌ মৌকরিবে চারপাশ। আহা, বড়ই চিত্তাকর্ষক। ‘মামা, লড়েন চড়েন না কেন? কই যাইবেন?’ শ্যালক পুত্র রিকশাওয়ালার কন্ঠ শুনিয়া মনে হইল যেন স্বর্গ ছাড়িয়া মর্ত্যে ধপাস করিয়া পতিত হইলাম। ক্রোধে শরীর ধমকাইয়া উঠিল। কিভাবে আবার স্বর্গে ফেরত যাওয়া যায় তাহা নিয়াই ব্যস্ত হইয়া ভাবিতে শুরু করিলাম। রিকশাওয়ালা….. আহা মধু, মধু! আমার মস্তিষ্ক বুঝি এই বার জাদুঘরেই স্থান পাইল। এত করিৎকর্মা বুদ্ধিতে আমার মগজ ঠাসা, ইহকালে বুঝিতেই পারি নাই। রিকশা করিয়াইতো চন্দ্রে যাওয় যায়। কেমন আমার সাধের বৃক্ষ দেখিতে দেখিতে যাওয়া যাইবে। নাহয় নামিয়া বৃক্ষের গোড়ায় কিঞ্চিৎ পানি ও ঢালিতে পারিব। আহা! ‘ধুর, মামা মনেলয় যাইবেন না।যা হউক, যাইগা। তয় মামা, এট্টা কতা – এই রইদে ঘুইরেন না; মাতার ইস্কুরুপ খুইল্লা যাইব গা।’ রিকশাওয়ালার কন্ঠে দ্বিতীয় বারের মত ভূমিতে অবতির্ণ হইলাম।যাই হউক, এই বার আর রাগিলাম না।দেখি ওরেই প্রথম প্রস্তাব দিয়া। কন্ঠে মৌচাকের সমস্ত মধু উপুড় করিয়া ঢালিয়া একটু খানি দন্ত দেখাইয়া সুধাইলাম ‘মামা’, হেহে ‘একটু চন্দ্রে যাইবার বড়ই আকুতি ছিল; লইয়া যাইলে বেসম্ভব উপকৃত হইতাম’।বিরাট আবিষ্কারের আনন্দে বিমহিত হইয়া দন্ত কেলাইয়া মামা বলিল, ‘মামা, কইছিলাম না বেশি রইদে ঘুইরেন না! কি কইলাম আর হইয়া গেল। হাতে হাতে ফল। মাতার ইস্কুরুপ মনে লয় ঢিলা হইয়া গেছে, আর একটু হইলে খুইল্লা যাইব’।কি প্রশ্নের কি উত্তর! ক্রোধ আমার বাধা মানিতেছে না। এইবার কন্ঠে মৌচাকের সমস্ত ভ্রমরের হুল ঢালিয়া সুধাইলাম ‘কলাবাগান যাইবা?’বড়ই বেজাড় মুখে মামা উত্তর দিল ‘হ যামু, পঞ্চাইশ ট্যাকা’। আমার মস্তকে লৌহ ধারা বহিয়া গেল। বলিতে ইচ্ছা করিল- ওহে শ্যালক পুত্র, ৫০ টি টাকা চৌখে দেখিয়াছ? বলিলাম না।পকেট হাতড়াইয়া কিঞ্চিৎ স্কচটেপ মারা কুড়ি টি টাকার নোট দোলাইয়া বলিলাম ‘কুড়ি টাকা, যাবা?’ ভ্রমরের হুলে ক্ষত বিক্ষত গলায় মামা উত্তর দিলেন ‘না, হাইট্টা যান’।কি আপদ, ‘ওহে শ্যালক প্রবর, তোরমত বর্বর, ডাকাতের রিকশায় যাইবই না’।মামা তার রিকশা লইয়া চলিয়া গেল। আহা! বড়ো দুক্ষ পাইলাম। এই গতিতে যাত্রা করিলে হয়তো তড়িৎ গতিতে চন্দ্রে যাইতে পারিতাম। ঘুরিয়া আজিমপুর বাস স্ট্যান্ডের দিকে যাত্রা করিলাম। উদ্দেশ্য, বাসে চাপিয়া মিরপুর রোড অতঃপর পদ যাত্রা। যন্ত্র দুইটা একটু বিশ্রামও হইল। অনেক্ষণ যাবৎই ক্ষুধা অনুভত হইতে ছিল। তাই, ভুড়ী বাবাজীকে ঠান্ডা করিবার লক্ষ্যে মুড়িওয়ালার কাছ থেকে পনেরটি টাকার মুড়ি খরিদ করিলাম।আমার ভাগ্য আজ বেসম্ভব ভাল, বসিবার এক চিলতে যায়গা পাইলাম। আরাম করিয়া বসিয়া মুড়ি চিবাইতে থাকিলাম। মুড়ি চিবাইতে চিবাইতেই আমার বুদ্ধিতে ঠাসা মগজ হঠাৎ কাজ করিতে শুরু করিল। আহা! বাসে করিয়াই তো চন্দ্রে যাত্রা করা যায়! তাহা হইলে তো রিকশার চেয়ে দ্রুত যাওয়া যাইবে। বিরাট বট বৃক্ষের নীচে বসিবার বেঞ্চি থাকিবে, আর অতি নিকটবর্তী স্থানে মুড়িওয়ালা থাকিবে। বাসে তৈল লইবার ফাঁকে ফাঁকে বাস হইতে নামিয়া ক্ষুধাকে হনন করিবার নিমিত্তে মুড়ি খরিদ করা যাইবে। হেল্পারের ডাকে স্বপ্ন পদদলিত হইল। ‘এই যে ব্রো, ভাড়া দিয়েন’। অল্পবিদ্যায় ভয়ংকর পারদর্শী হেল্পারের দিকে কৃপা দৃষ্টি উপহার দিয়া মুড়িওয়ালার নিকট হইতে প্রাপ্ত প্রায় নতুন পাঁচটি টাকার নোট বাড়াইয়া গম্ভীর গলায় বলিলাম ‘কলাবাগান’। প্রায় ঝা চকচকে নোট খানা হয়ত ব্রোর পছন্দ হয় নাই।ততোধিক গম্ভীর গলায় বলিল,কলা বাগান যান আর Mango বাগানই যান, ভাড়া Ten ট্যাকা’। আকাশ হইতে ভূমিতে কিঞ্চিৎ ঝাকুনির সাথে অবতীর্ণ হইলাম। দুই কদম রাস্তার ভাড়া যদি দশ টাকাই হয় তাহা হইলে চন্দ্রে যাইতে না জানি কত টাকা চাহিয়া বসে! দুশ্চিন্তায় যখন ললাটের নোনা জল পদতলে পড়িবার উপক্রম হইল,তখন অল্পবিদ্যায় ভয়ংকর পারদর্শী হেল্পার বলিয়া উঠিল ‘ট্যাকা না থাকলে Down করেন, উস্তাদ বাস istop’. সাথে সাথে বেমাক্কা ঝাক্কিতে যাত্রিগণের উল্টাইয়া পড়িবার উপক্রম হইল। অপমান করিবার এহেন সুযোগ হয়ত তাহারা আর পায় নাই। তাই ড্রাইভার বিমানের পাইলটের মতই দ্রুত কন্ট্রোল সামলাইয়া ককপিট (!) থাকিয়া উচ্চস্বরে বলিয়া উঠিল ‘নামেন, নাইলে গলা puss করিয়া ফেলাইয়া দিব’। কি আর করা! আমি নির্বিবাদী মানুষ। গলা বাঁচাইতে নামিয়া পড়িলাম। হেল্পারকে বলিলাম, ‘তাহা হইলে পাঁচটি টাকা ফেরৎ দাও’। হেল্পার সিনেমার খলনায়কের হাসি অবিকল কপি পেস্ট মারিয়া বলিল, ‘এই পর্যন্ত যে come করছেন এর ভাড়া five ট্যাকা’।আর তৎক্ষণাৎ বাসের পাইলট উল্কা বেগে বাস ছুটাইয়া দিল। কি আর করিবার আছে! এই যদি হয় অবস্থা তাহা হইলে পদ ব্রজ ছাড়া আর কোন গতি নাই যে দৈত্যাকার স্বপ্নের দন্তমুখ এক রাখিব। এই ভাবেই অপরিকল্পিত অনৈতিক ক্রম বর্ধমান ভাড়া আমার মত অসংখ্য সাধারন মানুষকে বিপর্যস্থ করিতেছে। দ্রুতই চিন্তা করিলাম, দূরে থাক ডাকাতের দল, আমার রাস্তা বানানো হইলে পদ ব্রজেই রওনা দিব। ভাই-বোন সকল, আপনাদিগকের নিকট আকুল প্রার্থনা, আমাকে চন্দ্রে যাইবার নিমিত্তে সহায়তা করুন, সরকারের কাছে দাবি পেশ করুন। না হইলে আমি আমার দৈত্যাকার স্বপ্ন সহকারে গলদেশে রশি দিয়া ঝুলিয়া পড়িব। তখন যদি ভূ-লোকে দু’ একটা ভূমিকম্প হইয়া যায়, আমার কোন দায়বদ্ধতা থাকিবেনা বলিয়া দিলাম।
মন্তব্য করুন