ইউজার লগইন

মার্দাসডে বনাম ওল্ডহোম

মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার প্রায় সারা বিশ্বব্যাপী মাদার্স ডে উদযাপিত হয়। স্কুলে-পড়া বাচ্চাদের উৎসাহ আর উচ্ছ্বাস আর নানা গিফটশপের দোকানগুলোর সাজসজ্জা আর প্রতিযোগিতা হলো এই উৎসবের লক্ষ্যণীয় ব্যাপার। যাঁদের বাড়িতে স্কুলগোয়িং বাচ্চা আছে তাঁরা অনেকটা ঈদ-ক্রিসমাস-পূজার স্বাদ পেয়ে থাকেন এরমধ্যে। রাত জেগে কার্ড-বানানো, ছবি-আঁকা, ফুল-লুকানো, উপহার-লুকানো, সর্তক চলাফেরা, ফিসফাস। বলাই বাহুল্য, এ-উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় নিবন্ধ আসে, ব্লগ লেখা হয় আর ফেসবুক টুইটারতো আছে। আমাদের লোকদের ফেসবুকের অনেক শুভেচ্ছা কিংবা ব্লগের মন্তব্যে প্রতি বছর একটি বিষয় প্রায় ঘুরেফিরে আসে যে, পশ্চিমারা বাবা-মাকে ওল্ডহোমে রেখে দিয়ে মাদার্স ডের ভড়ং করে বছরে একদিন, সারা বৎসর বাবা মায়ের খোঁজ নেয় না। তাহলেতো রোজই মাদার্সডে হতো আর এই পোশাকি ভালবাসার দরকার হতো না।

সৃষ্টির আদিকালে মেয়েরাই কৃষিকাজ, ব্যবসা কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে শিকার সবকিছুর দায়িত্বে ছিলেন। সংসার, সন্তান, আয় কী না তারা করেছেন। এখনো আদিবাসী পরিবারে অনেকসময় তাই ‘মা’-ই সংসারের প্রধান, যাকে আমরা বলি মাতৃতান্ত্রিক পরিবার। স্বাভাবিক; যিনি পরিকল্পনা করেন, নিয়ন্ত্রণ তাঁর কাছেই থাকবে। নেপালের চিতোর, পোখরা, থাইল্যান্ডের পাতাইয়ার দিকেও দেখেছি মেয়েরা একসঙ্গে কয়েকটি কাজ করছেন, পুরুষেরা দিনভর ঘুমান আর রাতভর চলে আড্ডাবাজি। কিন্তু সভ্য বলে আমরা যাঁরা নিজেদের দাবি করি, তাঁরা আগুন জ্বালানো শেখার সাথে সাথে প্রাকৃতিকভাবেই শিকার বা কৃষিকাজে দৈহিক শক্তির প্রয়োজনের কারণে মেয়েরা একসময় ঘরে অন্তরীণ আর পুরুষেরা বাইরে চারণ শুরু করেন। অবস্থা অনেকটা এরকম দাঁড়ায়, আয় উপার্জন পুরুষের কাজ, সংসার বাচ্চা মেয়েদের কাজ। গর্ভধারণ ও সন্তানলালনের প্রাকৃতিক ফাঁদটাই অবশ্য সবার চাইতে বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়ায় নারীদের।

সভ্যতা কোথাও এক জায়গায় স্থির থাকে না, পরিবর্তনের নামই বেঁচে-থাকা। নানা কারণে দেখা গেলো মেয়েরা কিছু পড়াশোনা শিখলে ক্ষতির কিছু নেই, অবশ্য পুরুষদের তৃপ্তির জন্য যট্টুক দরকার। আস্তে আস্তে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের সাথে দেখা গেলো, একজনের আয়ে অনেক সময় সংসারের শৌখিনতা অকুলান। মেয়েরা চাকরি করলে মন্দ না, স্বাচ্ছন্দ্য কার না ভাল লাগে? কিন্তু সংসার, রান্নাবান্না? তাহলে বুড়ো বাবা মা যাবেন কোথায়, আচ্ছা বাবা মায়ের ভাবনা পরে ভাবলাম, বাচ্চাগুলোকে কী করবো? মা কাজে গেলে এতো আদরের সোনামনি কোথায় থাকবে আমাদের? বাইরের কারো সাহায্য নেবো? পশ্চিমে যেকোন কাজের জন্যে বয়স ও অভিজ্ঞতানুপাতে বাজারদর মিলিয়ে ন্যূনতম মজুরি সরকারের তরফ থেকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, প্রতি ঘন্টা হিসেবে মজুরি নির্ধারণ করা হয়। মজুরির ওপর শতকরা হিসেবে আসবে আয়কর, সামাজিক কর, পেনশনের প্রিমিয়াম, স্বাস্থ্যবীমা যেগুলো কর্মদাতাকে পরিশোধ করতে হবে। ধরা যাক, কারো মজুরি প্রতি ঘন্টায় দশ ইউরো কিন্তু মালিককে পরিশোধ করতে হয় প্রায় আঠারো ইউরো। দশটাকা মজুরি কর্মচারীর জন্যে আর বাকি সব প্রাপ্য যাদের তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। এই অবস্থায় বাসায় দিন রাতের গৃহকর্মী কিংবা রোজদিনের ঠিক ঝি অনেকেই এফোর্ড করতে পারেন না বলে সাধারণ মধ্যবিত্তরা যাঁরা একটু সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখেন তারা নিজেদের কাজ নিজেরাই করার চেষ্টা করেন। তেমন বড় দরকার হলে, যেমন, বাড়ি বদলানো কিংবা বাড়ি রঙ করা ইত্যাদি, হয়তো বন্ধুবান্ধবের সাহায্য নেন।

আমরা সকলেই জানি, প্রয়োজনই নতুন কিছুর উদ্ভাবক। সেই প্রয়োজন থেকেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, মেয়েদেরকে স্বাবলম্বী হতে উৎসাহ দিতে শুরু হলো, চাইল্ড কেয়ার কিংবা ডে কেয়ার সেন্টারের। সম্ভবত ১৮৪০ সালে ফ্রান্সে প্রথম ডে কেয়ার সার্ভিস চালু হয় ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে যেটা ১৮৬৯ সালে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ১৮৫০ সালের দিক থেকে লন্ডন, নিউইয়র্কের দিকে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে ডে কেয়ার সার্ভিস চালু হতে থাকে। আস্তে আস্তে সোনামনিদের জন্যে একটু করে নিজেদের আপন নিবাস হতে থাকে, ঘরের বাইরে ঘর। কিন্তু তাহলে বাবা মা? তাদেরওতো যত্নআত্তি দরকার, তাদের জন্যে? ১৮২৩ সালে মতান্তরে ১৮৫০ সাল থেকে ইউরোপে ওল্ডহোম বা বৃদ্ধাশ্রমের উৎপত্তি। এর কারণ সন্তানদের অবহেলা বলে না ইতিহাস। বলে, একই চিন্তাধারা, মনমানসিকতা ও ধর্মের সমবয়সীরা একই বাড়িতে, একসাথে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে, নিজেদের চিন্তাভাবনার আদান প্রদান করে অনেক খুশি থাকেন। ছেলেমেয়ের সংসারে একাকিত্বে ভোগেন। প্রথমে যেভাবে আর যে ধারনা নিয়ে ওল্ডহোমের যাত্রা শুরু হয়েছিলো যেমন চরিত্রের সনদপত্র লাগতো তাতে নাম লেখাতে, এন্ট্রি ফি ছিলো বেশ মোটা একটা টাকা, ওল্ডহোমের জনপ্রিয়তার কারণে সেসব আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হতে শুরু হলো। প্রথমে ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে শুরু হলেও উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে সরকার এর মধ্যে জড়িত হতে থাকে আর আস্তে আস্তে শুরু হয় এখানেও ব্যাপক পরিবর্তন।

***********

এখনকার সময় পশ্চিমের মধ্যবিত্তদের প্রায় সব বাড়িতেই দুজনকে চাকরি করতে হয়। সাথে সামলাতে হয় ঘর সংসার, অনেক সময় পড়াশোনা, বাজার ঘাট, সামাজিকতা। বরং নিজের বাচ্চাকে বড় করতে বাইরের সাহায্যের দরকার হয়, সে ডে কেয়ার হতে পারে কিংবা ন্যানি। সেখানে রোজ রোজ বাবা মাকে নিয়ে ডাক্তার, হাসপাতাল, রক্তপরীক্ষা, তাদেরকে সঙ্গ দেয়া, তাদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, এ কাজ গুলো ম্যানেজ করে-ওঠা আসলেই বেশ কঠিন। বাচ্চাকে নিয়ে যেতে হবে হয়তো পার্কে, বাবা মা যেতে চাইছেন হয়তো চার্চে। একটাই রোববার সপ্তাহে, সংসারের হাজার কাজের সাথে নিজের বিশ্রামটুকুও জরুরি। রাষ্ট্র তার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই নাগরিকদের জন্যে ব্যবস্থা করেছে। জনগণের করের টাকায় চলে এই বৃদ্ধাশ্রম। যখন বৃদ্ধাশ্রমে বাবা মা অসুস্থ হন কিংবা তাদের প্রয়োজন হয়, ছেলেমেয়ে ঠিকই ছুটে যায়, ঠিক আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদেরই মতোন। বাবা মা রোগ যন্ত্রনায় কষ্ট পেলে তারাও কাঁদে, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে যত্ন করে, বিষণ্নতায় ভোগে। ঠিক যেমন আমাদের দেশে শহরে চাকরী করা ছেলে মেয়েরা বাবা মায়ের রোগ ব্যাধিতে, কিংবা ঈদ পূজোর পার্বণে কিংবা ভাইবোনের বিয়ে বা আকিকায় প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়িতে ছুটে যান তেমনি করে। আমরাতো শহরবাসী ভাইবোনদের বলতে পারি না, তারা বাবা মাকে ফেলে চলে গেছে, তাদের ভালবাসে না কিংবা তাদের দায়িত্ব নেয় না। এখানেও আবার সবাই বাৎসরিক ছুটিতে একসাথে বেড়াতে যায়, সপ্তাহান্তে মুভি দেখা কিংবা অন্য কিছুতে জড়ায়-যাকে বলে আনন্দময় পারিবারিক আবহাওয়া।

বৃদ্ধাশ্রমের সমবয়সীরা একসাথে থাকেন, ঘুরতে যান, গল্প করেন, খেলেন, নাটক করেন, গান করেন আরো কত কী। এতো জেলখানা নয় যে, ধরে এনে আটকে রাখে। শেষ বয়সে তাদের যা করলে মন ও শরীর ভাল থাকবে তার ব্যবস্থা রাখতে সরকার ও কর্তৃপক্ষের চেষ্টার কোন কমতি থাকে না। লোকের সমবয়সী বন্ধুবান্ধব ছেড়ে সারাক্ষণ একা বাড়িতে দাদি দাদু হয়ে বসে থাকতে কতক্ষণ আর ভাল লাগতে পারে। কিংবা দিনের পর দিন নাতিনাতনির দেখাশোনাই কি আনন্দায়ক কিছু? ওল্ডহোম রীতিমতো তাদের গ্রাহকদের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করে। প্রত্যেকের জন্যে আলাদা ফাইল থাকে, তাদের আগ্রহ, ভাল লাগা, মন্দ লাগা ইত্যাদি সব আলাদাভাবে নোট করে সেভাবে তাদেরকে ট্রিট করা হয়। কেউ বিষণ্ন হলে কেন বা কী তা নিয়ে আলাদা সেশান। দেশে কদিন কটা ছেলেমেয়ে সংসার সামলে যেতে পারে তার বাবা মায়ের মনের দুঃখের খোঁজ নিতে কিংবা তার প্রতিকার এর চেষ্টা করতে? বৃদ্ধাশ্রমে প্রত্যকের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়ে নাতিনাতনি তাঁদের সাথে দেখা করতে আসতে পারেন। তাঁরাও তাঁদের পরিবার পরিজনদের কাছে যেতে পারেন। “বাবা মায়ের যত্ন না নিয়ে পশ্চিমারা কুকুর পালন করে” পশ্চিমের মানুষের সম্পর্কে এমন অপবাদ আসলে কতটুকু সত্যি বা তথ্য নির্ভর তা আমার জানা নেই। হ্যাঁ, পারিবারিক অশান্তি মনোমালিন্য এখানেও আছে, কিন্তু সেটা পৃথিবীর কোথায় না থাকে? কখনো কখনো এখানেও পরিবারের লোকজনদের মধ্যে শীতল সম্পর্ক থাকে বটে। সেক্ষেত্রে আমি বলবো, এখানে প্রত্যেকে স্বনির্ভরশীল থেকে নিজের সম্পর্ক আর মর্যাদা নিয়ে আলাদা থাকার সুযোগ পান যেটা আমাদের দেশে নেই। দিনের পর দিন ক্লিশে সম্পর্ক টেনে নিয়ে যেতে হয় কোন উপায় থাকে না বলে। বাবা মা অসম্মান আর অমর্যাদা ক্ষেত্রবিশেষে সইতে না পেরে ছেলেমেয়েকে শাপ শাপান্ত করেন। একবার এই নিয়ে একটি সিনেমাও হয়েছিলে ভারতে, রাজেশ খান্না আর শাবানা আজমীরের অভিনয়ে “অবতার” যেখানে ওল্ডহোমের প্রয়োজনীয় ধারণা ভারতীয় প্রেক্ষাপট থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছিল।

এই চিন্তাকে মাথায় রেখে সনাতন যুগে বাড়ির বউ মেয়েদের আশীর্বাদ করা হতো, “সাত পুত্রের জননী হও” কিংবা “পুত্র সন্তানের জননী হও”। কারণটা হয়তো পুরোই বৈষয়িক ও কিছুটা স্বার্থপরতাও ছিল। মেয়েরা প্রথমে বাবার ওপর তারপর স্বামীর ওপর আর বুড়ো বয়সে ছেলে মাকে দেখাশোনা করবে এরকম একটা সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার ব্যাপার ছিল। পুত্রসন্তানকে ভালবাসার মাঝে একটা স্বার্থপরতাও কাজ করতো। কারণ কন্যারা বিয়ে হয়ে পরের বাড়ি চলে গেলে ‘ভদ্রমহিলা’-কে দেখবে কে? সে যুগে বয়সের বেশ একটা ব্যবধানে বিয়ে হতো বলে অনেক সময়ই দেখা যেতো বিধবা মা পুত্র সন্তান বা পরিবারের গলগ্রহ হয়ে বেঁচে আছেন। গলগ্রহ হোক আর যাই হোক পুত্র থাকলে নিদেন পক্ষে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁইতো নিশ্চিত থাকে। এই চিন্তাটাকে কিন্তু অনেকটা বৃদ্ধাশ্রমের বিকল্প হিসেবেই ধরা যায়।

পশ্চিম আসলে কী, তাদের সংস্কৃতি কী রকম? ডলার, পাউন্ড, ইউরো, ফ্রাঙ্ক কিংবা ক্রোন? নাকি বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড, ফ্রি সেক্স, ডিভোর্স, লিভ টুগেদার আর ওল্ড হোম? এ ব্যাপারগুলো সম্পর্কে আমরা যা শুনি দূর থেকে ব্যাপারগুলো কী আসলেই সেরকম কিছু নাকি ভিন্ন? ভাল জিনিস এখানে তাহলে কিছুই নেই? সন্তানের প্রতি মাতৃস্নেহ কাজ করে না, বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের ভালবাসা, প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে প্রেম কিংবা গুরুজনদের প্রতি সম্মান? তাহলে, কোন কাগজে সই না করে দুজন মানুষ আজীবন কিসের বাঁধনে বেঁধে থাকেন? কোন সেই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে? এখানেতো মেয়েদেরকে স্বামীর ভরণ পোষনের ওপর নির্ভর করতে হয় না যে স্বামী না দেখলে কে দেখবে। আজো কেনো বিয়েকে সম্মানের চোখে দেখা হয় আর লিভ টুগেদার থেকে বিয়ের হার অনেক বেশি? সমাজে ও রাষ্ট্রে অনেক খুঁটিনাটি ছোট ছোট জিনিস আছে যা এখানকার মানুষ জীবন চলার পথের প্র্যাক্টিসে পরিনত করেছে। যেগুলো অনুকরণীয় ও অনুসরণ করার মতো। জানি না কেন, আমাদের মধ্যে অনেকেই এটা ধরে নেন এদের মধ্যে মানবিক অনুভূতির ঘাটতি রয়েছে। কোন একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বা আচরণ কিংবা ভিন্ন প্রেক্ষাপটের একটা রেওয়াজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত বা মতামত চাপিয়ে দেয়ার আগে তার সংস্কৃতি প্রেক্ষাপট কিংবা পটভূমি জানাওতো জরুরি।

একবার অনেক আগে পয়সা বাঁচানোর উদ্দেশ্যে প্রমোশোনাল ট্যুরে স্পেন গিয়েছিলাম বেড়াতে। বাস ভর্তি শুধু দাদা, দাদী-নানা, নানী বয়সের লোক ছিলো আর আমরা দুজন তরুণ-তরুণী। তখন সেভাবে জানতাম না যে অফ সিজনে হোটেল রিসোর্ট খালি থাকার কারণে বাস কোম্পানির সাথে মিলে তারা কম খরচে এসব প্রমোশোনাল ট্যুরের আয়োজন করে। তাদের লক্ষ্য থাকে এসব পেনশানভুক্ত সিনিয়র সিটিজেনরা। আমরা দুই একলা তরুণ তরুণীকে দাদু নানুরা দু’তিন দিন পর তাদের গ্রুপে নিয়ে নিলেন। আমরা তখন সেভাবে ডাচ জানি না, দাদু নানুরাও ইংলিশ জানেন না কিন্তু তাতে কম্যুনিকেশানে কোন সমস্যা হয়নি। সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতে কিংবা ডিস্কোতে সালসা নাচতে ভার্বাল ল্যাঙ্গুয়েজ জরুরি কিছুতো নয়। তাদের পিকনিক পিকনিক আনন্দ উল্লাস দেখে বারবার নিজের বিধবা দাদুর মুখটি চোখে ভেসে উঠতো। সারাদিন তাসবীহ হাতে বসে থাকতেন, বেলায় বেলায় নামাজ, নাতিনাতনিদের একটু আধটু দেখাশোনা কিংবা কখনোসখনো ছেলেরা তাড়াতাড়ি ফিরলে তাদের সাথে গল্পগুজব। অন্ধের যষ্টি ছেলেদের আর চোখের মনি নাতিনাতনিদের করেছিলেন বিধবা জীবনের অবলম্বন। যদিও ছেলেরা তাঁকে মাথায় করে রাখতেন কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ কিংবা আনন্দ বেদনার কাব্য? এটাই কী জীবন? আনন্দ! তীর্থ করতে যাও নয়তো হজ্জ করতে এর বেশি আবার কী! চল্লিশ পঞ্চাশ জন বন্ধু-বান্ধব দলে বেঁধে বেড়িয়ে পরে, সাইট সিয়িং, সাঁতার-কাটা, নাচ গান হৈ হুল্লোড় জানে কী আমাদের দেশের মরচে পড়ে-যাওয়া বুড়োর দল না তারা সে সুযোগ পায়? আমাদের দেশের ওল্ডহোমগুলো যদি পশ্চিমাদের কনসেপ্ট থেকে ধারণা নিয়ে, শুধু বাড়িতে জায়গা নেই বলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা টাইপ না রেখে এখানকার মতো বয়সনুযায়ী সাথে নিজেদের সংস্কৃতি ও পরিবেশ অনুযায়ী আনন্দ উৎসব বা চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা রেখে তাদের বৃদ্ধাশ্রমের কারিকুলাম তৈরি করে সেই অনুযায়ী তাদের প্রতিষ্ঠান ঢেলে সাজাতেন তাহলে সাধারণ জনগণের হয়তো বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে এই ধারণায় পরিবর্তন আসতো কিংবা আসার সুযোগ হতো। পুরনো ধ্যান ধারনাকে আকড়ে ধরে না থেকে, বাস্তব অবস্থা এবং আজকের সময়কে উপলব্ধি করে নিজেদের ধ্যান ধারনাকে তার সাথে খাপ খাওয়ানো দরকার। শিশুরা যেমন শিশু পার্কের জন্যে উন্মুখ থাকে তেমনি থাকেন বৃদ্ধরা বৃদ্ধাশ্রমের জন্যে। নচিকেতার গানের আবেগ সব সংসারের বাস্তবতা নয়

পরিশেষেঃ

কিউরিসিটি থেকে অনেক বৃদ্ধলোকের সাথে আলাপ করে যা জেনেছিঃ আমি মনে মনে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার জন্যে প্রস্তূত হয়ে আছি। সমবয়সীদের সাথে হাঁটতে বের হবো, ঘুরতে বের হবো, পিং পং খেলবো। অসুস্থ হলে আছে হাসপাতাল আর ডাক্তার। ছেলে মেয়ে আসবে যাবে, এসএমএস করবে, ফোন করবে। আমিও যাবো ছেলেমেয়ের বাড়ি বেড়াতে, নাতিনাতনিদের সাথে খেলতে, পিকনিক করতে। চাই না কারো ওপর বোঝা হয়ে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়টা কাটাতে। আমার কারণে যদি ছেলেমেয়ের ঝামেলা হয়, আমায় ডাক্তার হাসপাতাল করিয়ে ছেলেমেয়ের যদি চাকরি চলে যায়, তাদের সংসার, সন্তান যদি অসুবিধায় পরে তাহলে তাদের ঘাড়ে চেপে বসে আমি কী শান্তি পাবো!

মা বাবাকে নিয়ে একদিন হৈ হুল্লোড় করা, জীবিকার কারণে দূর দূর শহরে বসবাস করা ভাইবোন সব একসাথে হয়ে উপহার আদান প্রদান করার মধ্যে মন্দ কী আছে। বছরে একবার এইদিনটি আসে বলেই এটি বিশেষ, রোজ হলেতো প্রাত্যহিকতার বোরডোমে এটি তার বিশেষত্ব হারাতো। আমাদের বাড়িতে রোজই মা দিবস থাকে, একদিন একটু বেশি বেশি উৎসব হয় যা আমাদের পরিপূর্ণতার স্বাদ দেয়, আনন্দ দেয়।

তানবীরা
১৪/০৫/২০১৪

পোস্টটি ১৭ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

এ টি এম কাদের's picture


আমার ধারণা গ্রাম-বাংলার ৮০ ভাগ মানুষ মাদার'স ডে সম্পর্কে ধারণা রাখেননা । এঁরা কিন্তু মাকে সেবা-যত্ন করেন অনেক অনেক বেশি । গ্রামে মায়েরা সম্মানিত থাকেন । এত পরিবর্তনের পরও আবাহমান বাংলার এই ঐতিহ্যের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি ! সুন্দর পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ !

তানবীরা's picture


গ্রাম-বাংলার ৮০ ভাগ মানুষ তাদের জীবনের "মৌলিক অধিকার" সম্পর্কে কোন ধারনা কী রাখেন? কিনতু তবু তারা বেচে থাকেন। তাদের ভেবে এই পোষ্টটি নয়। সচেতন মানুষদের ভেবে লেখা।

ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্যে

রাসেল আশরাফ's picture


'

আমাদের বাড়িতে রোজই মা দিবস থাকে, একদিন একটু বেশি বেশি উৎসব হয় যা আমাদের পরিপূর্ণতার স্বাদ দেয়, আনন্দ দেয়।

কথা এটাই।

তানবীরা's picture


Love

আরাফাত শান্ত's picture


তবুও ওল্ডহোমে আমার বাবা মা থাকবে এইটা আমি কল্পনাই করতে পারি না!

তানবীরা's picture


ট্র্যাডিশানাল চিন্তা আর ভাবনার দোর গোড়ায় ধাক্কা দেয়াই এই লেখার উদ্দেশ্য ভ্রাত

জাকির's picture


গ্রেট রাইটিং আপু। পশ্চিম সর্ম্পকে লোকে কী জানে না জানে তা বলতে পারব না তবে এটা ভাবতে পারি যে, সবাই আমার মতই লোক মুখে শোনো কান গরম করে। পশ্চিম মানেই খারাপ তা মানতে আমি অবশ্যই নারাজ। ঐ মানুষগুলোও রক্ত মাংসে গড়া, তাদেরও আবেগ অনুভূতি আছে, তারাও মানুষকে ভালবাসে। সর্বোপরি তাদের মন আছে।!

তানবীরা's picture


আপনার সংবেদনশীল মনতব্য পড়ে আমি আভিভূত

প্রিয়'s picture


বাবা- মাকে ওল্ডহোমে রাখবোনা কোনদিন এটা সত্যি। কিন্তু আমি যদি ঐ বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকি তবে নিজে ওল্ডহোমে থাকবো। অন্যান্য বুড়োদের সাথে গল্প-গুজব করে কাটাবো মন্দ কি!

১০

তানবীরা's picture


Big smile Big smile Big smile

১১

নিভৃত স্বপ্নচারী's picture


খুব ভালো পোষ্ট। ওল্ডহোম এখন সময়ের বাস্তবতা।

মাকে তো কাছে পাইনি কোনদিন, বাবা বেঁচে থাকতে কখনও বাবাকে ছেড়ে থাকার কথা চিন্তা করতে পারিনি। তবে, বৃদ্ধ বয়সে নিজেকে কখনও ছেলে-মেয়েদের বোঝা ভাবতে পারিনা।

১২

তানবীরা's picture


ভাল লাগলো জেনে

১৩

নাজনীন খলিল's picture


বেশীরভাগ পরিবারেই দেখা যায় মা-বাবাকে একা একা থাকতে হয়। ছেলে হয়তো বিদেশে বা বদলির চাকরি।
আমার পাড়ায় কিছুদিন আগে এমনি এক পরিবারে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে বাসার কাজের বুয়া কিছু একটা খাইয়ে অজ্ঞান করে টাকাপয়সা নিয়ে যায়। দুইজনকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নেয় প্রতিবেশীরা।
এভাবে একা থাকার চাইতে ওল্ডহোমই ভাল।নিরাপত্তার নিশ্চয়তাটুকুতো থাকে। আর একদম একা থাকার চাইতে অনেকের সাথে থাকলে থাকলে নিঃসঙ্গতায় ভুগতে হবেনা।

১৪

তানবীরা's picture


আমাদের দেশে ধারণাটাই কাজ করে, যাদের ছেলে মেয়ে বাবা মাকে দেখাশোনা করে না তাদের ওলডহোমে থাকতে হয় ------ তাই এর পজিটিভ সাইডগুলো লোকে দেখে না ---- আর ওলডহোমগুলো নিজেদের কারিকুলামও সেভাবে মানুষের কাছে উপসথিত করতে পারেনি Sad

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

তানবীরা's picture

নিজের সম্পর্কে

It is not the cloth I’m wearing …………it is the style I’m carrying

http://ratjagapakhi.blogspot.com/