ইউজার লগইন

ফুটবল ফান

অনেক আগে ফুটবল নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম...এইখানে তার লিঙ্ক।যখন থেকে জানি “জালে বল জড়ালে গোল বলা হয় তাকে” তখন থেকে আবাহনীর সাপোর্টার। কী বুঝে আবাহনীর সাপোর্টার সেটার কোন বিশদ ব্যাখ্যা নেই। এক বাড়িতে থাকি সবাই, তুতো ভাইবোনদের মধ্যে দলাদলি, একদল আবাহনী আর একদল মোহামেডান। যে দলের সাথে আমার ভাব বেশি, তারা আবাহনী, তাই দলের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততা অক্ষুণ্ন রাখতে আবাহনী আমিও। তখন অবশ্য সর্ব সাকুল্যে দলের নামই জানতাম তিনটি, আবাহনী, মোহামেডান আর ব্রাদার্স ইউনিয়ন। ব্রাদার্স ইউনিয়নকে জানতাম স্বাধীনতার স্বপক্ষের দল হিসেবে যারা মাঝে মাঝে বেশ ভাল খেলে বটে কিন্তু কোনদিন ফাইন্যালে পৌঁছে না। আমার মেজো মামাকে আমার খুব পছন্দ আর তাঁর পছন্দের দল ছিলো ব্রাদার্স ইউনিয়ন। টিভি কিংবা রেডিওতে খেলার ধারা বিবরনী শোনার সময় তিনি এতো উত্তেজিত থাকতেন যে, আমাদের ভয় হতো খেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত টিভি বা রেডিও খানা আস্ত থাকবেতো। আমরা ম্যাকগাইভার কিংবা ইত্যাদি দেখার সুযোগ পাবোতো। তো সেই না বোঝা বয়স থেকেই উত্তরাধিকারসূত্রে আমি আবাহনী, ববিতা, সোহেল রানা, রেখা, জিতেন্দ্র ইত্যাদি পেয়ে যাই। সেদিন যখন নেদারল্যান্ডস আর মেক্সিকো খেলার সময় ডাচ টেলিভিশনের ধারা বিবরণীতে ভূতপূর্ব বিশ্বকাপ খেলোয়াড়রা উত্তেজনায় চিৎকার করছিলেন, “বল গোলবারের ওপরে নয়, গোলপোস্টের ভিতরে মার”, তখন হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না।

কী চরম হতাশা তাদের কন্ঠে! প্রতিটা শুট মিস হচ্ছে আর তারা টিভিতে খেলা দেখানো বন্ধ করে, কেনো মিস হলো তার গ্রাফ এঁকে টেকনিক্যাল এ্যানালাইসিস শুরু করে দিচ্ছিলো। কতো দূর থেকে কতো ডিগ্রিতে কিভাবে কিক করতে হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। হতাশার চরম বহিঃপ্রকাশ যাকে বলে! এক পর্যায়ে তো পঁচাশি মিনিট পার হওয়ার পর আমরা সবাই যখন আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম...তখন .।.।

যখন আমি বাংলাদেশে বাস করি তখন আমাদের শিশু ক্রিকেট টীম মাত্র আন্তর্জাতিক অংগনে পা রেখেছে। তবে অবস্থা আজকেও যা, তখনো তাই ছিল। হারতেই নামতো কখনো সখনো দৈবাত জিতে যেতো। ঝড়ে বক কি মরে না? মাঝে মাঝেতো মরে। দেশের সার্বিক সামাজিক পরিবেশ যা আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের “চুলে খুলে রাস্তায় নেমে” জাতীয় আনন্দ ভাগ করে নেয়ার, উল্লাসে মত্ত হওয়ার সুযোগ দেয়নি তা আমাকে এই অরানিয়া দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাউকে একান্ত নিজের ভেবে পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ আমি এখানে পেয়েছি।

বৈরী আবহাওয়ার কারণে নেদারল্যান্ডসে মাঠে ঘাটে তেমন কোন উৎসব আমেজ লক্ষ্য করা যায় না। উৎসব যা হয় বাড়ির ভিতরে। ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে ইষ্টার, ক্রিসমাস এগুলো পারিবারিক মিলনমেলা বলে ধরা হয়। রাষ্ট্রীয় উৎসব হলো রাজার জন্মদিন, থার্টি ফার্স্ট ইভ। এই দুটো দিনে ডাচেরা পথে নামে। রাজার জন্মদিন মানে এলাহী কারবার। আমাদের দেশের পহেলা বৈশাখের আমেজ কিছুটা পাওয়া যায়। আলাদা ট্রাফিক প্ল্যানিং হয় সারা দেশ জুড়ে, নিরাপত্তাও নেয়া হয় কঠোরভাবে। সেদিন কী হবে আর কী হবে না সেটা আগে থেকে কেউ জানে না। অনেকে বাড়ির পুরোন জিনিসপত্র বাড়ির সামনের রাস্তায় বিক্রি করেন, অনেকে খাবার বিক্রি করেন, অনেক দোকান সস্তায় জিনিসপত্র বিক্রি করেন, অনেক কোম্পানী সেদিন কমপ্লিমেন্টারী পণ্য বিলান, চকলেট, আইসক্রীম, ক্যান্ডিফ্লস, টিশার্ট, কলম, চাবির রিং ইত্যাদি ইত্যাদি। আর একটা দিন, না ঠিক দিন নয়, রাত জাগে এই কমলারা একসাথে সেটা হলো থার্টি ফাষ্ট নাইট। বারোটা একমিনিট কখন হবে জানার জন্যে ঘড়ির দরকার নেই, সারা আকাশ আলো হয়ে যখন চারধারে কানে তালা লাগানো শব্দ হবে আমরা জানবো, আমরা আর একটি ইংরেজী ইউনিট নতুন করে শুরু করলাম। সেদিনের ওলন্দাজ আকাশ অসাধারণ মায়াময়, নতুন বউয়ের মতো সেজেগুজে আলহাদী কিংবা আবার সাথে লাজ রাঙা। যে টাকার বাজি পুড়ে তাতে অনেক গরীব দেশের বাৎসরিক বাজেট হতে পারে কিন্তু সেটা আলাদা হিসেব। আমাদের বড্ড ভাল লাগে দেখতে, গায়ে ওভারকোট চাপিয়ে আর গলায় কানে মাফলার প্যাঁচিয়ে আমরা ঘন্টা ভর রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি।

আর চার বছর পর পর আসে ঘুরে এই ফুটবল। ফুটবল উপলক্ষ্যে প্রতিটা পাড়া কমলা রঙের ফ্ল্যাগ, ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়। বাড়ি বাড়িও শোভা পায় জাতীয় পতাকা, কমলা জার্সি ইত্যাদি। দোকানের পর দোকান ছেয়ে যায় কমলা টিশার্ট, ভুভুজেলা, হ্যাটস ইত্যাদি দিয়ে। প্রথমে অনেক চড়া দামে বিক্রি শুরু হয় তারপর আস্তে আস্তে নেদারল্যান্ডস হেরে গেলে কিংবা ফাইন্যালে পৌঁছে গেলে দেখা যায় স্টক খালি করার জন্যে বিনে পয়সায়ও তখন বিতরণ শুরু হয়ে যায়। বেকারিতে কমলা কেক, কমলা জুস, কুকি, চকলেটে কমলা রঙের ছায়া, কোথায় নয়। বড্ড ভাল লাগে তখন রাস্তায় হাঁটতে, ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখতে। সারাদেশ যেন একদল ‘অরানিয়া’। ডাচদের জাতীয় উৎসবের রঙ ‘অরেঞ্জ’ যার ডাচ উচ্চারণ ‘অরানিয়া’। ডাচ ভাষায় ‘জে’ বর্ণটি নেই।

সপ্তাহান্তে যদি খেলা পড়ে, তাহলে শহরে গাড়ি নিয়ে ঢোকাই মুসিবত। আর কী পরিমাণ বিয়ার আর খাবার বিক্রি হয় তার কোন আন্দাজ লাগানোই মুশকিল! ক্যাফে আর রেস্টুরেন্ট মালিকরা বোধহয় এই প্রার্থনাই করেন সব অরানিয়া খেলা যেনো সপ্তাহান্তেই পরে। পুলিশ গাড়ি ঢোকা নিষেধ করে দিলেই কী আর জনতাকে আটকানো যায়? সাইকেল, বাস আর পদযুগল তখন কাজে আসবে তো। এই বিষাদময় আবহাওয়ার দেশে সুজ্জিমামার দেখা পাওয়া যায় জুন-জুলাইতে, স্কুল-ইউনিতে ছুটি পড়ে, এমনিতেই চারধারে উৎসব উৎসব ভাব। তারওপর বিশ্বকাপ আর তাতে যদি নিজের দেশ শক্ত পক্ষ হয় তাহলে আনন্দের কী থাকে সীমানা!

২০১০-এ ফুটবল নিয়ে বিরাট আশা ছিলো অরানিয়াদের। পাঁচটি মিউনিসিপ্যালটি বাছাই করে দুই মানুষ সমান বড় হুন্দাই স্ক্রিন দিয়েছিলো শহরে, যাতে হাজার হাজার মানুষ একসাথে খেলা দেখতে পারে। শহরবাসীরা একসাথে বসে দাঁড়িয়ে খেলা দেখেছে, অনেক জায়গায় প্রায় পাঁচ হাজার লোকও একসাথে দাঁড়ানো। সব ধর্ম, সব বর্ণ, ভাষাভাষীর লোক এক জায়গায়, ব্রাজিল আর নেদারল্যান্ডস খেলছে আর আমরা সবাই একসাথে খেলা দেখছি। একজন ব্রাজিলিয়ান আর ডাচের মধ্যে পাঁচ সেন্টিমিটারও দূরত্ব নেই। যখন ব্রাজিল গোল দিলো জনা ত্রিশেক ব্রাজিলিয়ানের কী উচ্ছ্বাস আর বাকী পাঁচ হাজার ডাচ তখন চুপচাপ তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছে। ত্রিশের ওপর তাপমাত্রা থাকায় কিছুক্ষণ পর পর আমাদেরকে হোস দিয়ে পানি ছিটিয়ে ভিজিয়ে দেখা হচ্ছিলো যাতে উত্তেজনায় কিংবা গরমে কেউ অসুস্থ হয়ে না পরে। খেলা শেষ হওয়ার পর শুরু হয় আসল উৎসব, সবাই সবাইকে হাগ করছে, হাত মেলাচ্ছে, যাকে বলে উল্লাসে উন্মত্ত। বিদেশীরা কমলা জামা পড়লে, তাদের সাথে উল্লাসে মত্ত হলে তারা খুব খুশী হয়ে ওঠেন।

লাইভ ব্যান্ডও থাকে হাজির। প্রথমে গান শুরু হয় দেশাত্মবোধক দিয়ে, তারপর বেলা বাড়ার সাথে রক এন্ড রোল কিংবা হাউজ মিউজিকে পৌঁছে যেতে বেশি সময় লাগে না।

আর্জেন্টিনার সাথে নেদারল্যান্ডসের খেলা পড়লে কী হবে তা নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা চললো কদিন। তখনকার রাজপুত্র আর আজকের রাজা বিয়ে করেছে আর্জেন্টিনিয়ান। মাক্সিমা রীতিমত আমৃত্যু নেদারল্যান্ডসের জনগনের পাশে থাকার শপথ নিয়ে রাজ পরিবারের সদস্য হয়েছে।

কিন্তু তিনি এ সময় কী করবেন?

বাবার বাড়িকে পাশ কাটানো, তা কখনো হয় মন থেকে? যা হোক শেষ পর্যন্ত সেই অগ্নিপরীক্ষা সীতাকে দুহাজার দশে দিতে হয়নি। যুগে যুগে এ পরীক্ষা শুধু সীতাদের জন্যেই। দু হাজার চৌদ্দতে আর উপায় নেই। সেমি ফাইন্যালে নয় জুলাই খেলছে ডাচ-আর্জেন্টিনা। আবার সেই একই বৃত্তে আমরা। তবে রয়্যাল ফ্যামিলি তাদের অফিসিয়াল সাইটে জানিয়েছেন, রাজা-রানী দুজনের কেউই এই ম্যাচটি দেখতে সাও পাওলো যাচ্ছেন না। তারা প্রাসাদে বসেই ম্যাচটি উপভোগ করতে চান। আমি বলবো, শুধু রানীকে কটাক্ষ কেনো? রাজারওতো শ্বশুরবাড়ির প্রতি ভদ্রতা আর কর্তব্য আছে। আর্জেন্টিনা হেরে গেলে তিনি কী করে টিভির সামনে উল্লাস করবেন? তাই দুজনই দুজনেই শ্বশুরবাড়ির প্রতি ভদ্রতা রেখে, কিছু কথা থাক না গোপন করেই বাড়িতে খেলা দেখুন।

বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষ্যে প্রায় প্রত্যেক অফিসে, স্কুলে এখানে “ফুটবল পোল” খেলে। এটা অনেকটা লটারী টাইপের গেস-গেম খেলা। ফিফার স্ক্যাজুয়ালটা দেয়া থাকে। প্রথম রাউন্ডের খেলা হবার আগে অনুমান করে, কোন দেশ কটা গোল দিবে, জিতবে সেটা লিখে জমা দেয় সবাই। প্রথম রাউন্ড শেষ হয়ে গেলে, যে সবচেয়ে সঠিক অনুমান করতে পেরেছে সে পুরস্কার পাবে। তারপর দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা শুরু হবার আগে আবার সেটা পূরণ করে জমা দিতে হবে। এভাবে ফাইন্যাল অব্ধি যাবে। এতেও চরম উত্তেজনা বিরাজ করে, অফিস, স্কুল সব জায়গায়।

দুইহাজার দশে যখন সাউথ আফ্রিকাতে খেলা চলছিল তখন প্রায়শই এখানে কাজের সময়। অফিসের ক্যান্টিনে, স্কুলের ক্যান্টিনে সব জায়গায় টিভি চালু, খেলা হচ্ছে। যারা অনেকবেশী ফুটবল পাগল তারা বার বারই কফির ছুতো করে খেলা দেখতে চলে যাচ্ছে আবার আসছে আবার যাচ্ছে। একদম পুরো ফাঁকি দেয়ার রেওয়াজ এখানে নেই। তবে নেদারল্যান্ডসের খেলার দিন বস বলতেন, ঠিকাছে, যারা যারা খেলা দেখবে সবাই আধ ঘন্টা আগে চলে যেতে পারো। যারা না দেখবে তারাও চলে যাও। রাস্তায় বেরোলে তখন কী ভালই না লাগতো। দিনের বাজে চারটে কিন্তু চারধার ফাঁকা। একটা পাখিও যেনো নেই আকাশে। সবাই টিভির সামনে সেট। অন্যদিন যে গন্তব্যে পৌঁছতে আধ ঘন্টা সেইন দশ মিনিট ম্যাক্সিমাম।

সব কল্পনা সত্যি করে সেবার নেদারল্যান্ডস ফাইন্যালে। কিন্তু না, এতো কিছু করেও শেষ রক্ষা হলো না, আবার রানার আপ। ফাইন্যাল খেলার দিন রাজা সাউথ আফ্রিকার সেই মাঠে উপস্থিত ছিলেন খেলোয়াড়দের উৎসাহ দেয়ার জন্যে। নেদারল্যান্ডস হেরে গেলে এক শ্রেণী অপবাদ ছড়ালো, “রাজার উপস্থিতিই অরানিয়ার পরাজয়ের কারণ”। রাজা নীরবে সয়ে নিলেন, রাজা হলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। কুসংস্কার কোথায় নেই? অক্টোপাস পল যুগে যুগে, স্থানে স্থানে।

আমাদের বস ডাচ আর তার স্ত্রী স্প্যানিশ। বস তার পরিবার আর শ্বশুরবাড়ির সবাইকে একসাথে নিয়ে খেলা দেখেছেন। এবং সোমবারে যথারীতি কোন ব্যান্ডেজ ছাড়াই অফিসে এলেন। আমি বেশ অবাক হলাম, আমরা বাংলাদেশীরাতো এমন কিছু ভাবতে পারি না। হয় মরবো না মারবো, আমরাতো এই জানি। তবে ইউরোপের সবাই যে এতো ঠান্ডা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তা কিন্তু নয়। মার্কেটিং এর ইটালীয়ান সহকর্মীদের দেখতাম আমাদের মতোই উত্তেজিত। ইটালীর খেলার দিন, গালে ইটালীর পতাকা আঁকা, হাতেও ট্যাট্টু। খেলার পোল নিয়ে উত্তেজিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। প্রতিক্রিয়ার এই ধরনের সাথে কী সূর্যের কোন সম্বন্ধ আছে? ইটালীতেও বেশ সূর্যতাপ কড়া। তাই কী তাদের ধরনধারণ, খাওয়াদাওয়া কিছুটা আমাদের মতো!

অরানিয়া জিতে এলে তাদেরকে রাজপরিবারের সাথে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানানোর কথা ছিলো, গণসম্বর্ধনা, এটা ওটা আরো কতো কী উৎসবের পরিকল্পনা করা হলো। পশ্চিমা ভাষায় যাকে বলে ‘গালা’ পার্টি। রবিবারে ফাইন্যাল খেলায় জিতলে সোমবারে অনেকেই কাজে আসবে না মানে আসতে পারবে না, তারা সারারাত পার্টি করে কাজে আসার অবস্থায় থাকবে না। তারজন্যে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল যাতে সোমবার জরুরি বিভাগগুলো যেনো অন্তত চালু থাকে, দেশ যাতে কোলাপস না করে। কিন্তু অরানিয়াতো হেরে গেলো।

এখন কী হবে!

জনরোষ!

শুরু হলো দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড়। একজন খেলোয়াড় বছরে কতো টাকা আয় করে, সরকারি দলে খেলে কতো পাচ্ছে, কত টাকা পার সেকেন্ড তাদের আয়। টাকার অঙ্ক নেহাত কম নয় জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের। এরপর গালি, ফাইজলামি পাইছোস? এতো টাকা ট্যাক্স দেই আমরা তা দিয়ে তোরা এই খেলবি! আমাদেরকে কাঁদানোর জন্যে কেনো আমরা এতো টাকা তোদের বেতন দেবো? এর থেকে কম টাকায় আমরাতো আরো ভাল খেলতে পারি। শেষমেষতো হারই হয়। ব্যাঙ্গাত্মক আর আক্রমনাত্মক আলোচনার ঝড় আর স্রোত।

আমাদের পাশের বাড়িতেও ফাইন্যাল খেলাকে উপলক্ষ্য করে বিরাট জাঁকজমকের আয়োজন করা হয়েছিল। গান, বারবিকিউ, সন্ধ্যে থেকেই উৎসব। খেলার সময় একটু নিরিবিলি। নেদারল্যান্ডস হেরে গেলো পরে ভাবলাম যাক এবার তাহলে ঠান্ডা। ওমা, কীসের কী, দেখি একটু পর সব একসাথে আকাশে বাজি ছুঁড়ছে। আমার মন খারাপ আর তার চেয়েও বেশী মেজাজ খারাপ। বাংলাদেশ থেকে নেদারল্যান্ডস কোথাও জয়ের মুখ দেখতে পাই না, সর্বদা হারু পার্টিতেই থাকতে হয়।

আমি বললাম, এগুলো বাজি ফুটায় কোন লজ্জায়? চুল্লু ভার পানি কিধার, ডুব মারনে বোলো।

বাড়ি থেকে বললো, পাগল নাকি? হার মানে কী? দ্বিতীয় হয়েছে আর তাছাড়া বাজি কিনে ফেলেছে এখন না ফাটিয়ে কী পয়সা নষ্ট করবে নাকি?

মনে মনে ভাবলাম, তাও কথা। তারা পয়সা উসুল করুক আমি পর্দা টানিয়ে ঘুমাই।

যেখানে জয়ের আশা সেখানেই পরাজয়ের সম্ভাবনা ছিলো। দেখা গেলো পরাজয়ের সম্ভাবনা মাথায় রেখে সরকারিভাবে প্ল্যান বি-ও তৈরি করা ছিলো। জনগণের রোষ থেকে খেলোয়াড়দের বাঁচাতে রেডিও, টেলিভিশনে, পত্রিকায়, ব্লগে প্ল্যান বি একটিভ করা হলো। বিভিন্ন টকশোতে ফুটবল বোদ্ধারা এলেন নেদারল্যান্ডসের খেলার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য দিক নিয়ে প্রশংসাসূচক আলোচনা নিয়ে, পত্রিকায়ও একই সুরে সম্পাদকীয় লেখা হলো।

জয় হয় নি মানেই পরাজয় নয়। আমরা প্রথম হইনি কিন্তু দ্বিতীয় হয়েছি। বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় অবস্থান মোটেই হেলাফেলার কিছু নয়। মাত্র সতের মিলিয়ন মানুষ থেকে এমন দুর্ধর্ষ খেলোয়াড় বেরোনো সোজা কথা নয়। তারা আমাদের প্রচুর আনন্দময় সময় উপহার দিয়েছে, বিশ্বে সম্মান দিয়েছে। অতএব, হে জনগণ, দুঃখ ভুলে শান্ত হও। আবার সামনের বার, লুক ফরোয়ার্ড, উই ক্যান ডু ইট এন্ড উই উইল ডু ইট।

ব্যাপক কড়া নিরাপত্তায় খেলোয়াড়দেরকে বিমানবন্দরে রিসিভ করে একটি মাত্র সম্বর্ধনায় নিয়ে যাওয়া হলো। সম্বর্ধনার ধরনও অনেক কাটছাঁট করা হলো, নো মোর গালা। খেলোয়াড়দের সম্মান দিতে রাজপুত্র সেই সম্বর্ধনায় যোগ দিলেন। আমাস্টরডামে ক্যানালের ওপর বোটে হলো সেই সম্বর্ধনা। বাকি প্রায় সব উৎসব বাতিল করা হলো। হারু পার্টিদের জন্যে আবার এতো কী! যেসব জনতা অভিবাদন জানাতে গিয়েছিলো তারা ক্যানালের দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো প্ল্যাকার্ড হাতে। সব কিছু কমলায় ছাওয়া কিন্তু কী ভীষণ কঠোর নিরাপত্তা! টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিলো। সবাইকে বারণ করা হলো কোন ফুল অবদি খেলোয়াড়দের দিকে ছুঁড়ে মারা নিষেধ। খেলা খেলাই, তাতে কারো ক্ষতি যেনো না হয়।

তবে এবার হয়তো খেলা নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন বিরাট প্রত্যাশা ছিলো না। চোখে-পড়ার মতো প্রস্তুতি খুব সামান্যই ছিলো। পাড়া-সাজানোও কম, মিউনিসিপ্যালিটি কোন টিভি দেয়নি এতোদিন বাইরে। হয়তো ভেবেছিলো দুটো খেলা খেলে বাড়ি ফিরে আসবে তার জন্যে এতো হাঙ্গামা কে করবে? কিন্তু সেমি ফাইন্যালে পৌঁছানোর পর এখন সবাই একটু নড়ছে চড়ছে।

স্যাল উই ডু সামথিং এক্সট্রা ফর দেম? এনিথিং স্পেশাল? ক্যান উই কাউন্ট অন দেম দিজ টাইম? দে ওন্ট লেট আস ডাউন, নো? লেটস সি অরানিয়া, লেটস সি। আশা প্রত্যাশায় দুলছে পুরো জাতি। হুপ হল্যান্ড হুপ, নেদারল্যান্ডস ফুটবলের জাতীয় শ্লোগান এখন সবার মুখে মুখে ফিরছে আর ফিরছে ফেসবুকের স্ট্যাটাস হয়ে।

ব্যার্ত ভান মারওয়াইক ছিলেন দুই হাজার দশের কোচ। তিনি দুহাজার বারো অব্ধি নেদারল্যান্ডস জাতীয় ফুটবল দলকে গাইড করেছেন। গতবার বিশ্বকাপ হারার পর খুব ঠান্ডা মাথায় তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, “যারা ভাল খেলেছে তারাই জয়ী হয়েছে”। তিনি খুব সম্মানের সাথে তার হার স্বীকার করেছেন। যেমন অনেক ডাচরাই মেনে নিয়েছিলেন। বড় পর্দায় শহরের মাঝখানে খেলা দেখে অনেক দর্শকই পিনপতন নীরবতায় হেঁটে বাড়ি ফিরেছেন। এই হারের নাম দিয়েছিলো মিডিয়া “হৃদয়ভাঙ্গা হার”। যদিও কোথাও কোথাও ভাংচুর আর গ্রেফতারের ঘটনা তারপরও ঘটেছে। সবাই এই পরাজয়ে নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি। লুইস ভান গাল হলো এখনকার জাতীয় হিরো। তিনি নাকি বলেছিলেন, শ্রেষ্ঠ আট অব্ধি এবার কনফার্ম। এখন নেদারল্যান্ডস শ্রেষ্ঠ চারে আছে। তিনি তার কথার চেয়ে বেশী করেছেন। রোবেন এক সাক্ষাতকারে বলেছেন তারা দ্বিতীয় রাউন্ড পর্যন্ত এবার কনফার্ম ছিলেন। তাই এবার আমরা স্বপ্নের সীমানা ছাড়িয়ে আছি।

অর্থনৈতিক মন্দা আর অপরাধের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে বিদেশীদের ওপর ডাচেরা খুব ক্ষ্যাপা আজকাল। সেদিন যখন বাদামি, কালো খেলোয়াড়গুলো জীবন বাজি রেখে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিলো কমলা জার্সি গায়ে নেদারল্যান্ডসের পতাকার জন্যে, তখন থেকে থেকে একটা কথা মাথায় আসছিলো, এখনো কী চামড়ার রঙ দিয়ে মানুষকে বিচার করবে তোমরা? উনচল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রা যেখানে তোমরা সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলে না, সেখানেতো তারাই তোমাদের ঢাল হলো। এরপরও কী কোন অঘটন ঘটলে গালি দেবে “এই গরীব বিদেশীগুলো” বলে? যদিও তোমাদের রাজপরিবারে প্রচুর বিদেশী সদস্য আছে কয়েক পুরুষ ধরে, তারপরও গরীব বিদেশীদের প্রতি তোমাদের এই মনোভাব কবে পরিবর্তন হবে কে জানে!

সবকিছুর ওপরে এখন আসছে বুধবার ...নেদারল্যান্ডস বনাম আর্জেন্টিনা।

বুধে কী হয়? নাকি বৃহস্প্রতি তুঙ্গে উঠবে নেদারল্যান্ডস এর? সেটা দেখা যাবে সেদিনেই। কী হবে তখন? আনন্দযজ্ঞ না বিষাদবিমূঢ়তা? জানি নে, জানি নে, জানি নে...
হুপ, হল্যান্ড হুপ!

তানবীরা
৩০/০৬/২০১৪
০৮/০৭/২০১৪

পোস্টটি ১৯ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মুনীর উদ্দীন শামীম's picture


২০১০ সালে খ্রিস্টমাসের সময় আমি আইএসএস-এ গিয়েছিলাম। ডাচদের উৎসবমুখরতার কিছু নমুনা তখন দেখার সুযোগ হয়েছিল।
লেখাটা ফুটবল নিয়ে। বর্ণনায় নানা প্রসঙ্গ এসেছে। সে প্রসঙ্গের ভেতর দিয়ে স্বদেশ-বিদেশের আনন্দ-উপভোগে, অভিযোগ-অনুযোগে জেন্ডার সম্পর্ক কাঠামো যে একটা বড় নিয়ামক, এখনও, সেটি খুব চমৎকারভাবে উঠে এসেছে।
আর মোটের উপর পুরো লেখাটাই ভাল লেগেছে।
শুভেচ্ছা।

তানবীরা's picture


আপনি এন্সকেডেতে এসেছিলেন? ইউটুয়েন্টে? ক্রিসমাসের সময়তো অন্ধকার, ঠান্ডা আর বরফ। কেমন লেগেছিলো নর্থপোল? লিখে জানান Laughing out loud

ধন্যবাদ

আরাফাত শান্ত's picture


দারুন লেখা!

তানবীরা's picture


ছোট জবাব

আরাফাত শান্ত's picture


জবাব ছোট হলেও আপনার প্রতি আমাদের ভালোবাসা বিশাল।
আর লেখাতো মাইন্ডব্লোয়িং। তা নিয়ে নতুন করে কি লিখবো। এত কষ্ট করে এত বড় লেখা লিখছেন তাতেই আমরা আহলাদে আটখানা!

প্রভাষক's picture


শুভ কামনা রইলো...

তানবীরা's picture


Big smile

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


এই লেখাটা অসাধারন হইছে, লিজেন্ডারি ডাচ টোটাল ফুটবলের মতন। শুভকামনা।

তানবীরা's picture


আর শুভকামনা .।.।.।.। বন্ধু বিদায় করে দিয়েছে Sad(

১০

জ্যোতি's picture


দারুণ লেখা। কাল কমলারা হেরে গিয়ে কি করলো তাও লেখেন তাতাপু।

১১

তানবীরা's picture


গতবারতো একটা তাও রিসেপশান দিয়েছিলো নমো নমো করে। কিন্তু এবার সিদ্ধান্ত হয়েছিলো বুধবারে, কাপ জিতলেই রিসেপশান দিবে, নতুবা নয়। বুঝতেই পারছো, এবার ঘোড়ার ডিম পাবে তারা।

আজকে অফিসে অনেকেই কমলা পতাকা, ফেষ্টুন, মালা, ঝালর খুলে ফেলেছে। বাসার সাজগোজও আস্তে আস্তে খোলা শুরু করবে, এইতো। ইটস ওভার, পেইনফুল

গতকাল কী খেয়াল করেছো মাঠে "অরেঞ্জ" সাপোটার ছিল না বললেই চলে? শুধু খেলোয়ারদের পরিবার আর কর্মকর্তা বাদে? প্লেনের অফারই ছিলো আগের ম্যাচ অব্ধি দুই সপ্তাহের জন্যে? ওরা যে সেমি ফাইন্যাল পর্যন্ত কোয়ালিফাই করবে তাইতো কেউ ভাবে নাই। এর ওপরে যা হয়েছে তাই বোনাস .।.। যখন আশা করে নাই ব্যবসা হয়েছে আর যখন আশা করছে তখন লস

১২

সামছা আকিদা জাহান's picture


অনেক জানলাম। কমলাদের রাজ্যের কিছুই জানতাম না। ওদের দেশের খেলোয়ারদের লোকে গালি দেয় দেখেশান্তি পাইলাম। শুধু বাঙ্গালিরা এমন করে না ওরাও করে।

১৩

তানবীরা's picture


হেরে গেলে সবাই করে তখন সবাই বাঙালী Big smile

১৪

প্রিয়'s picture


কমলার দেশের খেলা দেখতে ভাল। আর্জেন্টিনার সাথে খেলা বাদে অন্য যে কোন টিমের সাথে খেলার সময় কমলাকে সাপোর্ট করতে আপত্তি নাই। Big smile Wink

১৫

তানবীরা's picture


আর্জেন্টিনা জেতাতে তোমাকে অভিননদন Big smile

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

তানবীরা's picture

নিজের সম্পর্কে

It is not the cloth I’m wearing …………it is the style I’m carrying

http://ratjagapakhi.blogspot.com/