বাবাকে নিয়ে
বাবা দিবসে বাবাকে শুভেচ্ছা জানানোর মতো অতটা আবেগী আমি কোনো কালেই ছিলাম না। বাবার প্রতি কতটা ভালোবাসা কাজ করতো সেটাও নির্ণয় করতে পারিনি কখনো। অন্যসবার যেমন বাবা থাকে তেমনই আমারও ছিলো। আমার বাবার প্রতি যতটা না ভালোবাসা কাজ করতো তার চেয়েও অনেক বেশি কাজ করতো শ্রদ্ধা। বাবাকে ভয় পেতাম প্রচন্ড। কক্ষনো তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পাইনি, স্পর্ধাও দেখাইনি। সে যা ই বলতো তাই ছিলো আইন আমাদের ভাই-বোনদের কাছে। সবারই অনেক মজার স্মৃতি থাকে তাদের বাবাকে নিয়ে। যেমনঃ বাবার কাঁধে চড়ে মেলায় যাওয়া, বাবার আঙ্গুল ধরে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। আমার এসব কিছুই নেই। হয়তোবা এমন স্মৃতি আমারো ছিলো যেগুলো মনেনেই। ওই যে বললাম, কতটা ভালোবাসা যে ছিলো বাবার প্রতি সেটা কখনো নির্ণয় করতে পারিনি। আর বাবারই বা কতটা ভালোবাসা ছিলো সেটাও বুঝিনি কখনো। তবে কিছু স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করে চোখের সামনে। যে স্মৃতিগুলো শুধুই বাবাময়।
১.
যখন কিন্ডারগার্ডেনে পড়তাম তখন আমার স্কুলের গেটের সাথেই লাগানো ছিলো জর্জ কোর্টের গেট। বাবা উকিল ছিলেন। আমার প্রতিদিনের রুটিন ছিলো স্কুল শেষে জর্জ কোর্টের গেটদিয়ে ভেতরে ঢুকে বাবাকে খুঁজে বের করা। তারপরে বাবার সাথে ঠাকুরের মিষ্টির দোকানে গিয়ে রসগোল্লা খাওয়া। খাওয়া শেষে বাবা আমাকে রিক্সায় তুলে দিতেন। দিয়ে বলতেন দুই হাতদিয়ে শক্ত করে রিক্সার হুড ধরে রাখতে। আমি দুই হাতে রিক্সার হুড ধরে পা দুলাতে দুলাতে বাসায় চলে আসতাম।
এই ব্যাপারকে তখন স্বাভাবিক মনে হোতো। কিন্তু আজ বুঝি কতটা ভালোবাসা বা আবেগ কাজ করতো প্রতিদিনের এই ঘটনার মাঝে।
সরি আব্বা আপনার সেই আবেগটা আমি বুঝতে পারিনি।
২.
যখন কিন্ডারগার্ডেন পার করে জিলা স্কুলে ভর্তি হলাম তারপরে প্রথম যেদিন স্কুলের টিফিনের ফাঁকে বার-লাইব্রেরীতে গেলাম আব্বার কাছে সেইদিন তিনি সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, "আমার ছোটো ছেলে, জিলা স্কুলে পড়ে"। সেদিন মনেহয়েছিলো জিলা স্কুলে পড়া আর এমন কি ব্যাপার?
কিন্তু আজ বুঝি কতটা গর্ব নিয়ে তিনি সেদিন তাঁর ছেলেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।
সরি আব্বা আপনার সেই আবেগটা আমি সেদিন বুঝতে পারিনি।
৩.
এস.এস.সি পরীক্ষার আগে আব্বার মাথায় সেই টেনশন। ওমুকের ছেলে টেস্টে তোর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে। তমুকের মেয়ে সারাদিন পড়ে। আমি কেন পড়ি না? আমি কেন খালি খেলা খেলা করি? ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপরে যখন এস.এস.সি পাশ করলাম অমুক তমুকের ছেলে মেয়ের চেয়ে ভালো রেজাল্ট নিয়ে তখন আব্বার খুশি দেখে কে?? সে বুক ফুলিয়ে সবাইকে আমার রেজাল্টের কথা বলে বেড়াতো।
কিন্তু তখনো বুঝিনি ভালোবাসতেন বলেই রেজাল্ট নিয়ে এতো চিন্তিত ছিলেন। এখন বুঝি।
সরি আব্বা আপনার সেই আবেগটা আমি সেদিন বুঝতে পারিনি।
৪.
যখন ঢাকা চলে আসলাম। ভার্সিটিতে পড়ছি, তখন দুই দিন পর পরই তিনি আমাকে কল করতেন। কেমন আছি জিজ্ঞাসা করেই বলতেন নাও তোমার মায়ের সাথে কথা বলো। আমি প্রথম প্রথম ভাবতাম হয়তো মা কল করতে বলেছে তাই কল করেই মা'কে ধরিয়ে দিয়েছেন। পরে যখন এই ব্যাপারটা নিয়মিত ঘটতে থাকলো তখন ভাবলাম হয়তো আমার সাথে কথা বলতে চান না। তাই এড়িয়ে যান। এইনিয়ে মাকে অনেকবার বলেছি, অনেকবার আব্বাকেও বলেছি। কিন্তু তিনি কোনো উত্তর দেননি।
এখন কারণটা নিজেই বের করেছি। আব্বা জানতেন যে আমি মায়ের সাথে বেশি ফ্রি। আমার চাহিদাগুলোর কথা আমি শুধুমাত্র মা'কেই বলবো। তাই সেই চাহিদার কথাগুলো জানার জন্য তিনি সুযোগ করে দিতেন।
সরি আব্বা আপনার সেই আবেগটা আমি সেদিন বুঝতে পারিনি।
৫.
ছোটোবেলা থেকেই আমার ঠান্ডার সমস্যা। মাথায় বৃষ্টির পানি পরলেই নাক বন্ধ হয়ে যেতো। ঢাকায় আসার পর থেকে প্রতি বছর আব্বা আমাকে ছাতা কেনার টাকা দিতেন আর আমি প্রতিবারই সেইটা খেয়ে ফেলতাম। এমনো হয়েছে এক বর্ষায় তিনবার টাকা নিয়ে খেয়ে ফেলেছি। কিন্তু প্রতিবারই যেন কিভাবে তিনি বুঝতে পারতেন!!
আরেক কাহিনী হত শীতকালে। ঠান্ডার সমস্যার জন্য মাফলার কেনার টাকা দিতেন। আর আমি সেইটা দিয়ে হেব্বী স্টাইলিস্ট একটা কানটুপি কিনে আনতাম। যতই বলতেন টনসিলের সমস্যা সবসময় গলা পেঁচিয়ে রাখবা। তবুও কে শোনে কার কথা।
প্রতি বছর এই মাফলার আর ছাতা নিয়ে আমাকে বলতে বলতে অস্থির করে ফেলতেন। তখন অনেক বিরক্ত হতাম। ভাবতাম আমি বড় হইছি। এত্তো জোড় করার কি আছে। কিন্তু এগুলোর মাঝেই যে অনেক ভালোবাসা আর কেয়ার ছিলো তা বুঝিনি।
সরি আব্বা আপনার সেই আবেগটা আমি সেদিন বুঝতে পারিনি।
৬.
আব্বা যখন অসুস্থ। তখন আমি চাকরী করি। প্রতিমাসে বাসায় কিছু টাকা পাঠাতাম। আর যখন ফোন করে বলতাম টাকা পাঠানোর কথা তখন তিনি খুবই চিন্তিত হয়ে পরতেন। বলতেন কতো আর কামাই করো? বাসায় কি টাকার দরকার? তোমার কষ্ট হবেনা তো?
এই প্রশ্নগুলোর মর্ম সেদিন বুঝিনি। কতটা ভালোবাসা যে এগুলোতে ছিলো তাও বুঝিনি।
আসলে সত্যি বলতে কি, আমি জীবনেও আমার বাবার ভালোবাসার পালসটাই ধরতে পারিনি। তাঁর প্রতিটা কথা, প্রতিটা প্রশ্ন আমার কানে এখনো বাজে। কিন্তু কিছুই করার নেই। সে এখন পরপারে।
বাবা যেদিন মারা যান, সেদিন থেকে তাঁর দাফনের আগ পর্যন্ত আমি এক ফোঁটা চোখের পাইও ফেলিনি। সব ভাই-বোনেরা এবং মা আমাকে ধরে কেঁদেছে। আমি তাদেরকে স্বান্তনা দিয়েছি। কিন্তু চোখের পানি ফেলিনি।
কিন্তু যখন কবরে মাটি দেওয়া হয়ে গেলো, সবাই একে একে চলে যেতে থাকলো তখন শুধু মনেহয়েছে, "আব্বাকে একা রেখে যাচ্ছি!! তিনি এখানে কিভাবে থাকবেন? আমি কি আর কোনো দিনও আব্বাকে দেখতে পাবোনা? আর কক্ষনো কেউ আমায় মনা বলে ডাকবে না!!"
তখন আমি আর চোখের পানি আটকাতে পারিনি।
একটাই আফসোস, তাকে পুরোপুরি দাফনের পরই বুঝতে পারলাম কত্তো ভালোবাসতাম আব্বাকে। যেই মানুষটার ভালোবাসাকে কক্ষনো খেয়ালই করিনি, সেই মানুষটা আজীবন বটবৃক্ষের মতো আমাদের জন্য ছায়া নিশ্চিত করে গিয়েছেন।
আজকে যখন তাঁর ভালোবাসাগুলো বুঝি তখন বুক ফেটে কান্না আসে। তখন চিতকার করে বলতে ইচ্ছা করে, সরি!! আব্বা আপনার কোনো আবেগই আমি কোনোদিন বুঝতে পারিনি। আমায় ক্ষমা করবেন। শুধু মনেহয় কতদিন দেখিনা আব্বাকে। কতদিন তাঁর মুখের ডাক শুনিনা।
এই কষ্টের কোনো তুলনা হয় না। এটাকে শব্দে বাধাও যায় না। শুধু অনুভব করা যায়।
আমি বাবাকে হারিয়ে বুঝেছি বাবা কি ছিলেন। যাদের বাবা আছে তাদের প্রতি একটাই অনুরোধ বাবাকে কষ্ট দিয়েন না, তাঁর কথায় বিরক্ত হয়েন না। না হলে আমার মতো আসসোস করবেন। আমার মতো আফসোস যেন কাউকে করতে না হয়।
বাবা তো বাবাই, বটগাছের মতো। তারাই একমাত্র যারা নীরবে ভালোবাসে। পৃথিবীর সকল বাবারা ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক। অশেষ ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও শুভকামনা বাবাদের জন্য।
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লেখা। বাবাকে নিয়ে আপনার ভালবাসা সত্যিই মন ছুঁয়ে গেল। আমরা বেশির ভাগ সময় "মা" কে নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বাবা'র দিকে অতোটা মনোযোগী হইনা। বাবারা হয়তো সেটাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। আপনার লেখা পড়ে মনে হল এটা করা উচিত না।
আমার নিজেরও বোধোদয় হয়েছে। কিন্তু অনেক দেরীতে। আপনি অনেক সৌভাগ্যবতী যে আপনার আমার চেয়ে অনেক আগেই হল।
ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
হৃদয়স্পর্শী লেখা। আমি মায়ের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে পারি কিন্তু বাবার সাথে পারি না। সুন্দর একটা আবেগময় লেখার জন্য থ্যাঙ্কু ।
ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
ভালো থাকুক বাবারা।
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লেখা।
নেক ধন্যবাদ আপু। আপনার প্রতিক্রিয়াগুলো সবসময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়।
ভালো থাকবেন।
সুইট!
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা..
অনেক দিন পর লিখলেন। ভালো আছেন তো?
অফিসিয়াল কাজে একটু বেশিই ব্যাস্ত আছি। তাই আগেরমতো আসা হয়না।
একটু গুছিয়ে আবার নিয়মিত হয়ে যাবো।
ভালো আছি। আপনিও ভালো থাকবেন সবসময়।
মন্তব্য করুন