ইউজার লগইন

বাংলাদেশি ডায়াস্পোরা

ডায়াস্পোরা শব্দটা শুনতেই কেমন বুকের মধ্য মোচড় দিয়ে ওঠে। ভাসিলি কান্দিনস্কির কয়েকটা বিমুর্ত পেইন্টিংয়ের কথা মনে পড়ে। জন্মভূমি রাশিয়া ছেড়ে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানেই থিতু হওয়ার পর তার ছবি আঁকার দর্শনটাই কিভাবে পাল্টে গিয়েছিলো। কিংবা তুরস্কের বংশোদ্ভুত জার্মান ফাতিহ আকিনের সিনেমা যেখানে এক নৈরাশ্যবাদী মন্থর জীবনধারা দেখান তিনি। সব অসামাজিক মানুষের বিমূর্ত জীবন। তবে এই উত্তর কাঠামোবাদের সময়ে ডায়াস্পোরা শব্দটা কেবল বিমূর্ত শিল্পের মতো অস্থিরতায় ভোগেনা। নানারকমের রাজনৈতিক রহস্য নিয়ে ডায়াস্পোরা মানুষেরা তাদের জীবনের ব্যপ্তি ঘটায়।

বাংলাদেশি ডায়াস্পোরা নিয়ে যেমন সাধারণ ধারণা আছে যে, সিলেট এবং নোয়াখালীর এই দুই এলাকার বাংলাদেশি মানুষরাই নানাদেশে তাদের বংশ বিস্তার করেছে। পাশ্চাত্যে এক সুবিস্তৃত ডায়াস্পোরা জনপদ তৈরি হয়েছে প্রধানত এই দুই অঞ্চলের মানুষদের মাঝ থেকে। সারা ইউনাইটেড কিংডম জুড়েই সিলেটি শেকড়ওয়ালা মানুষ দাপটের সাথে বসবাস করে। আর নোয়াখালীতে শেকড় এমন মানুষদের দেখতে পাওয়া যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

আমি বর্তমানে কাজের তাগীদে ইংল্যান্ডে অবস্থান করছি তাই নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি এইসব জেনারেলাইজেশনে যে সত্য নাই তা নয়। সিলেটে এখনো আত্মীয়স্বজনদের মাসিক খরচ পাঠাতে হয় এমন অভিবাসীর সংখ্যা অনেক। আমার এই লেখার উপপাদ্য যদিও সংখ্যা গুনে অভিবাসী বা ডায়াস্পোরা খুঁজে বের করা নয়। আমার আগ্রহের জায়গা ডায়াস্পোরা জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক আগ্রহের শেকড় খোঁজা।

দেশ রুপান্তর পত্রিকা থেকে লেখার সুপারিশ পাওয়ার পর কথা বললাম যুক্তরাজ্য আর আয়ারল্যান্ডে বাংলা সিনেমার একমাত্র পরিবেশক রন্টি চৌধুরীর সাথে। তার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এক কথায় বলে দেয়া যায় বাংলাদেশে যেই সিনেমা নিয়ে দেশের মানুষ হুজুগে মাতে অথবা এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কের জমানার ভাষায় যেই সিনেমার প্রচারণা ভাইরাল হয় তার গ্রহণযোগ্যতা ইউরোপেও তৈরি হয়। মানুষ বুঝে হোক না বুঝে হোক সিনেমা থিয়েটারগুলোতে ভীর করে। দেশে যে সিনেমার খুব বেশি কদর হয়না বাঙালি দর্শকদের কাছে এই অঞ্চলেও তার কদর নেই।

এইখানে ডায়াস্পোরার পরিবর্ধন হয়েছে নয়া জমানার উপলব্ধিতে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয় পুরোদমে। একসময় এক দেশের মানুষ মূলতঃ ভাগ্যান্বেষণে আরেক দেশে পাড়ি দিতো। তার নতুন আবাস গড়ে তোলার সংগ্রাম করতো। অভিবাসী হয়ে তার নিজের সংস্কৃতির সাথে নতুন দেশের সাংস্কৃতিক গতিময়তাকে ধারণ করার চেষ্টা থাকতো। এই পুরোনো ডায়াস্পোরিক চিন্তার প্রভাব এখনো বেশ ভালোমতোই দেখতে পাওয়া যায় প্রবাস জীবনে। যেমন যুক্তরাজ্যে প্রায় এক লাখের উপর ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ রয়েছে, এইসব রেস্তোরাঁর অধিকাংশ মালিকের জাতিসত্ত্বার তারা বৃটিশ বাংলাদেশি। যাদের বেশিরভাগের শেকড় আবার সিলেট অঞ্চলে। এই রেস্তোরাঁসমূহে ভারতীয় ও বাংলাদেশের সীমিত তালিকার খাবারের বাইরেও মদ বিক্রি করা হয়। ভাগ্যান্বেষণের সংগ্রামের সাথে বৃটিশ বাংলাদেশিরা ঠিক নিজেদের অভিযোজন ঘটিয়ে ফেলেছে।

আমার পরিচিত অনেক বাংলাদেশের বাঙালি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা কিংবা ইউরোপে অভিবাসী হয়েছে উন্নত জীবনের খোঁজে। তাদের সাংস্কৃতিক চেতনায় যেমন রবীন্দ্রনাথ আছে তার সাথে যুক্ত হয়েছে পাশ্চাত্যের নানা উপাদানও। দর্শনগত ভিত্তি থেকে যাদের উদারপন্থী সমন্বয়বাদি বলা যেতে পারে। তবে গতোশতকের শেষ দশক থেকে কেবল বাংলাদেশ নয় আধুনিক স্নায়ুযুদ্ধ শেষের পর সারা পৃথিবী জুড়েই অভিবাসনে রাজনৈতিক বিষয়ের প্রভাব বেড়েছে। বিশ্বজুড়েই রাজনৈতিক খবরদারি আর বিরুদ্ধমতের উপর অসহিষ্ণুতা বেড়ে যাওয়ায় উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসনের প্রবণতা লক্ষণীয়।

আর রাজনৈতিক কারণে যেই ডায়াস্পোরা বৃক্ষের বীজ লতায় পাতায় বেড়ে চলেছে তার সাংস্কৃতিক অবস্থান বেশ সংশয়ী। এই জনগোষ্ঠী তার শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা লুকোতে পারেনা। তার স্মৃতিপটে দেশের সাংস্কৃতিক দিনযাপনের সব মেমোরাণ্ডাম গভীর দাগে তোলা থাকে। যুক্তরাজ্য কিংবা ইউরোপের যেকোনো রাষ্ট্রে অথবা যুক্তরাষ্ট্রে দেশের সব রাজনৈতিক দলের শাখা প্রশাখা গড়ে ওঠে। বাঙালি ডায়াস্পোরা শহীদ মিনার তৈরি করে নিয়ম করে একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। পয়লা বৈশাখে না হলেও একটু উষ্ণ আবহাওয়া পেলেই বৈশাখি মেলার আয়োজন করে।

প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীদের বাংলা কবিতা লিখতে দেখা যায়। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে প্রথম প্রজন্মকে ডায়াস্পোরার ছকে ফেলা যাবে কীনা। আমি দেশের অভিবাসী সাংস্কৃতিক প্রজন্মকে দেখি নানারূপে। তারা নিজেরা নিয়ম করে নানা সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশনে বাঙালি চেতনাকে ধারণ করলেও, দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকেই নতুন পুঁতির মালা গাঁথতে দেখি। যেকারণে ডায়াস্পোরার যেই নিঃসঙ্গতার আকুতি তাতে নতুন পরিভাষা যুক্ত হতে থাকে ক্রমে।

প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীরা উত্তর আমেরিকায় ফোবানা তৈরি করেছিলো তাদের সাংস্কৃতিক আকাঙ্খাকে লালন পালনের জন্য। কিন্তু দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের ডায়াস্পোরিক হাওয়ায় সেই সংগঠন আজ মৃতপ্রায়। নতুন কেউ এলে খানিক চাঙা হয়ে আবার ক্লান্ত হয়। তবে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের কাছে তার গুরুত্ব কমে গেছে। এই ডায়াস্পোরা সম্প্রদায় সোশ্যাল নেটওয়ার্কের কারণে এখন দেশীয় সংস্কৃতির খোঁজখবর রাখলেও তাকে বিশ্বমানের সাথে তুল্যমূল্যে বিচার করতে শুরু করে। তারা ভাষা পরিবর্তনের পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গিতেও আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয়কেও ডায়াস্পোরার অন্তর্গত করে ফেলেছে।

সিলেটের সাদিক আহমেদ কিংবা মনসুর আলী বাংলাদেশকে নিয়ে সিনেমা বানালেও তাতে পাশ্চাত্যের নিজস্ব দেখার ভঙ্গীটা স্পষ্ট। কমিউনিটির উৎসবগুলোতে নিয়মিত বিদেশী উচ্চারণে বাংলা গান গাইতে শোনা যায় দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের অভিবাসীদের। তবে আরেকটা বিষয় না বলে লেখা শেষ করতে পারছিনা। ডায়াস্পোরা সংস্কৃতির নতুন আশ্রয় হিপহপে কিন্তু এখন ডায়াস্পোরা বাঙালিদের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। তারা ভিনদেশি এবং বাংলা দুই ভাষাতেই তাদের গান বেঁধে চলেছে।

পোস্টটি ২ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

ভাস্কর's picture

নিজের সম্পর্কে

মনে প্রাণে আমিও হয়েছি ইকারুস, সূর্য তপ্ত দিনে গলে যায় আমার হৃদয়...