বাংলা RAPএর ব্যাটেলফিল্ডে স্বাগতম।
আমার কৈশোর ছিলো সাইকাডেলিক রক আর হেভি মেটাল মিউজিকের আবহে নিমজ্জিত। আশির দশকে সামরিক জান্তা আর স্বৈরশাসকের নিপীড়ন আর নিষ্পেষণকালের দোহাই দিবোনা। কিন্তু রাষ্ট্রকে যদি একটা এস্টাবলিশমেন্ট ধরি তাহলে তার সকল রুচিগত ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নিজের পছন্দ অপছন্দকে অগ্রাধিকার দেয়ার আকাঙ্খাতো ছিলোই। সেইসময়টা পুরোপুরিভাবে প্রতিবাদি মানসিকতার কাছে সমর্পিত ছিলো। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই আশির দশক জুড়ে। তবে গ্লোবাল স্পেকট্রামে যেইসব সাংস্কৃতিক উপাদান বা এক্সপ্রেশন জনপ্রিয় হয় তার ঢেউ বাংলাদেশ অথবা আরো বিস্তৃত করে বললে ভারতীয় উপমহাদেশের তটে আছড়ে পড়ে এক দশক পরে। পশ্চিমে তখন সাইকাডেলিক রক, অল্টারনেটিভ রক কিংবা হেভি মেটাল সংগীতের ধারা জনপ্রিয়তার অংশিদার হয়ে গেছে। মূলধারাকে প্রশ্ন করতে অন্য একটা সাংগীতিক এক্সপ্রেশন তখন প্রতিবাদের স্রোত তৈরির রসদ জোগাচ্ছে। মার্কিন মুলুকে থাকা আফ্রো আমেরিকান জনগোষ্ঠীর তরুণরা এক অন্যরকম জীবনধারণের কথা বলতে শুরু করেছে বর্ণবাদ আর সাদার সুপ্রিমেসিকে নাকচের মধ্য দিয়ে। তাকে বেশিরভাগ ক্রিটিকরা হিপ হপ সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করতে শুরু করে। এই সংস্কৃতির একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিলো সংস্কারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জীবনকে উপভোগ।
বাংলাদেশের মানুষ তখন হিপ হপ শুনতো না এমন নয়। তখনো হিপ হপ সংস্কৃতি সেই অর্থে দ্যোতনা তৈরি করে নাই। এমসি হ্যামার কিংবা ডিজে কুলদের বীট নির্ভর উপস্থাপন শুনতাম। কিন্তু ঐভাবে আকৃষ্ট হয়ে শোনা শুরু হয়নি। আর সংস্কৃতিগত ধারণা থেকেই ঐ ঘরানার হিপহপকে ঠিক নিজের মনে হতোনা।
হিপহপ সংস্কৃতির বেড়ে ওঠা ডায়াস্পোরা আর তার ডিস্টোপিয়ান আগ্রহ থেকে। অভিবাসনের মধ্য দিয়ে যে নৈসঙ্গ তৈরি হয় তার প্রকাশ ঘটে বিমূর্তকরণে; সামাজিক রুচিবোধকে মেনে না নেয়ার সে এক তীব্র বহিঃপ্রকাশ। বিংশ শতকের প্রায় শেষভাগে পশ্চিমে আফ্রো আমেরিকান বা আফ্রো ব্রিটিশদের মতো, ইন্দো আমেরিকান অথবা ইন্দো ইউরোপিয়ান তরুণরাও হিপহপ করতে শুরু করে আর জনপ্রিয়তার হাতছানি দেখতে পায়। তাদের একজনের নাম না বললেই নয় সেই অ্যাপাচে ইন্ডিয়ান পশ্চিমা ঘরানার RAP কিংবা হিপহপের সাথে পাঞ্জাবী ইন্ডিয়ান মিউজিকের ফিউশন করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর প্রভাবে কয়েকবছর পর আশরাফ বাবু, পার্থ বড়ুয়া আর আজম বাবু এই তিনজন একটা অ্যালবাম রেকর্ড করে। ত্রিরত্নের খ্যাপা নামের সেই অ্যালবাম শহুরে তরুণদের একটা সুনির্দিষ্ট অংশের মাঝে ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। তাদের গানের মূল বিষয় ছিলো পুরোনোকে অস্বীকার আর ব্যবচ্ছেদ করে তার অপ্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়া। কিন্তু এই হিপহপ অ্যালবাম কোনো আন্দোলনের অংশ ছিলোনা। তিন তরুণ সংগ্রামী ব্যান্ড মিউজিশিয়ান ভারতীয় বংশোদ্ভুত ইংলিশ অ্যাপাচি ইন্ডিয়ানকে অনুসরণ করে দেখতে চেয়েছিলেন হয়তো। যদি ক্যাসেটের বিক্রিবাট্টা ভালো হতো তাহলে আবার কিছু করা যাবে। কিন্তু তাদের সেই আশার গুড়ে বালি দিয়ে প্রজেক্ট সেখানেই সমাপ্ত হয়।
নব্বইয়ের দশকে মার্কিনী সামাজিক সাংস্কৃতিক কারণেই হিপহপ কিংবা RAP সব বর্ণের তরুণ - তরুনীদের আকৃষ্ট করতে শুরু করে। কেবল আফ্রো আমেরিকান নয় নেটিভ আমেরিকানরাও রাইমিং শুরু করে ভালো ভাবেই। এখানে বলে নেয়া ভালো RAP কোনো শব্দ নয়, এর মূল অর্থ Rhyme and Poetry। ছন্দোবদ্ধ করে কবিতা আবৃত্তির মতো করে গান গাওয়া। এই সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বিনোদনদাতারা। শুরুর সময়টাতে হিপহপাররা দর্শকদের সাথে কথা বলে বীট তৈরি করে যোগাযোগ করতো। তারা মূলতঃ অনুষ্ঠান পরিচালকের ভূমিকা নিতো। এই কারণে অনেক RAPPER। তাদের নামের আগে ইংরেজি বর্ণ এমসি ব্যবহার করতো। বাংলাদেশেও শহুরে তরুণদের একটা গ্রুপ নিজেদের ভেতর RAP চর্চা করতো, আর তারা নিজেদের নাম পাল্টে এমসি অমুক এমসি তমুক নামে পরিচিত হতে শুরু করলো।
পশ্চিমা যেকোনো বিষয়ের চর্চা যেভাবে বাংলাদেশে শুরু হয় এই ক্ষেত্রেও তাই ঘটলো। রাষ্ট্রের উচ্চবিত্ত - উচ্চমধ্যবিত্ত শহুরে শিক্ষিত তরুণরাই পুরোধা হলো। তাদের অনুপ্রেরণায় কিছু শহুরে মধ্যবিত্তরাও যুক্ত হলো। পশ্চিমে যেমন বিকল্প ধারা হিসাবে যেকোনো সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশন শুরু হয়েছে প্রতিবাদি বা পাল্টানোর মানসিকতা নিয়ে; অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতে বসা মানুষ অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য চিৎকার করেছে অথবা ছন্দ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে অস্তিত্বওয়ালারাই বরং তাদের ঘোষণা আরো পোক্ত করে এইসব নতুন ঘরানাকে অভিযোজন করে। বাংলাদেশি এমসিরা মূলতঃ ঘরে বসে ছন্দ তৈরি করা তরুণ হলেও শুরুতে তারা পাশ্চাত্যের মতো এলাকার দখলের ঘোষণা দিয়ে গালাগালি সমৃদ্ধ কিছু একটা করতো। বেশিরভাগ ইংরেজি মাধ্যমে পড়া আরাম আয়েশে জীবন কাটানো তরুণদের কণ্ঠে এইসব গালিগালাজ খুবেকটা জনপ্রিয় হয়নি প্রথম দশকের শেষ আর দ্বিতীয় দশকের শুরুতে। কিন্তু সরকারি কলোনিতে বড় হওয়া একদল ছেলে নিজেদের আপটাউন লোকালজ বলে যখন RAP করতে শুরু করলো তারা সীমিত পরিসরে হিপহপ চর্চারত ধনিক শ্রেণীর জন্য হুমকি হিসাবে আবির্ভূত হলো।
বাংলাদেশে হিপহপের পুরোধারা নিজেদের পরিচয় দিতো দেশি এমসি হিসাবে। আপটাউন লোকালজদের নাম ছিলো বর্ণময় আবার খানিকটা ডার্ক। তবে এরমধ্য দিয়েই হিপহপ সংস্কৃতির বাংলাদেশ চ্যাপ্টার পূর্ণতা পেলো। যদিও উপস্থাপন কিংবা সুরে পশ্চিমের অনুবাদ করতো উভয়পক্ষই। নিজস্বতা বলে কিছু ছিলোনা হিপহপারদের। অন্য রক কিংবা মেটাল মিউজিকের মতোই, অনুকরণপ্রিয় হিসাবেই বাংলাদেশি হিপহপারদের উত্থান।
কিন্তু কেউকেউ যেনো অন্যরকম ভাবে। তাউরা সাফা নাম নিয়ে পরিচিত হওয়া এক RAPPER তেমনি একজন। পুরান ঢাকায় একেবারে স্ট্রিট কালচারে বড় হওয়া সাফা তার অস্তিত্ব জানান দিলো দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝিতে। হিপহপাররা জেগে উঠলো। দেশের বিভিন্ন কোনে RAP করতে শুরু করলো তরুণরা। এইসময়টায় সিলেট, ফরিদপুর, কুমিল্লা এমনকি কক্সবাজারেও নতুন হিপহপাররা তাদের RAP ইউটিউবে প্রকাশ করতে শুরু করলো। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করে তারা যেনো নিজেদের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে ব্যস্ত হলো।
আমি আগে RAP বা হিপহপকে মিউজিকের ঘরানা হিসাবে গুরুত্ব দেই নাই। কিন্তু জালালি সেট বলে একটা প্রজেক্টের গান শুনে থমকে গিয়েছিলাম ২০১৬এর গোড়ার দিকে। এই প্রজেক্টের নেতৃত্ব অথবা মূল প্রণেতা ছিলো সেই শুরুর জমানার একজন, যে নিজেকে এমসি মাগজ বলে পরিচয় দিতো। উচ্চবিত্ত পরিবারের ইংরেজি মাধ্যমে পড়া এই এমসি সমাজের নানাস্তরের আরো চারজন হিপহপারের সাথে মিলে বেশকিছু ট্র্যাক তৈরি করলো। এইবার যেহেতু RAP এর একটা ভূমি তৈরি ছিলো তাই গালাগালাজ নিয়ে সমস্যা হলোনা। কিন্তু তারা নাড়া দিলো সমাজের প্রচলিত নানা সংস্কার নিয়ে। দলবাজি না করেও কেমন রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরি করা যায় এস্টাবলিশমেন্টকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তার নমুনা হিসাবে একএকেকটা ট্র্যাক যেনো নিজের সাথে পাল্লা দিলো।
পরবর্তীতে যারা হিপহপ সংস্কৃতি অথবা RAP তৈরির চেষ্টা করছে তাদের অনেকে এই সংস্কৃতিকে জড়িয়ে নিয়েছে নিজেদের জীবনবোধে। আবার অনেকে এটাকে কেবল একটা এক্সপ্রেশন হিসাবে দেখেছে। তবে একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায় বাংলারেশের RAPPERরা এখন কেবল প্রতিবাদ কিংবা পরিবর্তনের কথাই বলেনা, তাদের ছন্দোবদ্ধতায় কবিতা তৈরি হয়। তাদের শরীরি ভঙ্গীতেও দেশি ভাব দেখা যায়। দেশি পুঁথিপাঠ কিংবা কবির লড়াইয়ের ধরনে তারা ব্যাটল রাইম করে। সম্ভবতঃ দেশের অনেক হিপহপারই নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়ে নিজস্ব ধরন তৈরি করেছে। পশ্চিমের অনুকরণ না করে, অনুগত না থেকে কিভাবে একটা সাংস্কৃতিক এক্সপ্রেশনকে নিজেদের করে নেয়া যায় তার নিদর্শন হিসাবে আপনারা বাংলাদেশি হিপহপার কিংবা RAPPERদের কথা বলতে পারেন নিঃসংশয়ে।
মন্তব্য করুন