মিডিয়া ভাবনা: আমার দেশ ও দিগন্ত টিভি
১.
মাহমুদুর রহমানকে পছন্দ করার আমার তেমন কোনো কারণ নাই। পেশাগত কারণে তাকে আমি চিনি বহুদিন ধরে। তাঁর কান্ডকীর্তি লিখে শেষ করা যাবে না। যে লোকটির পত্রিকায় লেখা হয়, কেন হিন্দুরা পদোন্নতি পায়-তার তাকে পছন্দ করার মতো কিছু থাকে না। মতায় থাকতে এই লোকটি কীরকম বাড়াবাড়ি করেছে সেটি অনেকেই হয়তো জানেন। এই লোকটির সবচেয়ে বড় সখ্যতা জামায়াতের সাথে।
তারপরেও যেভাবে আমার দেশ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হলো এবং গ্রেপ্তার করা হলো মাহমুদুর রহমানকে-সেটি একেবারেই সমর্থন করার মতো নয়। মাহমুদুর রহমান মামলা করতে পছন্দ করেন। সেই মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধেই এখন একটির পর একটি মামলা হচ্ছে। তবে আইন নিজস্ব গতিতে চলছে তা বলা যাবে না।
২.
ইটিভি যখন বন্ধ করা হয়েছিল তখনও আইন নিজস্ব গতিতে চলেছিল তা বলা যাচ্ছে না। খালেদা জিয়া সে সময় পায়ের ব্যাথায় ভুগছিলেন। সৌদি আরব থেকে অপারেশন করাতে হয়েছিল। নির্বাচনের সময় একটু পা টেনে হাঁটতেন। ইটিভি খালেদা জিয়ার সেই পা দেখিয়েছিল। এটা ছিল ইটিভির বড় অপরাধ। সায়মন ড্রিংকে অপমান করে দেশ থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল।
৩.
এতদিন ধরে শুনে আসছি, সরকার চাইলেই ইলেকট্রনিক মিডিয়া বন্ধ করে দিতে পারে কিন্তু প্রিন্ট মিডিয়া পারে না। প্রথম তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান শাহাবুদ্দিন আহমেদ সেই আইনটি প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। আর তাই আমার দেশ বন্ধ করতে সরকারকে আইনগত জটিলতা সৃষ্টি করতে হলো। এখানে ব্যক্তি মাহমুদুর রহমান আমার কাছে বিবেচ্য নয়, কিন্তু সংকেতটা ভাল না। অনেকটা আজরাইলের পথ চিনে নেওয়ার মতো। তবে এই সরকার মাহমুদুর রহমানকে হিরো বানিয়ে দিলো, যা লোকটির প্রাপ্য ছিল না।
৪.
সেদিক থেকে অনেক বুদ্ধিমান দিগন্তওয়ালারা। দিগন্ত মানেই হলো জামায়াত। সুশীল মতামত হচ্ছে, সরকারের উচিৎ না কোনো মিডিয়াই বন্ধ করা। কিন্তু দিগন্ত বন্ধ হলে আমার ভিতরের আমি অখুশী হবো না। কারণ এরা কেউ বেকার হবে না। দল থেকেই তাদের নিয়মিত অর্থ যে কোনো ভাবেই হোক দেয়া হবে।
কিন্তু দিগন্ত টিভি বন্ধ হবে না। দেশ টিভিতে আওয়ামী লীগের নেতারা কিন্তু যেতে চান না। কারণ এর মালিক সাবের চৌধুরী। দলের নেত্রী তাকে পছন্দ করেন না, এই কথা সবাই জানেন বলেই কেউ আর দেশ টিভিতে যান না। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দেশ টিভিতে যান না, কিন্তু দিগন্ত টিভিতে যান। এরা বাইরে যুদ্ধাপরাধী বলে গলা ফাটিয়ে ফেলেন, তারপর গরম পানিতে গলা গার্গেল করে যান দিগন্ত টিভিতে।
সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত আর মহিউদ্দিন খান আলমগীর দিগন্ত টিভির নিয়মিত বক্তা। এর বাইরে আছেন একদল কড়া আওয়ামী সাংবাদিক।
সাংবাদিকদের সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবেই দুই ভাগ। একদল বিএনপি পন্থী, আরেকদল আওয়ামী পন্থী। এ কারণে ঢাকায় সাংবাদিক ইউনিয়নও দুটি। দেশের সব সাংবাদিক ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নও দুটি।
এক গ্রুপের নেতা অবজারভারের সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল সহ আরও অনেকে। অন্য গ্রুপে নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, ভোয়ার সাবেক সংবাদদাতা গিয়াস কামাল চৌধুরী, প্রেস ক্লাবের সভাপতি শওকত মাহমুদ, রুহুল আমিন গাজী, এরা।
প্রেস ক্লাবের রাজনীতিতে এই দুই গ্রুপের মধ্যে সাপে-নেউলে ধরণের সম্পর্ক থাকলেও একটা জায়গায় তারা আবার সবাই এক। আর তা হলো দিগন্ত টেলিভিশনে মুখ দেখানো।
আওয়ামী সাংবাদিকদের প্রধান নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। তিনি নিয়মিত যান দিগন্ত টিভিতে। এপির ব্যুরো প্রধান ফরিদ আহমেদ, যুগান্তরের উপ-সম্পাদক সাইফুল আলম। এরা দুজনেই কড়া আওয়ামী পন্থী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। এই পরিচয়ে ইউনিয়ন করেন, নির্বাচনেও দাঁড়ান। এই দুজনই বাইরে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে বড় বড় কথা বলেন, কিন্তু একটু পরেই হাজির হন দিগন্ত টেলিভিশনে। বিনিময়ে পান এক হাজার টাকা।
দিগন্ত টিভির প্রয়োজন আওয়ামী লীগের কাছে একধরণের গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া। সেই কাজটি তারা করেন এসব লোকদের ডেকে এনে। খরচও বেশি না। আর কড়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা খুব অল্পতেই বিকিয়ে যাচ্ছেন এভাবে। মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে এই গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে আসে আওয়ামীপন্থী এইসব সাংবাদিকরা।
৫.
দিগন্তকে আমি মিডিয়া বলে মনে করি না। এইটা জামায়াতের আরেকটি সংস্থা। নামি দিয়েছে মিডিয়া। আমি জামায়াতের কোনো অস্তিত্ব এই দেশে দেখতে চাই না।
সিনিয়র সাংবাদিকরা যখন এমনটি করেন তখন প্রশ্ন জাগে দেশের বিবেকের ভবিষ্যত কি? জুনিয়র যারা তারা কী শিখবে? সাংবাদিকতা মানে দলা-দলি?
আজ-কাল এক শ্রেণীর সংবাদকর্মীর মধ্যে ক্ষমতাসীন দল দেখে মিডিয়ায় চাকুরী খোঁজার প্রবণতা তৈরী হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়, জনকণ্ঠ-ভোরের কাগজে চলো। বিএনপি ক্ষমতা, চলো আমার দেশ-নয়া দিগন্ত -এইসবে। আবার কে কোন দল করে নিয়োগ দেয়ার আগে সে ব্যপারেও খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। শুরুতেই যেখানে পক্ষপাতদুষ্টতা সেখানে নিরপেক্ষতা আশা করা কতটুকু যুক্তিসংগত?
আরেকটা বিষয় বিপদজনক ও গুরুত্বপূর্ণ। আজ-কাল সাংবাদিকদের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এটিকে নিরপেক্ষ রাখতে হয় রাষ্ট্রের কল্যাণে। সুতরাং সেটি নিশ্চিত না করে জামায়াতের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা সম্ভব হবে না। কারণ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের কল্যাণ আর জামায়াত একসঙ্গে যায় না।
সরকারি একটি সংবাদ সংস্থা আছে। বিএসএস। এইটার একটা বাংলা বিভাগ আছে। এইটা হইলো এখন সরকারি সমর্থকদের চাকরির জায়গা।
মাসুম ভাই,
জামায়াতরে এই দেশে দেখতে না চাওয়ার যেই মতাদর্শিক ভিত্তি সেইটা তো এখন ভূলুন্ঠিত। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে জোর কইরা আওয়ামি উদ্দেশ্য হাসিল করা, যেইটা করতে আমাগো ক্ষমতাসীনরা খোলা ময়দানেই জামায়াতি প্রশস্তি গাওয়া শুরু করছে। যদি বিভাজিত করা যায় তাগো প্রতিপক্ষরে। জামায়াতি রাজনীতির মূল ভিত্তি হইলো ধর্মীয় অনুভূতি, আমাগো মুক্তিযুদ্ধের সেক্যুলার চেতনা ধারণকারী মানুষেরাই ধর্মের নামে কাজ হাসিল করনের চান্স খুঁজেন প্রতিনিয়তঃ। এই অবস্থায় শেকড় দিগন্ত টিকা থাকবো ঠিকই...কিন্তু আমার দেশের মত ডালপালা ঝইরা যাইবো...
ভুলুন্টিত যে, সেটা তো এতদিনে সবাই বুঝে ফেলছে।
টাকার কাছে মানুষ বিক্রি হওয়া নতুন কিছু না। আর আদর্শ ! সেইটা লোক দেখানো।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাই।
আওয়ামীদের কেনাই জামাতের সার্থকতা। দিগন্তরে লাল সালাম, সার্থক জন্ম এবং সার্থক কর্ম।
একটা জিনিস, প্রায়ই মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আর আওয়ামী লীগকে গুলে ফেলতে দেখি। এটা একটা অসুস্থ চিন্তা। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সারা বাংলাদেশের লোক, আওয়ামী লীগাররা না।
এই সব নেতাদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করাটাও বোকামি ।
দিগন্ত হৈলো মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রমান, গণতন্ত্র যে আছে সেইটার প্রমান।
আর আমার দেশ হলুদ সাংবাদিকতার, এই খানে বাকশালী আচরন জরুরী।
মাহমুদুর রহমান সাংবাদিক নন। বুদ্ধিজীবি নন। রাজনীতিবিদ নন। ব্যবসায়ী নন। কুটনীতিক নন।
কিন্তু আবার মাহমুদুর রহমান সবই। কিংবা সবকিছুর সার্থক যোগফল। বাংলাদেশের ইতিহাসে এত বিরল বুদ্ধিবৃত্তির ধূর্ত শেয়াল খুব বেশী নেই। মাহমুদুর রহমান তাদের মধ্যে সফলতম মানুষ নিঃসন্দেহে । একমাত্র সাকাচৌ কিংবা মওদুদ বাদে আর কেউ নেই কাছাকাছি। কিন্তু সাকা বা মওদুদের চেয়েও মাহমুদ যে অনেক বেশী শক্তিশালী সেটা দেখেছি ১/১১ এর পরে। এই ভদ্রলোক খাঁচায় না ঢোকা একমাত্র শেয়াল। কারনটাও বুঝি খানিক। ইনি ডানহাতে সৌদি আরবের সাথে হ্যান্ডশেক করেন বাম হাতে করেন ভারতের সাথে। এই প্রতিভা বাংলাদেশে আর কজনের আছে জানা নেই।
বাংলাদেশের একটা দুঃখজনক ব্যাপার হলো আইনের অসংগত প্রয়োগ। যাকে যে ধরনের মামলায় গ্রেফতার করা দরকার সে মামলায় গ্রেফতার করা হয় না, কিংবা যায় না। ডাকাতির আসামীকে চুরির মামলায় গ্রেফতার করতে দেখা যায় প্রায়ই। কিছুদিন আগে নিজামী সাঈদীর বিরূদ্ধেও যেরকম পাতলা মামলা দিয়ে পরোয়ানা জারি করা হয়। এবার করা হলো মাহমুদুর রহমানের বিরূদ্ধে। ফলে কদিন বাদেই এরা হাসতে হাসতে টিভি ক্যামেরায় V দেখিয়ে রাজপথে গাড়ি হাকিয়ে ঘরে ফিরে যায়।
আমাদের কোন কিছুই ঠিক ভাবে করা হয় না। অপরাধীর V দেখতে দেখতেই আমাদের ক্লান্ত ক্রোধ ঘুমিয়ে পড়ে।
এই পদ্ধতির গ্রেফতারে এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার।
মাসুম ভাই, আপনার সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলি- আমি জামায়াতের কোনো অস্তিত্ব এই দেশে দেখতে চাই না। কিন্তু আমি, আপনি চাইলেই কী, আর না চাইলেই কী ! সব শালা বেজন্মার দল- যারা দেশের মা বাপ। এরাই দেশ চালায়। চালায় আমাদের মত আবাল জনতাকে। শেয়ালের মত এরা কখন যে কোথায় চেহারা দেখাবে- তার হিসাব মেলানো বড়ই কঠিন...
একটা সংশোধনী : আমি যদ্দুর জানি, যুগান্তরের উপ-সম্পাদক সাইফুল আলম আওয়ামী পন্থির ভাব নিলেও আসলে এই লোকটি জামায়াতের একনিষ্ঠ একজন...।
একদম আমার মনের কথা লিখছেন। প্রতি লাইনে লাইনে সহমত।
মাত্র একহাজার টাকার জন্য বুদ্ধিজীবীদের বিক্রি হয়ে যাওয়া দেখেও বিস্মিত হলামনা কারণ সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ।
মিডিয়ার ভেতরের মজার মজার খবর সময় সময় জানান দেবার জন্য ধন্যবাদ, মাসুম ভাই।
এইভাবে চলতে চলতে একদিন দেশে আর পত্রিক , প্রাইভেট চ্যানেল থাকবো না।
ভালই হবে তখন।
ই টি ভি র এই কাহিনীটা জানতাম না।
ব্যাপক পছন্দ হইছে কথাটা। আর প্রত্যেকটা লাইন মনের কথা বলে।
বাড়িতে বৃদ্ধা কাজের লোক মারা যাওয়াতে কিশোরী মেয়েটি খুব কাঁদছে। সবাই তাকে জিজ্ঞাসা করলো, 'তুই এত কাঁদছিস কেনো?' 'আরে যমে যে বাড়ি চিইনা গেলো!!' জবাব ক্রন্দনরতা কিশোরীর।
যে প্রক্রিয়ায় আমার দেশ বন্ধ করা হল তাতে সম্পাদকদের শংকিত না হবার কোন কারন নেই। যম আজ তেজগাঁও থেকে ফিরেছে, কাল যে কাওরানবাজার বা মতিঝিলে ঘুরতে যাবে না তার নিশ্চয়তা কই।
আর প্রতিকূল পরিবেশে অভিযোজনের ক্ষমতাই মানুষ (!) এর সবচেয়ে বড় গুণ। জামাতীরা এটা ভালোই জানে।
লেখার জন্য ধন্যবাদ মাসুম ভাইকে।
প্রথম যখন ক্রসফায়ার শুরু হইছিল, সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচছিল, এলাকার চুনোপুটিগুলার তাফালিং বন্ধ হইছে, সাময়িক একটা আতংক দেখা দিছে আন্ডারওয়ার্ল্ডে। কিন্তু অবৈধ একটা কাজ ভাল উদ্দেশ্যে করলেও যে ফলাফল বাজে হয় তার উদাহরণ এই ক্রসফায়ার...এখন সন্ত্রাসীর সাথে নামের মিল থাকার কারণে নিরাপরাধ মানুষদের ক্রসফায়ারে মারা পড়তে হইতাছে।
আজকে মাহমুদুর রহমানের এই অবস্থা নিয়া বেশি খুশি যারা...সময়ে একদিন তাদের উপরেও কোপ পড়বে। তাই শাস্তি/সরকারি কর্মকাণ্ড আইন-বিচার-গঠনতন্ত্র মেনে হোক, সেটাই প্রয়োজন।
সবকিছু দেইখা তো, আর কয় বছরের মধ্যে জামাতি ছাড়া বাকি সবাইরে দেশ থেকে বাহির কইরা দেয়া হবে সেই হিসাবই করতেছি .........
লেখা ব্যাপক হইছে।
মহাভারতে একটা কাহিনি আছে। দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকে বলছিলো, "নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি" (হুবহু মনে নাই হয়তো)। মাহমুদুর রহমানরে কেউ ধৃতরাষ্ট্র মনে করে না তবে সরকারের দুর্যোধন সাজার দরকার ছিলো না। আমার দেশের ডিক্লারেশন বাতিলের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ আসছে শুনলাম।
মন্তব্য করুন