যদি আর বাঁশী না বাজে
প্রেমের কবি, বিরহের কবি, বিদ্রোহের কবি, সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন আজ।
তাঁকে দেয়া এক সম্বর্ধনার জবাবে তিনি যে কথা গুলো বলেছিলেন সেটা দিয়েই আজ তাঁকে স্মরন করছি।
এই সামান্য বক্তব্যের মধ্যেই তিনি জানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন তাঁর জীবনের কষ্ট, পূর্ণতা ও অপূর্ণতা, প্রেম, বিদ্রোহ নিয়ে তাঁর কথা।
বন্ধুগণ
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল দ্যোন মন ও প্রান আজ বীনার মত বেজে উঠেছে । তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠছে - আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে।
বিংশ শতাব্দির অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহন করেছি, এরই অভিযান সেনা দলের তূর্য বাদকের একজন আমি, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশের, এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের সকল মানুষের।।
কবি চায়না দান, কবি চায় অঞ্জলী, কবি চায় প্রীতি। কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। সুন্দরকে স্বীকার করতে হয় যা সুন্দর তাই দিয়ে। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগান ই আমার ধর্ম। তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি, তার চোখে চোখ ভরা জল ও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে তাকে ক্ষুদা জীর্ন মূর্তিতে ব্যথিত পায়ে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভুমিতে তাকে দেখেছি, কারাগারের অন্ধকুপে তাকে দেখেছি, ফাসির মঞ্চে তাকে দেখেছি। আমাকে বিদ্রোহী বলে খামোখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নিরীহ জাতটাকে আঁচড়ে কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি, বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচার এর বিরুদ্ধে। যা মিথ্যা, কলুষিত, পুরাতন, পঁচা, সেই মিথ্যা সনাতনের বিরুদ্ধে, ধর্মের নামে ভন্ডামি ও কুসংস্কার এর বিরুদ্ধে।
কেউ বলেন আমার বানী জবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিম কে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালি কে গলাগলি তে পরিনত করার চেষ্টা করেছি। সে হাত এ হাত মেলানো যদি হাতাহাতি থেকে অশোভন হয়ে থাকে তাহলে ওরা আপনিতেই আলাদা হয়ে যাবে। আমার গাঁটছড়ার বাঁধন কাটতে তাদের কোন বেগ পেতে হবেনা, কেননা একজনের হাতে আছে লাঠি আরেকজনের আস্তিনে আছে ছুরি। হিন্দু মুসলিম দিনরাত হানাহানি জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র, রীন, অভাব অন্যদিকে লোভী ও সুদেচক্রের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষান স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদ দুর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে, সঙ্গীতে, কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম।
আমি যশ চাইনা, খ্যাতি চাইনা, প্রতিষ্ঠা চাইনা, নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময় হউক, আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থকব আমি বেঁচে - এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলীর মত, কীটস্ মত খুব বড় একটা ট্রজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ্। জীবনে সেই ট্রজেডি দেখবার জন্য আমি কতদিন অকারনে অন্যের জীবন অশ্রুর পরশে আচ্ছন্ন করে দিয়েছি, কিন্তু আমারই জীবনে রয়ে গেল বিশুষ্ক মরুভুমির মত তপ্ত, মেঘের উর্ধ্বে শুণ্যে র মত কেবল হাসি, কেবল গান ,কেবল বিদ্রোহ। আমার বেশ মনে পড়ছে একদিন আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা। আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন তীব্র পুত্রশোকে যখন ভেঙ্গে পড়ছে ঠিক সেই দিনই সেই সময় আমার বড়িতে হাসনা হেনা ফুটেছে, আমি প্রান ভরে হাসনা হেনার গন্ধ উপোভোগ করেছিলাম। আমার কবিতা ,আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য হতে জন্ম নিয়েছে।
যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকিত্বের পরম শুণ্য থেকে অসময়ে নামতে হয়, সেদিন মনে করবেন না আমি সেই নজরুল, সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পূর্ণত্বের তৃষ্ণা নিয়ে যে একটি তরুন এই ধরায় এসেছিল, অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্মা যেন স্বপ্নে আপনাদের মাঝে কেঁদে গেল।
যদি আর বাঁশী না বাজে, আমি কবি বলে বলছিনে, আমি আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি, আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন, আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন, আমি কবি হতে আসিনি আমি নেতা হতে আসিনি, প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলাম না বলে এই প্রেমহীন নীরস পৃথীবি থেকে নীরব ও অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।।
যেদিন আমি চলে যাব, সেদিন হয়তবা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা বেরুবে হয়ত আমার নামে। দেশপ্রেমি, ত্যাগী, বীর, বিদ্রোহী - বিশেষনের পর বিশেষন ।টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পড় মেরে, বক্তার পর বক্তা।
এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধদিনে বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পারো, চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরন কর। তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশে পাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেঁষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বল, বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি।
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবনা
কোলাহল করি সারাদিনমান কারো ধ্যান ভাঙিবনা
নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুঁড়িব একাকী
গন্ধ বিঁধুর ধুপ।
------কাজী নজরুল ইসলাম
কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
ঐ সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল ১৯২৯ সালে আর সে সভাতেই নজরুলকে বাঙ্গালীর জাতীয় কবি অভিধায় ভুষিত করা হয় । ঐ সভাতে নেতাজী সুভাষ বোস বলেন , নজরুলের স্বপ্ন বাঙালীর প্রেরণা । কি সেই স্বপ্ন ? যা সুভাসকে আলোড়িত করেছিল ? কংগ্রেস একই বছরে তাদের বার্ষিক সভায় পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহন করে , এর আগে তারা স্বরাজের কথা বলত । প্রস্তাবটা গান্ধীর তৈরি কিন্তু নেপথ্যে ছিলেন সুভাস । এখানেই প্রশ্ন আসে সেই সুভাসের প্রেরণায় কিভাবে নজরুল আসলেন ? আসলেন এজন্য যে, পুর্ন স্বাধীনতার দাবি প্রথম তোলেন আর কেউ নন -এই নজরুলই । তাও আবার ১৯২২ সালে তার ধুমকেতুতে ।
বাংলা ব্লগাস্ফিয়ারে এবং প্রিন্ট মিডিয়ায় নজরুলের উপর সব লেখায় পড়লাম কিন্তু এই তথ্য নেই কোথাও । অগত্যা অধমকেই কমেন্ট করতে হল এখানে ।
মানিক ভাই। এই তথ্য জানতাম না। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
নুরুজ্জামান ভাই, এই তথ্য আমি জানতাম না , আমার সামান্য সীমিত সাধ্যে খুঁজাখুঁজি করেছি, পাইনি কবে কোন সম্বর্ধনার জবাবে দিয়েছিলেন।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ ভাই, এই তথ্যগুলো দেবার জন্য।
স্বাধীনতার দাবী তুলেছিলেন তাও জানতাম না, আবারো তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত হয়ে আসছে।
তোমার ঘরের আঙিনায় বা আশে পাশে যদি একটি ঝরা পায়ে পেঁষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বল, বন্ধু, আমি তোমায় পেয়েছি ............ সকল শ্রদ্ধা কবির প্রতি।
কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা....
তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবনা
কোলাহল করি সারাদিনমান কারো ধ্যান ভাঙিবনা
নিশ্চল নিশ্চুপ আপনার মনে পুঁড়িব একাকী
গন্ধ বিঁধুর ধুপ।
---এই কথাগুলো কবি নজরুলের মতো করে বলে যেতে পারেন নি আর কেউ। আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরি প্রিয় কবিকে।
জাতীয় কবির প্রতি শ্রদ্ধা
আপনাকে ধন্যবাদ
আচ্ছা বন্ধু, ক ফোটা রক্ত দিয়ে এক ফোঁটা চোখের জল হয় তোমাদের বিজ্ঞানে বলতে পারে? এখন শুধু কেবলই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, যার উত্তর নেই, মিমাংসা নেই, সেইসব জিজ্ঞাসা।.......... (নজরুল )
কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা...
শুভ জন্মদিন মিতা
কবি নজরুলের গভীরতা জানতে মন চায়। তার জীবনী কি নেটে পাওয়া যায়?
এমন নিঃস্বার্থ কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
নুরুজ্জামান মানিক ভাই বলতে পারবেন ।
শ্রদ্ধা জানাই কবির প্রতি
আমদর পয় কব, সবসময়র সব সমজর চর তরণ কবক অ ভ ব দ ন !াে্রিিোেিুিেিা
আর্শি এই কমেন্টসটা ক্যাম্নে লিখছে????
আমাদের প্রিয় কবি, সবসময়ের সবসময়ের চির তরুণ কবিকে অ ভি বা দ ন !
শ্রদ্ধা রইলো
শুভ জন্মদিন
বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো কবির প্রতি...
ধন্যবাদ!
সাঈদভাইকে ধন্যবাদ। উদ্ধৃতির শেষের দিকে পুড়িব আর বিধুর-- দু'টো শব্দে চন্দ্রবিন্দু বড় চোখে লাগছে
সাঈদ ভাই লেখাটি অসম্ভব ভাল লেগেছে। অনেক অজানা কথা জানলাম। আমার মনে প্রায়ই প্রশ্ন জাগে রবীন্দ্রনাথের জন্ম-মৃত্যু দিবসটি যেভাবে স্মরণ করা হয় জরুলের বেলায়কি আমরা কি ততটা উদারতা দেখাই।
কবির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা।
শ্রদ্ধা জানাই কবির প্রতি
পড়ে ভালো লাগলো পড়ে ভালো লাগলো
মন্তব্য করুন