ইউজার লগইন

একটি ফ্যাসিবাদি উত্তরাধুনিক গল্পের খসড়া : মোহর যখন বাইক্য

অনেকদিন পরে শেকসপীয়র পার্কে এসেছেন। কিং রুফু পার্কের একটি হেলানো বেঞ্চিতে বসে আছেন। ঠাণ্ডাও কমে এসেছে। চারিদিকে সামার সামার ভাব। গাছে গাছে কুড়ি উঁকি দিচ্ছে। একজন স্প্যানিস গায়ক দীর্ঘ ওকগাছের নিচে দাঁড়িয়ে গান গাইছে। বিরহ সঙ্গীত। ছোট একটি গোলাকার সিডি প্লেয়ারে গানটির মিউজিক ট্রাক বাজছে। আর গীটারে টুং টাং তুলে হা করে গাইছে--

আমার থাকত যদি সোনার পাহাড়
তোমায় গড়ে দিতাম নাকের ফুল
ও—ও—ও—

এই সকালবেলা পার্কটি ফাঁকা। শেকসপীয়র বেঞ্চিতে বসে বসে ঢুলছেন। কলারতোলা শার্ট। চান্দিতে চুল কমে এসেছে। একটি জুতোর ফিতে নেই। ঢলো ঢলো প্যান্ট। মুখটা ফোলা ফোলা। রাতে নিয়মিত গভীর নিদ্রার ঘাটতি। দুটো মাছি নাকের আশে পাশে ডানা ফর ফর করে উড়ছে। ওরা বেশ চঞ্চল। কিন্তু শেকসপীয়র অচঞ্চল। মানোযোগ দিয়ে এই বিরহ সঙ্গীত শুনছেন। স্প্যানিশ গায়ক বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গানটির মুখটাই গাইছে--

আমার থাকত যদি সোনার পাহাড়
তোমায় গড়ে দিতাম নাকের ফুল
ও—ও—ও—

পার্কের বাইরে এজন কেঠো পুলিশ বিস্মিত হয়ে চেয়ে আছে। এই ভোরবেলাকার ঘুম তার অতি প্রিয়। কিন্তু ঘুমের বদলে আজ তাকে ডেকে আনা হয়েছে কাজে। সহ্য করতে হচ্ছে জানেমনের বদলে মর্মভেদী গীটার বাদন। বাদনে কাদন হয়ে বিড় বিড় করে বলছে--
আমার থাকত যদি সোনার পাহাড়
পুলিশগিরি করতাম না
ও—ও—ও—

গান শেষ হওয়ার আগেই শেকসপীয়ার মাথা তুললেন। বলে উঠলেন, হুম। গায়ক গান থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন স্যার?
--হুউম।
--হুউম মানে কি স্যার?
--হু-উ-উ-ম।

এর পরে আর কথা নাই। সুতরাং স্প্যানীশ গায়ক গান শেষ করে টুপিটা এগিয়ে ধরল। হাসি হাসি মুখ। শেকসপীয়র এদিক ওদিক তাকালেন। পকেট থেকে অতিযত্নে অতি পুরনো একটি কাগজ বের করলেন। একটু হেসে মাথা নুয়ে টুপির মধ্যে কাগজটি রাখলেন।
গায়কের ভ্রুটা কুঁচকে গেল। কাগজটির দিকে তাকিয়ে বলল, ওটা কি বস?
--পোয়েম।
--এটা তো ডলার না!
---ওটা ডলারের চেয়েও অনেক মুল্যবান—মিঃ শেকসপীয়রের অরিজিনাল কবিতা।

গায়কটি সিডি প্লেয়ারটির তারটার গুছিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল। মুখটি অতিশয় গম্ভীর। সামারের মৃদু মন্দ হাওয়ায় শেকসপীয়রের পোয়েমটি হালকা করে ভেসে উড়ে গেল পার্কের বাইরে। রাস্তায়। অফিস টাইম। খুব বিজি সময়। গাড়ির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। আর পোয়েমটিও কোন কোনে গাড়ির পিছনে বোঁ করে উড়তে লাগল।

শেকসপয়ির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পোয়েমটির উড়ে যাওয়া দেখলেন। মাথাটা নিচু করলেন। বার কয়েক ঝাকালেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, হুউম।

এই সময় ডানকিন থেকে দুটি ডোনাট আর এক কাপ মিডিয়াম সাইজের কফি নিয়ে করিম মিরধা পার্কে ঢকে পড়লেন। নাস্তা টাস্তা সেরে এখানে একটু গড়িয়ে নেবেন। দীর্ঘ শীতে তার দম ফুট্টুস হয়ে গেছে। এখন যতটা পারা যায়, বাইরে থেকে নতুন করে হাওয়া টাওয়া খেয়ে নতুন করে বাঁচার ধান্ধা করছেন। এই জন্যই সামারটা তার কাছে প্রিয়। এখানেই নাস্তা। লাঞ্চ। পারলে ডিনার। এবং পারলে ঘুম।

আজ তার কপাল অত্যন্ত ভাল। অবশেষে এই পার্কে শেকসপীয়রের দেখা মিলল। যৌবনে শেকসপীয়রের অনেক লাইন মুখস্ত করেছিলেন। বুড়ো হচ্ছেন আর সে সব ভুলে যাচ্ছেন। কিন্তু শেকসপীয়র এরকম বুড়িয়ে যাবেন করিম মিরধা আশা করেন নি। কফিতে চুমুক দেয়ার আগেই সালাম টালাম দিয়ে বলে বসলেন, স্যার।
--হুম।
--স্যার ভাল আছেন নি আপনে?
শেকসপীয়র কোনো উত্তর দিলেন না। ঝিম মেরে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে বললেন, জনাব কি প্রাচ্যদেশীয় আগন্তুক?
--ইয়া। ইয়া।
হুউম। কোন দেশ?
--বাংলাদেশ।
বাং-লা-দে-শ। হুম। বাং-লা-দে-শ।
--তোমরা স্বাধীন হয়েছিলে কবে?
--১৯৭১ সালে।
--হম। তোমরা তাহলে হাজার বছরের আবহমান বাঙালি?
--ইয়া স্যার।
আমরা সবাই বাঙালি
পুটি মাছের কাঙালি।।
কবিতা করে বলে উঠলেন করিম মিরধা। পুটি মাছ খুব প্রিয়। তেলে ভাজা পুটি মাছ খেলে ব্রেন বাড়ে। অনেক দিন খাওয়া হয় না। তবু জিহ্বায় আজ পুটি মাছের স্বাদ টের পাচ্ছেন। এ কারণেই পুটি মাছের কবিতাটা বলে আরাম পেলেন। জোস পেলেন। শেকসপীয়র কিন্তু ভাবলেসহীন। এই ভাষাটা তার অজানা। হ্রিং ক্রিং মনে হল। বললেন, তার মানে তোমরা ফ্যাসিবাদি? হাজার বছরের আবহমান বাঙালি চেতনা একটি ফ্যাসিবাদি চেতনা।
--ফ্যাসিবাদি? এইটা কি জিনিস?
--হুউম। এটা আমিও জানি না। শেকসপীয়র সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অনেক কিছুই তিনি জানেন না। কোনো এক হিটলার না মুসোলিনি এই ফ্যাসিবাদ শব্দটা চালু করেছিল। এ শব্দটা তিনি শুনেছিলেন, প্রাচ্য দেশের একজন খর্বকায় লোকের কাছে। লোকটির মাথায় আগে মেয়েদের মতো খোপা ছিল। এখন টাক উঁকি দিচ্ছে। দাড়ি গোঁফ নেই। পুরো মাকুন্দ। এনজিও করেন। তার দুটি স্ত্রী। একটি থাকেন দেশে। তিনিও খর্বকায়া। নারী গ্রন্থনা নামে কি সব ট্যাক্সবিহীন ব্যবসা পাতি পারেন। আরেকজন থাকেন এই ম্যারিকা দেশে। তার দুই স্ত্রী থাকার কারণেই অগাধ জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পেয়েছেন। অথচ তিনি হলেন শেকসপীয়র--তার নিজের মাত্র একটি স্ত্রী। আবার স্ত্রীটি মুখরাও বটে। একদিন রেগে মেগে শেকশপীয়রের গায়ে গরম পানি ঢেলে দিয়েছিল। মহা মুশকিল। এর পর কথাবার্তা বন্ধ। একটি স্ত্রী সামলানো কঠিন। আর খর্বকায় লোকটি দুই দুইটি স্ত্রী সামলে দিব্যি নাদুস নুদুস। লোকটার এলেম আছে বটে।

সেদিন লোকটি শেকসপীয়রকে ফ্যাসিবাদ নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ১৯৭০ সালে তার দেশের জনগণ যোগ্য কোনো বিপ্লবী দল না পেয়ে আম লীগকে ভোট দিয়েছিল। এই বেশি ভোট পাওয়া কিন্তু জনসমর্থন প্রমাণ করে না। এটাও একটা ফ্যাসিবাদি কর্ম। এটা যে ফ্যাসিবাদি কর্ম তার নজির তারা রেখেছে ১৯৭১ পেয়ারা পাকিস্তানকে ভেঙে দুটুকরো করে। পাকিস্তান হল—ফাক-ই স্তান। তারা বাধ্য হয়ে এই ফ্যাসিবাদি বাঙালিদের হত্যা করে ফেলল—হত্যা করল মাত্র ৩০ লক্ষ লোক। মুক্তিযুদ্ধ হল এক ধরনের ফ্যাসিবাদি সন্ত্রাসী কর্ম। আর মুক্তযোদ্ধারাও ফ্যাসিবাদি সন্ত্রাসী।

করিম মিরধার মাথাটা টগবট করে উঠল। তার শাদা শাদা চুলগুলো খাড়া হয়ে গেছে। এই হতভাগা বুড়োটা বলে কি? ৩০ লাখ মানুষ হত্যা—একটি নয়, দুটি নয়, ৩০ লাখ মানুষকে পাখির মত হত্যা করা হয়েছে। এই ৩০ লাখ ‘মাত্র’ হল!
--লোকটার নাম কি?
--লোকটির দেশটি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তিনি বলেছেন, তার একটি সোনার পাহাড় আছে। পাহাড়টির নাম—তোরাবোরো। এই পাহাড়টি থেকে তিনি কয়েকটি সোনার মোহর আমাকে দিয়েছেন। মোহরের গা থেকে তেলের গন্ধ বের হয। তিনি যা বলেছেন, আমি তাই তোমাকে বলেছি জনাব। আমিতো বাংলাদেশ সম্পর্কে আর কিছু জানি না। উনি যা বলেছেন--বাংলাদেশ সম্পর্কে সেইটুকুই আমার জ্ঞান।
--লোকটির নাম কি?
--তিনি বলেছেন, তিনি হলেন বাংলাদেশে দুই বাংলার শ্রেষ্ট কবি এবং বিভাগোত্তর জীবিত একমাত্র দার্শনিক। বলেছেন, এটা যেন দরকার হলে বলি। আচ্ছা, দার্শনিক মানে কি?
--হারামজাদা। গজ গজ করে বলে উঠলেন করিম মিরধা। তার মুখটা তেতো হয়ে গেছে। আজ সকালের নাস্তা মাটি। ডোনাট দুটি ছুড়ে ফেললেন। আর কফির গ্লাসটি ফেলে রেখে উঠে পড়লেন। তার অবিলম্বে মাথায় পানি ঢালা দরকার। আর দরকার নতুন করে অজু করা। তিনি রেস্টরুমের খোঁজে হন হন করে ছুটলেন।

শেকসপীয়র সাহেব অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। এ কেমন প্রাচ্যদেশীয় লোক! একজন সোনার মোহর দিল। আরেকজন হাওয়া। তাহলে তার চলবে কিভাবে আজ? এ পোড়া দেশে কে তাকে আহার দেবে? দিনটির শুরুটা আজ ভাল হল না। কপালে কি আছে কে জানে। তিনি করিম মিরধার কফিটির ঢাকলা খুললেন। মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলেন ডোনাট দুটি। কফিতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খেতে শুরু করলেন। আর বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন—হারামজাদা। হারামজাদা।
শব্দটি শ্রুতিমধূর এবং অর্থপূর্ণ। লোকটির ভুলে যাওয়া নামটি তখন মনে পড়ল। ফরহাদ মজহার। হুউম, ফরহাদ মজহার তাহলে দুই বাংলার জীবিত শ্রেষ্ঠ হারামজাদা।

...............................................................................................
এতদ্ সংক্রান্ত লিংক যাহা পড়িলে আরাম পাইবেন--
১. ডঃ আনোয়ার হোসেনের প্রবন্ধ : জেহাদ ও শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বের আড়ালে বাংলাদেশে কি ঘটছে? প্রবন্ধ
২. পশ্চিম বঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদিদের সার্টিফিকেট কেন দিচ্ছেন? বিষয়টা কি?
৩. ফরহাদ মজহারের প্রবন্ধ : জনগণকে সংগঠিত হতে হবে
৪. ফরহাদ মজহারঃ নাস্তিক মোল্লা

পোস্টটি ১০ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

নীড় সন্ধানী's picture


ফরহাদ মজহার তাহলে দুই বাংলার জীবিত শ্রেষ্ঠ হারামজাদা।

নীড় সন্ধানী's picture


উত্তরাধূনিক ভন্ডের আদর্শ নজীর এই লোকটা।

নুরুজ্জামান মানিক's picture


খাইছে !

নুরুজ্জামান মানিক's picture


ফরহাদ কে চেনার জন্য আরেকটি লেখার লিন্ক দিলাম নিচে
ফরহাদ মজহারঃ নাস্তিক মোল্লা - মোস্তাফিজ রিপন

নজরুল ইসলাম's picture


হা হা হাহা... কুলদা দাদা, ব্যাপক লেখছেন... প্রিয়তে নিলাম

হাসান রায়হান's picture


ফাটাফাটি রকমের জোস হইছে।

ভাঙ্গা পেন্সিল's picture


এই ব্যাটারে তেমন একটা চিনি না, তাই পুরা লেখা তেমন ভাল ধরতে পারলাম না!

সামী মিয়াদাদ's picture


সেইরকম স্যাটায়ার...হাহাহাহাহাহা

তানবীরা's picture


গল্প দারুন লাগলো।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

কুলদা রায়'s picture

নিজের সম্পর্কে

পাঠক