ইউজার লগইন

গল্প: তুমি আমার কাছে তুমি যা বলবা তাই (শেষ পর্ব)

বলবো না ভাবলেও; মিসিসিপিকে বলতে হয়েছিল, কি ভাবছিলাম আমি শেষ রাতে। পরদিন সকালে সবার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে লামা-টু-চকোরিয়ার বাসে ওঠার পর থেকে প্রশ্ন করা শুরু করেছিল সে। আসলে সে প্রথমে জানতে চেয়েছিল, আগের রাতে কি করেছি, ঘুম কেমন হয়েছে- এসব। সেসব প্রশ্নের উত্তর থেকেই বেরিয়ে এসেছিল যে, আমি সারারাত ঘুমাই নি। তাই শুনে সে জিজ্ঞেস করেছিল, কেন? তখন আমি বলেছিলাম, অনেক চিন্তা মাথায় এসে বাসা বেঁধেছিল গতকাল। তাই ঘুমুতে পারি নি সারারাত। এরপর থেকে 'কি চিন্তা করেছো' জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছিল সে একটু পর পর।

চকোরিয়ায় গিয়ে চট্টগ্রামের বাসে ওঠার পর থেকে তার প্রশ্নের কম্পাঙ্ক বেড়ে গেল। আগে আধা ঘন্টা পর পর সে প্রশ্নটা করছিল। চকোরিয়া ছাড়ার পর থেকে প্রায় প্রতি মিনিটেই কথা ঘুরে ঘুরে ওই প্রশ্নে গিয়ে পৌঁছাতে লাগলো! আমি চট্টগ্রাম পর্যন্ত গড়িমসি করে যেতে পারলেও, মধ্যাহ্ন বিরতিতে মেজবানি মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে আবার বাসে ওঠার পর আর পেটের কথা ধরে রাখতে পারি নি। ঠেসে ভাত খেয়েছিলাম সেদিন দুপুরে। অলংকারের মোড়ে একটা চাটঁগেয়ে রেস্তোঁরায়। অমন ঠাসবুননের উদরপূর্তি- কমই করা হয় ইদানীং। আগে যখন বয়স কম ছিল, তখন হরহামেশাই হতো। খাবারের মেন্যুতে ছিল মেজবানি মাংস, কালাভুনা, শুটকি, মুরগির রসা ভুনা, ফেলন ডাল, ইলিশ ভাজা, লইট্টা মাছ কড়া-ভাজা, মাছ ভর্তা, আলু ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা, বেগুন ভর্তা, টমেটো ভর্তা, করলা ভাজা, কুমড়ো শাক, কলমি শাক ও শাদা ভাত। সবই চেখে দেখেছিলাম সেদিন। বেশ কয়েকদিন বাদে; পাহাড়ি এলাকা থেকে লোকালয়ে প্রবেশ করে, ওই রেস্তোঁরাটিতে বাংলা খাবারের মচ্ছব লেগে থাকতে দেখে, নিজেকে আর সামলাতে পারি নি। মিসিসিপিও খুব আনন্দ নিয়ে খেয়েছিল আমার সঙ্গে বসে। তবে মাঝে মাঝেই তার প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসছিল, 'কি এত চিন্তা তুমি করলা কালকে সারারাত শুয়ে শুয়ে বলো তো!'

খেয়ে-দেয়ে মুখে মহেশখালীর মিষ্টি পান ফেলে যখন আবার বাসে এসে বসি, তখন মিসিসিপি সাড়াঁশি দিয়ে চেপে ধরে আমায়। তারপর তাকে ধীরে ধীরে আমার পুরো কথাটা বললাম। প্রথমে কিভাবে জীবনের আগাপাশতলা পাল্টে দিয়েছে মেয়েটি এক বছরেরও কম সময়ে- তা বললাম। আমার কাঠখোট্টা নিয়মতান্ত্রিক জীবনে যে মেয়েটি ঝড়ের মতো এসে সব ওলটপালট করেছে তা-ও বললাম। অনেকদিন পর এমন অনুভূতি উপভোগ করতে পেরে নিজেকে ভীষণ সুখী সুখী মনে হচ্ছে, আবার খারাপও লাগছে কেননা এ সুখ চিরস্থায়ী নয়; জানালাম মিসিসিপিকে।

তবে বিস্তারিত জানালাম আমার মনের চিন্তাপ্রবাহগুলো কিভাবে মানসিকভাবে আমাকে মিসিসিপির কাছে নিয়ে এসেছে- সেগুলো। ওর বন্ধুত্ব যে আমি কতোটা মূল্যায়ন করি সেটাও বললাম। আমাদের বয়সও যে এখন জীবনের সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর সঠিক মূল্যায়ন করার, তাও মনে করিয়ে দিলাম। হুট করে এমন সুন্দর একটা বন্ধুত্ব আমি ভাঙতে পারবো না, বলে জানিয়ে দিলাম। মেয়েটি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শুধু। কেন যেন কিছুই বললো না!

সেদিনের যাত্রাপথে পরে আর বিষয়টি নিয়ে কোন কথা হয় নি। কিন্তু যাত্রাপথের পুরোটা মোড়ানো ছিল নানাবিধ হাসি-ঠাট্টা, খুনসুটি, গভীর আলাপ, ভাসাভাসা আলাপ- সবকিছুতে ভরপুর। কুমিল্লায় পৌঁছানোর পর, আবার একবার ভরপেট খানাপিনা হয় আমাদের। রসমালাই কিনে নিলাম সেখান থেকে। জিনিসটা মানুষের মধ্যরাতে কোন কিছু খাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যাকে মানচিং বলে; সেটার জন্য দারুণ কার্যকর।

নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রীজের ওপর থেকে শীতলক্ষ্যা নদী দেখে খানিক মন খারাপ লাগলো আমার। শহরটিতে আমার আত্মীয়-স্বজনদের একাংশ থাকেন। সে সুবাদে যাওয়া-আসা হতো ছেলেবেলায় অনেক। তখন নদীটা যেমন দেখতাম, এখন তার সিকিভাগও একই রকম নেই। চারপাশ থেকে দখলদারেরা নদীটিকে গ্রাস করে নিয়েছে প্রায় পুরোটাই। পাড়ের কল-কারখানাগুলোর বর্জ্য পদার্থ বছরের পর বছর ধরে নদীতে মিশতে মিশতে পানির রংটাই যেন পাল্টে দিয়েছে! ছেলেবেলায় কাঁচপুর ব্রীজের নিচ দিয়ে নৌকায় পার হয়ে যেতাম আমার মায়ের মামাদের বাড়িতে। তখন পরিস্কার, স্বচ্ছ ছিল শীতলক্ষ্যার পানি।

তবে ভাল লাগলো যাত্রাবাড়ীতে যানজট না দেখে। ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে কখন যে বাস টিকাটুলী চলে এলো বুঝতেই পারলাম না। উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ নামাতে নামাতে কমলাপুর।

এর দু'দিন পরই আমার জার্মানি চলে আসার তারিখ ছিল। সেই দু'টো দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছিল মিসিসিপি। আমরা পুরো ঢাকা শহর বাইকে করে ঘুরে ঘুরে কাটাই মূলত সেই দিন দু'টো। কত জায়গায় যে গিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। কত চটপটি, ফুচকা, কোল্ড ড্রিংকস্ গায়েব হয়েছে তাও জানি না। পুরোটা সময় একরকম ঘোরের মতো কাটলো আমাদের। একদম শেষ রাতে, যখন পরদিন ভোরে আমার ফ্লাইট, তখন মিসিসিপি আমায় বলেছিল; আমাদের বন্ধুত্বটাই ভাল। এমনই থাকা উচিত আমাদের। দু'জনের দু'টি ভিন্ন জীবন। এমনও না, কেবল শুরু হচ্ছে জীবন দু'টি। কেননা জীবনের পথে অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া হয়ে গেছে দু'জনেরই। এখন চাইলেই পরিবার-পরিজন, সমাজ সবকিছু পাশে সরিয়ে হাতে হাত রেখে পথে বের হয়ে যেতে পারি না আমরা।

মিসিসিপি ভাল বোঝাতে পারে। বিশেষ করে পাশে বসিয়ে যখন ধীরে-সুস্থে কোনকিছু গুছিয়ে বলে, তখন ওর কথা না শুনে কোন উপায় থাকে না। ওর কথা শুনতে শুনতে আমার আবারও পুরোনো মিশ্র অনুভূতি হচ্ছিল। ভাল লাগা এবং খারাপ লাগা একসাথে। এবার ভাল লাগছিল কেননা, বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আমরা দু'জনই মনের ইচ্ছাকে বলি দিচ্ছিলাম তাই। আর খারাপ লাগছিল কেননা, জীবনটা তখন আর আগের মতো সহজ ছিল না এবং ইচ্ছা হলেই কিছু একটা করে বসার উপায় ছিল না তাই।

ভাল-খারাপের দোলাচলেই, এক বুকভরা স্মৃতি নিয়ে বিমানে চড়লাম পরদিন। উনিশ ঘন্টার উড়াউড়ি শেষে, একদিন পর যখন ডুসেলডর্ফের ছোট্ট বিমানবন্দরটায় নামলাম, তখন সন্ধ্যার অন্ধকার চারিদিক ছেয়ে ফেলেছে। শীতও পড়ে গিয়েছিল ততদিনে বেশ ভালরকমের। আমি যাওয়ার সময়ও অতো শীত ছিল না। আর দেশে তো গরমই কাটিয়ে এসেছি। আমার কাছে তাই ভারী কোন শীতবস্ত্রও ছিল না। হি হি করে কাঁপতে কাঁপতেই ট্রেন-বাস পাড়ি দিয়ে বাসায় আসলাম। মোবাইলটা কোন কারণ ছাড়াই অনেকক্ষণ এয়ারপ্লেন মোডে ছিল। বাসায় এসে চালু করতেই অনেকগুলো টেক্সট্ মেসেজ, মিসড্ কলের অ্যালার্ট, ভয়েস মেইল প্রবেশ করলো।

মেসেজগুলোর বেশিরভাগই ছিল মিসিসিপির। আমি পৌঁছেছি কি না তাই নিয়ে চিন্তা করছিল মেয়েটি। ওকে নিশ্চিন্ত করলাম প্রথমে। ফেরার পথে একটা রেডিমেড পিজ্জা কিনে এনেছিলাম সুপারশপ থেকে। সেটাকে ওভেনে ঢুকিয়ে আমি নিজে গোসলখানায় ঢুকলাম। যতক্ষণে গোসল শেষ হলো, ততক্ষণে পিজ্জাও প্রস্তুত হয়ে গেল।

আমি আশি ও নব্বুইয়ের দশকের বাংলা সিনেমার মতো একটা চৌধুরী সাহেব গাউন শরীরে চাপিয়ে খেতে খেতে টিভি দেখা শুরু করলাম। এমন সময় মিসিসিপির ফোন এলো।

খেতে খেতেই ধরলাম। ভেবেছিলাম ঠিকঠাকমতো পৌঁছেছি কিনা, খাওয়া-দাওয়া কি হলো এসব বিষয় জানার জন্যই ফোন দিয়েছে হয়তো। কিন্তু ফোন ধরে অবাক হতে হলো। মেয়েটি ঝরঝর করে কাঁদছিল। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে যখন কান্না থামলো, তখন সে বললো, খুব নাকি মনে পড়ছে আমার কথা তার।

আমারও মনে পড়ছিলো মিসিসিপির কথা। ভালোই হতো যদি আমাকে একা একা জার্মানি ফিরে না আসতে হতো। এখন অনেকগুলো দিন খুব খারাপ কাটবে। একবার মনের ভেতর ভালবাসার উথাল-পাতাল হয়ে গেলে, সেটা বড় সহজে কাটে না কখনোই। হোক না তা পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের বন্ধুর জন্যও! মিসিসিপির কান্না শুনে আমারও মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে ওকে অনেক রাত পর্যন্ত বুঝিয়েছিলাম। তারপর প্রচণ্ড মাথাব্যাথা নিয়ে ঘুমুতে যায় সে। আর আমি আবারও সারারাত জেগে কাটিয়ে দিই। দীর্ঘ বিমানভ্রমণের ক্লান্তিও মাথার নিউরণদের কাবু করতে পারে নি। তারা সারাটা রাত মিসিসিপির অনুপস্থিতিতে কাতর হয়ে বসে থাকলো! ভোরের আলো ফুটে ওঠার পর ধীরে ধীরে আমি ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

অফিসে গেলাম আরও দু'দিন পর। কলিগদের জন্য কিছু উপহার নিয়ে এসেছিলাম। সেগুলো বিলি-বন্টন হলো। আমার কলিগেরা বেশিরভাগ জার্মান। তাদের জন্য দেশ থেকে কিছু নিয়ে গেলে যারপরনাই খুশি হতো। সেই খুশি দেখতে আমার ভাল লাগতো। তাই ঢাকায় শেষ দু'দিনের ঘোরাঘুরির সময় গুলশানের আড়ং থেকে তাদের জন্য নানাবিধ দেশীয় পোশাক, সুভ্যেনির নিয়ে নিয়েছিলাম। আমার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় প্রচুর ছবি প্রকাশ করেছিলাম সেসব ঘোরাঘুরির। কলিগেরা দেখেছিল সবই। শুকনা, পাতলা কাঠি প্রায় সব ছবিতেই 'দারুণ জায়গা!', 'খুব মজা করছো', 'এরপরের বার আমাদেরকে সঙ্গে নিতে হবে' ইত্যাদি মন্তব্য করেছিল। কাঠির জন্য আমি একটা সুভ্যেনির রিকশা নিয়ে এসেছিলাম আড়ং থেকে। সেইটি দেখে মেয়েটির খুশি যেন আর কোনকিছুতেই ধরে না। যেখানেই রাখে সেখান থেকে উপচে পড়ে এমন অবস্থা!

কাঠির যে আমার উপহার এত ভাল লাগবে, তা জানা ছিল না। সাথে সাথে ওর সঙ্গে একটা হাস্যোজ্জ্বল ছবি তুললাম। ও এক হাতে ওর সুভ্যেনির রিকশা আর আরেকহাতে ভি চিহ্ন দিয়ে একান-ওকান বিস্তৃত হাসি সহকারে ছবির জন্য পোজ দিল। তারপর ছবিটায় আমাকে ট্যাগ করে পোস্ট করে দিল।

এসব বিষয় নিয়ে মিসিসিপির সঙ্গে টেক্সট্ চালাচালি হচ্ছিলোই সমান্তরালে। তবে মেয়েটি খুব বেশি আগ্রহ দেখালো না খেয়াল করলাম। বিশেষ করে রিকশাটা ওরই পছন্দে কেনা হয়েছিল বলে, আমি ভেবেছিলাম খুব উচ্ছ্বসিত হবে, যখন দেখবে ওর পছন্দের উপহারটা কাঠি অতো পছন্দ করেছে। কিন্তু বিধি বাম, কাঠির পোস্টটা আমিও শেয়ার করেছিলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমার সব কর্মকাণ্ডের প্রথম দর্শক, তথা মন্তব্য প্রদানকারী মিসিসিপি এই পোস্টটাতে এলোই না!

ভেবেছিলাম হয়তো ব্যস্ত। তবে সেদিন রাতে যখন আমি কলিগদের সঙ্গে খেতে যাওয়ার ছবি পোস্ট করলাম, সেখানেও ওকে কিছু করতে না দেখে একটু অবাক হলাম। কলিগদের সঙ্গে খেতে যাওয়ার ছবিটায় কাঠি ঠিক আমার পাশেই বসেছিল এবং কোন একটা কথায় হাসতে হাসতে অনেকটা আমার দিকে ঝুঁকে এসেছিল। এক সরল, অকপট আনন্দের অভিব্যাক্তি ফুটে উঠেছিল আমাদের সকলের চেহারায়। অমন একটা ছবিতেও মিসিসিপি কোন কথা বললো না! ভেবে রাখলাম, পরে একদিন কথা বলবো।

সেই কোন একদিন আসার আগে, একদিন সকালে দেখি মিসিসিপিই এসে আমার বাসার কলিংবেল বাজাচ্ছে! হ্যাঁ, জার্মানিতে!!

জীবনে সারপ্রাইজ আমি অনেক পেয়েছি। কিন্তু মিসিসিপির দেয়া সেই সারপ্রাইজটা এখন পর্যন্ত সেরা। কেউ অদ্যবধি সেটাকে সেটাকে টেক্কা দিতে পারে নি। এত হুট করেও যে এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে আসা যায়, সে সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না। সেই অসাধ্য সাধনে মিসিসিপিকে সাহায্য করেছিল ওর মামা, যে ফ্রাঙ্কফুর্টের বাংলাদেশি কনস্যূলেটে বড় একটা পদে কাজ করতো। কি করে কি হয়েছিল, সে গল্প আরেকদিন বলবো। এখন বলি বরং মিসিসিপি যখন আমার বাসায় এসে কলিংবেল বাজাচ্ছিল সে সময়ের কথাটা।

খুব ভোরের দিকে একটা সময় ছিল সেটা। আমি কোনমতেই বুঝতে পার‍ছিলাম না এত ভোরে কলিংবেল বাজিয়েই যাচ্ছে- কে হতে পারে! ঘুম ঘুম চোখে ইন্টারকমে মুখ লাগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, হু ইজ দিস?

অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসার জবাবটা কোনভাবেই বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না, আমি মিসিসিপি, সিদ্ধার্থ। খুলে দাও। খুব ঠান্ডা গো বাইরে! কেমনে থাকো এত ঠান্ডার ভেতরে? অসহ্য! তাড়াতাড়ি খোলো। হিসুও পাইছে অনেক।

বিশ্বাস হচ্ছিল না, তারপরও দরজা খুললাম। ধীরে ধীরে মিসিসিপিই সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো। আলো-আধাঁরিতে ভাল বোঝা যাচ্ছিল না তাই, সিঁড়ির লাইট জ্বালালাম। মিসিসিপিই! গাঢ় সবুজ রংয়ের একটা শাড়ি আর হাতাকাটা শাদা ব্লাউজ পরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা ছোট স্যুটকেস। বললো, বাইরে বড় স্যুটকেসটা আছে। ওঠাতে পারছি না। নিয়ে এসো তো একটু।

আমার সম্বিত ফিরলো তারপরে। তাও পুরোপুরি না। বাইরের বড় স্যুটকেস রেখে আগে মিসিসিপিকেই পাঁজাকোলা করে নিয়ে আসলাম ঘরের ভেতরে। ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশও করি নি। বাসি মুখেই বললাম, থ্যাংক ইউ মাই লাভ। আর কোনদিন কোথাও ছেড়ে আসবো না তোমাকে। বলতে বলতে চোখের কোণাটা চিকচিক করে উঠলো আমার।

মিসিসিপি বললো, হুম। দেখলাম তো। এখানেই এসেই একে ফিরিঙ্গি বেটির সঙ্গে ঢ্যাং ঢ্যাং করে ঘোরা শুরু করে দিয়েছো!

আমি অবশ্য মনে মনে কাঠিকেও ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। মেয়েটি খুব স্বাভাবিক রীতিতেই আমার এনে দেয়া উপহারটিকে উদযাপন করেছে। কিন্তু সেটি দেখে হিংসে হয়েছে মিসিসিপির। পুরো ঘটনাটা আমার জন্য কেমন দারুণ একটা ফলাফল বয়ে এনেছে!

আমি একটা কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে কাকতালীয় ঘটনা প্রায়ই ঘটে। সেসবের নানারকম কারণও থাকে। আর মাঝে মাঝে সেসব ঘটনা থেকে জন্ম হয় দারুণ সব গল্পের। এবারও যেমন আমি বা মিসিসিপি কেউ-ই জানতাম না যে, দেশ থেকে আমার কলিগদের জন্য উপহার নিয়ে আসা, কাঠির সে উপহার নিয়ে একটু বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ফেলা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বাড়াবাড়ি প্রদর্শনী- সবকিছু মিলে দুর্দান্ত একটা কাকতাল ঘটতে যাচ্ছিল!

সেই কাকতালীয় ঘটনাটিই মূলত মিসিসিপি আর আমার প্রায় হারিয়ে যেতে বসা ভালবাসাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে এনেছিল। তারপর থেকে অনেকগুলো বছর একসঙ্গে আছি আমরা। এখনও সবার আগে আমি তার বন্ধু। তারপর আমি তার বাড়ির বিনে পয়সার চাকর। ফুট-ফরমাশ খাটার লোক। মাসে এক সপ্তাহ তো তাকে বিছানাতে নিয়ে খাবার দেয়া হয়। ওই সময়টায় বিছানা থেকেও নামে না সে। এছাড়া আমি তার সব অপরাধেরও পার্টনার। তবে সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে যে পরিচিতিটা আমার, সেটা হচ্ছে আমি তার একটা ছোট্ট পিচ্চি দেবশিশুর বাবা।

আর আমাকে যখন মিসিসিপি জিজ্ঞেস করে যে সে আমার কি হয়? আমি তখন বলি, তুমি আমার কাছে তুমি যা বলবা তাই। শুনে মেয়েটি হাসে আর মায়াভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি আজও ওর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। ওর স্নিগ্ধতা আর সৌন্দর্য্যে চোখ পুড়তে শুরু করে।

জীবন কতো অদ্ভুতভাবে মাঝে মাঝে আমাদেরকে মনের মানুষ মিলিয়ে দেয়, তাই না?

---

পোস্টটি ১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

মীর's picture

নিজের সম্পর্কে

স্বাগতম। আমার নাম মীর রাকীব-উন-নবী। জীবিকার তাগিদে পরবাসী। মাঝে মাঝে টুকটাক গল্প-কবিতা-আত্মজীবনী ইত্যাদি লিখি। সেসব প্রধানত এই ব্লগেই প্রকাশ করে থাকি। এই ব্লগে আমার সব লেখার কপিরাইট আমার নিজেরই। অনুগ্রহ করে সূ্ত্র উল্লেখ না করে লেখাগুলো কেউ ব্যবহার করবেন না। যেকোন যোগাযোগের জন্য ই-মেইল করুন: bd.mir13@gmail.com.
ধন্যবাদ। হ্যাপি রিডিং!