ওড টু মাই ফ্যামিলি-১
পাড়ার মোড়ের মুদি দোকান থেকে প্রথম একটা সিগারেটের প্যাকেট কিনি যখন তখনও স্কুলে ভর্তি হইনাই। সময় কাল ১৯৮৫র দিকে হবে। এব্যাপারে আমার প্রধান ইন্সিপিরেশন হইলো আমার বাপ। আব্বা একের পর এক সিগারেট খান আর বিশাল গ্রুপ নিয়ে তুমুল রাজনীতি আলোচনা করেনঃ শেখ হাসিনা নির্বাচন করবে কি না, আব্দুর রাজ্জাকের বাকশাল কি করবে, এরশাদের সরকারের পতন কি আসন্ন, ইত্যাদি। মাঝে মাঝে চলে যান ট্যুরে, তার ৩ টা পাঞ্জাবি, ২ টা পায়জামা আর একটা কালো বাটার স্যান্ডেল আছে। সময়ের অভাবে কিনা জানিনা, তবে আব্বার বাটার স্যান্ডেলের পিছনের বকলেস কখনো লাগাননি, ওটাসহ কেমন করে যেন পায়ে গলিয়ে নিতেন। হাতের কালো ব্যাগে থাকতো তার খাতা, সেইভ এর ব্যাগ আর ৪-৫ টা কলম বিভিন্ন রঙয়ের। তো যেদিন আমি সিগারেট কিনে মহাআনন্দে আমার ছোটবোনকে নিয়ে বাড়ী ফিরছি (তখনও ঢাকা শিশুদের জন্য তত অনিরাপদ নয়), আব্বার সাথে দেখা আজিমপুর কলোনির গেটের মুদিদোকান পার হয়ে। উনি আমাদের দেখে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে নেমে আমাদের কাছে আসলেন। আমার বোনকে জিগেশ করলেন কি কিনেছে, সে টিকটিকির ডিম নামে একটা ৫০ পয়সার বাক্স দেখালো। আমার দিকে তাকাতেই আমি গা মুঁচড়ায়ে গাঁইগুঁই করা শুরু করলাম। আমার বোন সেইরকম উত্তেজিত, আমাকে ধরা খাওয়ানোর এই মোক্ষম সুযোগ, সে বলে, কৈ তুমি না সিগারেট কিনলা? আমি নিরুপায় হয়ে দেখালাম আব্বাকে। ৫৫৫ নামের একটা বাক্সে সিগারেট আকৃতির চুইংগাম ধরনের বস্তু হইলো আমার সেদিনের বাজার। আব্বা ব্যাপক গম্ভীর মুখে আমাদের হাত ধরে নিয়ে ঘরে ফিরলেন। বাসায় ফিরে মা'কে বললেন "শুভ'র মা আর সিগারেট খাবো না। মা তো বুঝেন না ঘটনা কি। স্বামীর এই পরিবর্তনে মনে হয় খুশীই হলেন একটু। এমনিতেই টানাটানির সংসার, সরকারী কলেজের বেতনে কোনরকমে দিন চলে। যাইহোক আব্বা আর সিগারেট খাননি কখনো। যদিও বাউন্ডুলে রাজনীতিকের জীবন আর একের পর এক সিগারেটের ধোঁয়া হৃদয়কে কিছুটা বিকল করেছিলো নিশ্চয়। ২০০৭-এ যখন হার্ট এট্যাকে মূমূর্ষ অবস্থায় সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, একজন ধন্বন্তরী ডাক্তার আমাদের বলেছিলেন সারাজীবনের জমে থাকা স্ট্রেস আর প্রায় ৩০ বছরের ধূমপান তাঁর হৃদযন্ত্রকে প্রায় কাবু করে দিয়েছে।
আমার বাবার আর মা'র পরিচয় হয় ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় ভারতের এক শরনার্থী শিবিরে। আমার মা তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে চাকরি শুরু করেছেন, তিনি ও তাঁর বোন রাজশাহীর নামকরা সুন্দরী (শোনাকথা), আর হিন্দু ব্রাহ্মনের অবিবাহিতা মেয়ে বলে পানিপ্রার্থীর অভাব নাই। যুদ্ধ শুরু হলে আমার মাতামহ স্ত্রী, দুইমেয়ে আর এক ছেলেকে নিয়ে প্রায় একবস্ত্রে রাজশাহীর বাড়ি থেকে সীমান্তের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। হিন্দুরাই তো ১৯৭১ এর সবচেয়ে বড় টার্গেট ছিলেন বলে শুনেছি। মা মাঝে মাঝে হেসে বলেন টাকাপয়সা, গয়নাগাঁটি কিছুই নেবার সুযোগ হয়নি আমার দিদিমনির, তবে পানের বাটা আর সুপারি কাটার যাঁতি নিতে তিনি ভুলেন নাই। প্রায় ৪ সপ্তাহ হাঁটা, নৌকা, গরুর গাড়ি ইত্যাদি করে যখন তারা ঐপারে পৌছান, তখন জীবনের অনিশ্চয়তা কমেলেও কষ্ট কমেনাই। আব্বার সাথে মা’র দেখা হয় তেমন কোন এক সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসাবে মা আগে থেকেই চিনতেন তাকে। আব্বা মা'র পরিবারকে কোন সাহায্য করতে পেরেছিলেন কিনা জানিনা; এর পরপরই লড়াকু তরুন মুক্তিযোদ্ধা, আমার বাবা, ফিরে আসেন যুদ্ধের মাঠে, মা থেকে যান শরনার্থী হয়ে। এইঘটনার পরে প্রায় ২ বছর তাদের দেখা হয়নি। তবে এই দুঃসময়ে পরিচয় হয়েছিলো বলেই বোধহয় পরবর্তীতে সারাজীবন একজন আরেকজনকে সুখেদুঃখে, ভালবাসায় বা সংগ্রামে পাশে পেয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে যখন স্বাধীন দেশে আবার তাঁদের দেখা হয় নিয়তিকে আর পাশ কাটাতে পারেননি এবার। আত্রাই জেলার জমিদার বিখ্যাত ভট্টচার্য্য বাড়ির মেয়েটি প্রেমের টানে ঘর বাঁধেন পাশের জেলার এক রক্ষনশীল মুসলিম পরিবারে। তখন সময়কাল ১৯৭৫; মা'কে পদে পদে পরীক্ষা দিয়ে প্রমান করতে হয় তার নওমুসলিম পরিচয়। যাইহোক একসময় আমরা আসি, বড় হতে থাকি নানাবাড়ি/ দাদাবাড়ির আত্মীয়দের কোলে পিঠে। ছুটি হলেই রাজশাহী চলে যেতাম। তখন ফেরী করে যমুনা পার হতে হত। ঈদে সিমাই খেয়ে পাড়া বেড়াই, দুর্গা পূজায় ঢাকের বাজনায় নাচানাচি করি, শবেবরাতের রাতে দাদা পাশে নিয়ে বসে আল্লাহর কাছে আমার দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করে কেঁদে জায়নামাজ ভিজান, এদিকে নানা মা স্বরস্বতীকে পূজা ও প্রাসাদ দিয়ে যান আমাদের সফল জীবনের কামনায়। বহুদিন পর্যন্ত আমি জানতাম না যে আমার নানাবাড়ি হিন্দু, আমাদের বাবা-মা কখনো বলেননি। প্রথম যখন একজন পাড়াত ভাই একথা আমাকে বলেন আমি তখন কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলাম। বারবার মনে হয়েছিলো তাহলে দাদু-দিদিমনি কি দোজখে যাবে? আর আমার ঘুড়ি উড়ানোর বন্ধু- পাশের বাড়ির আশালতা, আর সুমনদা- ওদেরই বা কি হবে?
(আশাকরি চলবে, নাও চলতে পারে)
এতো সুন্দর উপস্থাপনা আগে পড়িনি ব্লগে । জীবনের গল্প আমার খুব ভালো লাগে । অতি কথনে ভরা সাহিত্যে ব্লগ ভরে গেছিল । আপনার লেখা ব্লগে প্রাণ এনেছে । আপনি অবশ্যই লিখবেন । অসাধারণ কিছু শুরু হলো, বন্ধ করবেন না ।
আসলে সব গল্পই তো জীবনের গল্প। আপনার প্রশংসা শিরোধার্য, যদিও আমি এত প্রশংসা পাবার যোগ্য কিনা সে ব্যাপারে সন্দিহান। ধন্যবাদ।
একজনকে প্রশংসা করার জন্য অন্যদের ছোট করতে হলে প্রশংসাটা ঠিক প্রশংসা থাকেনা আর।। আল্লাহতায়ালা আপনাকে সঠিক পথে হেদায়েত করুক তাড়াতাড়ি, আমীন।
এর পর কোন এক ব্লগারের প্রশ্নে আপনি আরো নির্দিষ্ট করে একটা ব্লগের নামও বলেছেন। যেটা স্পষ্টই নীতিমালা লংঘন। আশা করছি ব্লগের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখার নিমিত্তে আপনার আচরন আরো শালীন হবে। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে আপনাকে সাবধানতা অবলম্বন করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
বাজে ভাবে আক্রমন গুলর কি হবে ? এক পাক্ষিক দৃষ্টি ভঙ্গি কাম্য নয় । ও গুলোও আচারণ বিধি সম্মত নয়।
দারুণ দারুণ দারুণ!!!
যেমন জীবন তেমন বয়ান। মনে হয় সিনেমা চললো চোখের সামনে।
নাও চলতে পারে মানে কী? কঠিন মাইর দেয়া হবে এই সিরিজ থামলে
আই-হায়! ভয় পাইলাম তো।
নুশেরা'পুর লগে সহমত
আমার সাথে সহমত না ক্যান?
নাও চলতে পারে কইছেন ..... এইজন্য সহমত না। .....
চললে আপ্নের সাথেও সহমত ......
শর্মি, আপনার অসম্ভব ভালো একটা লেখার হাত আছে। এটা নষ্ট করবেন না।
ধন্যবাদ।
আমার চেনা একজনেরও এমন অবস্থা হয়েছিল।
এই সিরিজতো চলবেই। পাঠক হিসেবে নাম লেখালাম।
গল্পটা চমৎকার লেগেছে।
ধন্যবাদ, মীর।
খুবই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা। শিশুর মনে সাম্প্রদায়িকতার প্রথম পাঠ সাধারনতঃ এরকম অতি উৎসাহী পাড়াত লোকজন দ্বারাই হয়। নাম লেখাবার জন্য ধন্যবাদ।
ও নো, নট আনাদার সিরিয!
তুই মর!
আমি মরলে তোর কি হবে!
ইয়ে মানে ... সেটা চিন্তার কথা বটে। আচ্ছা থাক মরিস না।
আচ্ছা ঠিকাছে। ও নো, নট আনাদার সিরিয!
না চললে আপনার খবর আছে।
কারণ লেখার হাত অসাধারণ।
সাথে একটু যোগ করি - শিরোনামটা আরো যুতসই হতে পারতো। একটু যেন ক্লিশে শোনাচ্ছে।
ধন্যবাদ বলব নাকি ভয় পাইসি বলব বুঝতে পারেতসিনা। ভয়ার্ত থ্যাঙ্কইউ, উলটচন্ডাল!
সাথে যোগকরি-- শিরোনামটি ক্লিশে হলেও এটা আমার খুবই প্রিয় একটি গানের শিরোনাম যে গানটি বারবার শুনেও পুরানো হয়নি।
আরে! গানটা তো দারুণ।
হ্যা, অনেকই দারুন!
শর্মি, আমি অনুরোধ করবো লেখাটা চালিয়ে যেতে প্লীজ।
এমন কিছু আমিও দেখেছি বাংলাদেশে আবার বিদেশে যখন আসলাম সাথে সাথে ওয়ান ইলাভেনের ঘটনায় আমিও হয়ে গেলাম ভিন দেশি প্রাণী। এধরনের অনুভূতি সবার জানা দরকার আছে, নিজেকে শোধরানোর জন্য
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য; লেখাটির কোন শোধনবাদী উদ্দেশ্য নাই যদিও। ভালো থাকবেন।
আপনি হয়তো সে উদ্দেশ্যে লিখবেন না কিন্তু অনেকেই নিজেদের চিন্তা ভাবনাকে রিভিউ কিংবা জাজ করতে পারবে
লিখে সবাই নিজের আনন্দ কিংবা কষ্ট থেকেই
ঠিক।
শর্মির এমন চমৎকার পোস্টটা অপ্রাসঙ্গিক (এবং রাফ টোনের) মন্তব্যে ভরে যেতে দেখে ভালো লাগছে না। কোন স্পেসিফিক পোস্টের বিষয়ে যে কোন ধরণের সমালোচনামূলক মন্তব্য সে পোস্টেই আসা উচিত। একটি বিচ্ছিন্ন পোস্ট কারো ভালো বা মন্দ লাগতেই পারে, সে জন্য পুরো ব্লগের প্রবণতার সঙ্গে তাকে মিশিয়ে ফেলাও যুক্তিযুক্ত না।
মৌসুমের মন্তব্যটি ভালো লাগলো।
ওড টু মাই ফ্যামিলি-১ সহ শর্মির দু'টো পোস্ট পড়লাম । এর আগেরটা ছিল কম্পিউটারাইজড জ্যোতিষিদর্শন এবং আমাদের “সোল-হিলিং” । লেখার নতুনত্ব ও স্বকীয়তা আকর্ষণীয় এবং একই সাথে ঈর্ষণীয় । শর্মি নিজের অজান্তেই হয়তোবা, শিক্ষণীয় কিছু তথ্য আমাদের উপহার দিচ্ছে । তার পোস্ট আশা করি পাব নিয়মিত ।
ধন্যবাদ, নাজমুল হুদা।
'আমরা বন্ধু' মডারেটর কর্তৃপক্ষকে অসংখ্য ধন্যবাদ, এবং কৃতজ্ঞতা ।
দারুন... ভালো লাগছে লেখাটা...
আপনার লেখা অনেক সাবলীল... সিরিজটা চলুক
ধন্যবাদ, জেবীন।
এই সিরিজ থামলে যারা শর্মি আপারে মাইর দেওয়ার চিন্তা করতেছেন, তাগো দলে নাম লেখাইলাম।
আমার খুব কাছের এক বন্ধুর সাথে আপনার বাবা-মার মিল আছে।
দুজন দু ধর্ম থেকে আসা - সুন্দর সহাবস্থান - মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচয় - পিতা মুক্তিযুদ্ধে চলে যান - যুদ্ধের ২/৩ বছর পালিয়ে বিয়ে - এখন সুখে শান্তিতে বসবাস - দু বাড়ীতেই যাওয়া আসা খুবই সুন্দর ভাবে - নতুন মুসলমান হবার কস্ট/যাতনা/আশা পাশ থেকে উটকো ঝামেলা -- ইত্যাদি ইত্যাদি।
লেখাটা ভালো লেগেছে।
বাহ, জেনে ভালো লাগলো আপনার বন্ধুর কথা, ওনার জন্য শুভেচ্ছা। আর আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
সেইরকমের ঘটনাপ্রবাহ ... লাইনে দাড়াইলাম, সিরিঝ চলতে থাকুক... ইন্ট্রেস্টিং সব ব্যাপার... দেখি ঘটনা কোনদিকে যায়...
লাইনে দাঁড়ানোর জন্য ধন্যবাদ। সিরিজ চালানোর সদিচ্ছা আছে। যখন লেখা শুরু করেছিলাম, তখন একটা একটা বিষয় ছিল মাথায়, লিখতে লিখতে সম্পূর্ন অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। স্মৃতি'র তারল্য দারুন একটা ব্যাপার, কোত্থেকে কোথায় যে গড়াবে, বলা মুশকিল। আমিও চিন্তায় আছি,লিখতে লিখতে ঘটনা কোথায় যায়!
সেজন্য কোনো অসুবিধা নাই। আপনার ওড টু মাই ফ্যামিলি'র পরের পর্ব কবে আসবে? শুনছেন...
বিশাল একটা পরীক্ষা ছিল, তাই লিখতে পারিনাই।
আগামী পর্ব দ্রুতই আসবে।
sharmee, tumi to dekhi natural born writer!! ai protiva niye tumi ato din amader moto foul polapaner majhe chila??!! pore valo laglo. continue koro jodi time pau...ami at least regular porbo...carry on!!
Asif
ধন্যবাদ আসিফ! প্রশংসা শিরোধার্য।
আপনি কি আমাদের শর্মি আপু? মানে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের?
তাই তো মনেহয়।
পড়ছি
ধন্যবাদ।
আপু, আসাধারণ। এক কথায় অসাধারণ। এক নিঃশ্বাসে এখনই সবগুলো পড়ে শেষ করছি।
ধন্যবাদ!
মন্তব্য করুন