ইউজার লগইন

বদরুলের যাপিত জীবনের অবশিষ্টাংশ [গল্প]

প্রায় দিন সকালে ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথেই কোন না কোন গানের দুই লাইন মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে বদরুলের। সারাদিনেও সেই লাইন গুলা মাথা থেকে নামেনা। গুন গুন করে আপন মনেই গাইতে থাকে, পরে আবার খেয়াল হলে বন্ধ করে দেয় গান গাওয়া। ছাত্র বয়সে একটু আধটু গান গান শিখেছিল , গলায় ভালই সুর তুলতে পারে কিন্তু গান গাইবেনা ঠিক করেছে, তাই এই গান থামিয়ে দেওয়া।

জানালার গ্রীলে দুই পা উচু করে দিয়ে, হাত দুইটা ভাঁজ করে মাথার নিচে দিয়ে "জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা" গাইছিল বদরুল। আজো সকালে ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথেই লালন সাহেবের এই গানটা মাথার ভিতর ঘুরতেছে তার। ঘরের দরজা আটকানো, মাথার উপর পুরনো সিলিং ফ্যান টা ঘুরতেছে ঠিকই কিন্তু তার বাতাস আর শরীর পর্যন্ত পৌছায় না। ঘরের ভিতর ভ্যাপসা বোঁটকা গন্ধ, ঘামের গন্ধ মিলায়ে গা গুলানো পরিবেশ , তবু সবকিছুই এখন সহ্য হয়ে গেছে বদরুলের। জীবনের ভার টেনে নিইয়ে যাওয়াটা এখন মুখ্য, পরিবেশ না।

খেয়াল হতেই যথারীতি গান থামিয়ে দেয় বদরুল। এইসব আধ্মাতিক গানের কথা বার্তা এখন আর ভিতরেও পৌছায় না। গানগুলো সাগরের ঢেঊয়ের মত তার বুকের বেলাভূমিতে বার বার আছড়ে পড়ে , ঢেউয়ের মত ফিরে যায় আবার। শুধু সেই স্রোতে জোয়ার নেই, কেবলই ভাটার টান।

সময় টা সময়ের মত চলে যাচ্ছে কিন্তু জীবন যেন এসে আটকে গেছে বদরুলের। সারাদিন এই ঘরের ভিতরেই সময় কাটায় বদরুল। সন্ধ্যা নামলে কোনমতে খেয়ে বাসা থেকে বের হয় আড্ডায় , অনেক রাতে আবার ফিরে।

বদরুলের বাবা রিটায়ার্ড করেছেন অনেক বছর হল, তার মা'র ও বয়স হয়েছে, শরীর টা ভেঙে পড়ছে একটু একটু করে, ভেঙে পড়া মানুষের মত করে। বদরুলের বাবা সরকারী চাকুরী করতেন, চাকুরী করেই জায়গা কিনে বাড়ীটা কোন মতে করেছিলেন। টিনশেড আধা পাঁকা বাড়ী। পরে আর মেইন্টেনেন্স করা হয়নি বলে বাড়ীটার দেয়াল থেকে প্লাষ্টার খসে খসে পড়ছে, পুরনো ইট গুলো যেন দাত কেলিয়ে উপহাস করে সারাক্ষন। নোনা ধরেছে একপাশের দেয়ালে, নোনার দাগ গুলো মানচিত্রের মত একিয়ে বেকিয়ে গেছে দেয়াল জুড়ে। টিনের স্ক্রু গুলো থেকে বৃষ্টি হলে চুইয়ে চুইয়ে পানি ঢুকে ঘরের ভিতর, ঘরের ভিতর পানিতে ভেসে যায় , ভেসে যাওয়া স্বপনের মতই। বদরুলের জীবনের মতই দরজার নিচের অংশ ক্ষয়ে গেছে , সন্ধ্যা হতেই চিকারা মনের আনন্দে ঘরে ঢুকে আর বের হয়, বৃষ্টি হলে পানির ছিটা আসে, শীতে ঠান্ডা ঢুকে , কষ্টের মতন।

একটা সময় বদরুল রাজনীতি করতো, স্বপ্ন দেখতো দিন বদলের, সাম্যের, প্রতিরোধের। লেখাপড়াও শেষ করতে পারেনি সে স্বপ্নে দেখার মিছিলে ভেসে গিয়ে কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই রাজনীতি আর সেই স্বপ্ন বদরুল কে ছেড়ে ঠাঁই নিলো হিমালয়ের কোন এক হিমবাহে। সেখানে মৌসুমী বাতাসের মত দখল করে নিল বড় হবার স্বপ্ন, প্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন। অনেক উচুতে উঠার স্বপ্ন, যত উচুতে উঠলে আশে পাশের মানুষদের কে পিপড়ার মত ছোট লাগে, ঠিক ততখানি উচুতেই উঠার স্বপ্ন গ্রাস করে নিল তাকে।

সেই স্বপ্নের পথ ধরতে বাবার পেনশনের টাকায় ব্যবসায়ে নামলো সে। অনভিজ্ঞ ব্যবসায়ী হয়ে মাঠে নেমে তাকে পদে পদে অভিজ্ঞ, পাঁকা , ঝানু খেলয়াড় এর মত ব্যবসায়ী প্রতিযোগিদের সাথে খেলতে খেলতে আর টাউট বাটপার দের পাল্লায় পড়ে অভিজ্ঞতা অর্জন হল পুঁজির বিনিময়ে । যখন সে ব্যবসায়ের অলি গলি সব চিনলো, আশে পাশের মানুষ দের কে জানলো তখন দেখে তার কাছে আর একটা টাকাও অবশিষ্ট নাই।

নিঃস্ব কপর্দক হীন হয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াতে চাইলো বদরুল , ধার কর্জ করে। কিন্তু কোমর ভাঙা লোককে কে আর ধার দিবে এই যুগে ? অগত্যা স্বপ্ন গুলো মেঘেদের দেশে বাসা নিলো, বিশ্বাস টুকু যা ছিল, বাষ্প হয়ে উড়ে গেছিল সাথে সাথেই। সেই সাথে বাবা-মা'র করুন চাহনী, তাদের দীর্ঘশ্বাস, নিরব মেনে নেয়া, কষ্টের সাথে বসবাস - বদরুল কে প্রতিনিয়ত ডাকতো পরপারে। নিজেদের বাড়ীর দুই/তিনটা রুম ভাড়া দিয়ে কোন মতে অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা হয়তো হয়েছে কিন্তু এই পোকা মাকড়ের মত বসবাস - টিপ টিপ করে যাপিত জীবন - সময় টুকু পার করে দেয়া - এক অপরাধ প্রতিনিয়ত বদরুল কে ধর্ষন করে চলে।

সারাদিন তাই ঘর থেকে বের হয় না সে, সূর্যের আলোর সাথে শত্রুতা করেছে যেন সে !!! দিনের আলোয় এক ব্যার্থ মানুষের চেহারা দেখানো যেন ঘোর অপরাধ !!! বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা হয় , বদরুল তার ঘর ছেড়ে আস্তে আস্তে গিয়ে বসে এক বন্ধুর ফার্মেসী তে। প্রতিদিন একই নিয়মে সময় কাটায় সেখানে। আরো কয়েকজন বন্ধু আসে সেখানে। কেউ চাকরী করে কেউ ব্যবসা করে , বদরুল চুপ করে শুনে তাদের কথা, মাঝে মাঝে চেষ্টা করে সেই আড্ডায় তার কন্ঠ টা শোনানর। আর অপেক্ষায় থাকে কখন কোন বন্ধু সিগারেট খেতে খেতে তাকে একটু এগিয়ে দিবে শেষের দিকের সিগারেট , তার জীবনের অবশিষ্টাংশের মত আর তাতে টান দিয়ে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজবে সে ।

পোস্টটি ১১ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

মলিকিউল's picture


পরে পড়ুম। খেলতে যাই।

সাঈদ's picture


ভাই , কি খেলেন আবার ???

মলিকিউল's picture


বিকেলে ফুটবল, রাইতে ব্রিজ.......।

 

গল্প উমদা হৈছে।

সাঈদ's picture


ছুডবেলায় আমরাও ঐরাম খেলাধূলা করতাম... খিকজ

মলিকিউল's picture


আফনে বড় হৈছেন সেইটা আজই জানলাম।Tongue out

অরিত্র's picture


খুব দ্রুতই শেষ হয়ে গেল।

ভাল লেগেছে। নিয়মিত পড়তে চাই

সাঈদ's picture


আশা করি নিয়মিত হতে পারবো। ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ।

নজরুল ইসলাম's picture


ভালো লাগলো বদরুলের যাপিত জীবনের গল্প...

সাঈদ's picture


ধন্যবাদ ভাই।

১০

জ্যোতি's picture


ভালো লেগেছে খুব।কিছু কিছু কথা মনের ভিতর খোঁচা দিয়েছে।

১১

সাঈদ's picture


শুনে ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

১২

টুটুল's picture


আপনার্তো মিয়া রেগুলার লেখা দর্কার ... ফাকি দেন ক্যান?

ভাল্লাগ্ছে :)

১৩

সাঈদ's picture


Coolপ্রিত হইলাম শুইনা।

১৪

জ্যোতি's picture


হেতে বিরাট ফাকিবাজ।চা খেতে না দিয়ে খালি হাক ডাক দিয়া ফুরুত।

১৫

সাঈদ's picture


কালকে যে চা দিলাম দুধ চিনি চা পাতা ছাড়া এক মগ গরম গরম চা।

১৬

হাসান রায়হান's picture


ভালো লাগলো খুব। অনেক ধন্যবাদ।।

১৭

সাঈদ's picture


ভালো লাগলো জেনে আমারো ভালো লাগলো।

কেমন আছেন ভাই ?

১৮

লোকেন বোস's picture


সুন্দর গল্প... আরো লিখুন প্লিজ

১৯

সাঈদ's picture


ধন্যবাদ । ইনশাল্লাহ লিখবো।

২০

সোহেল কাজী's picture


দারুন্স লাগলো ভাইডী। Laughing

বহুত দিন পর আপ্নের একটা সেইরাম লেখা পড়লাম।

২১

সাঈদ's picture


তোমার লেখাও অনেক মিছাইতাছি, জলদি একটা ছাড়ো।

২২

সোহেল কাজী's picture


শরীর মন দুনটাই খারাপ। কয়েকদিন টাইম লাগব ক্যাপচার করতে তখন দেমুনে Tongue out

২৩

সুমনা's picture


একদম মারহাবা টাইপ লেখা হইছে।

২৪

সাঈদ's picture


< মুখ ভ্যাটকানো টাইপ ইমো হইপে , কিন্তু এখানে নাই। >

২৫

টুটুল's picture


pirate*day dreaminglaughingbig grinrolling on the floor

২৬

সাঈদ's picture


২৭

পদ্মলোচন's picture


মেলা দিন পরে সাঈদ ভাই প্রোডাকশনের একটা লেখা পাইলাম।

২৮

সাঈদ's picture


আবার হৈপে...

২৯

কাঁকন's picture


ভালো লাগলো

 

অট:উমদা মানে কি?

৩০

সাঈদ's picture


ভালো লাগলো শুনে ভালো লাগলো।

উমদা মানে "মোটামুটি" জাতীয় কিছু জিনিস হবে মনে হয় ।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

সাঈদ's picture

নিজের সম্পর্কে

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায়।

আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মত দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না।
কী করে তাও বেঁচে আছি আমার মতো। অবাক লাগে।