ফিরে দেখা
২০১৩ সাল ছিলো নাগরিক অসন্তোষের বছর, বছরের শুরুতেই কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায়ে ক্ষুব্ধ তরুণেরা শাহবাগ মোড় দখল করে নেয় ফাঁসীর দাবীতে। শাহবাগ মোড় প্রজন্ম চত্ত্বরে পরিণত হওয়ার পর টানা ৩ সপ্তাহ সাধারণ মানুষ শাহবাগ মোড় অবরুদ্ধ করে রাখে।
সাঈদীর ফাঁসীর আদেশে আদালত লিখেছিলো ধর্মবেত্তা দেলোয়ার হোসেন সাঈদী নয় বরং আদালত একজন মানবতা বিরোধী অপরাধী দেইল্যা রাজাকারকে ফাঁসী দিচ্ছে- যদিও আদালতের রায়ে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ভিন্ন দুটো পরিচয় লিপিবদ্ধ করার কোনো প্রয়োজন ছিলো না কিন্তু তারপরো গুজব ছড়িয়ে পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। এপ্রিলে হেফাজতে ইসলামী ইসলাম রক্ষার দাবীতে এবং বাংলাদেশে এক ধরণের ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের দাবীতে ঢাকা মার্চ শুরু করে- সরকার নিজেই ঢাকাকে অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং হেফাজতে ইসলামী ১৩ দফা ঘোষণা করে এক মাসের সময়সীমা বেধে দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে।
পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে বিরোধী দলীয় জোট সহিংস আন্দোলন শুরু করে কিন্তু পাবলিক পার্টিসিপেশন বিবেচনা করলে শাহবাগের অহিংস গণজাগরণ এবং হেফাজতের অহিংস ইসলামী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আন্দোলনের চেয়ে বিরোধী দলের সহিংস আন্দোলনের জনসম্পৃক্ততা ছিলো কম।
এক বছর পর শাহবাগ গণজাগরণ যাদুঘরের প্রধান ফটকের সামনে এবং হেফাজতে ইসলামীর ইসলামী বাংলাদেশ নির্মানের লড়াইটা হাটহাজারী মাদ্রাসার সীমানা প্রাচীরে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় বিদ্যমান।মাঝেমাঝে ফোঁসফাঁস করলেও ঢুঁস মারার জনসমর্থন হারিয়েছে দুটো আন্দোলনই।
যদি অংশগ্রহনকারীদের সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করা হয় তাহলে শাহবাগ গণজাগরণ মূলতঃ শহুরে শিক্ষিত স্বপ্নাভিলাষী মধ্যবিত্ত মানসিকতার তরুণদের আন্দোলন। শাহবাগ গণজাগরণে তাদের আত্মপরিচয় সংকটটুকু তারা তীব্রভাবে অনুভব করেছে। আন্দোলনের মাঝপথে বাঙালী মুসলমান থেকে তারা অবলীলায় মুসলিম বাংলাদেশী পরিচয়ে স্থিতু হয়েছে। শাহবাগ গণজাগরণের পর এদের সমর্থনে যারা গণমাধ্যমে শোরগোল তুলেছেন এদের প্রত্যেকেরই একধরণের সামাজিক ক্ষমতা এবং সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা ছিলো। মোটা দাগে মধ্যবিত্ত রুচিকে ধারণ করা এবং মধ্যবিত্ত রুচি- মধ্যবিত্ত মানস নির্মাণ করা সংস্কৃতিকর্মীরা সবাই শাহবাগ গণজাগরণকে সমর্থন করেছেন।
অন্য দিকে হেফাজতে ইসলামীর উত্থান ছিলো ইনভিজিবল মাইনরিটির অস্তিত্ব ঘোষণা- তারা সমাজেও দৃশ্য অবস্থায় সব সময়ই উপস্থিত ছিলো কিন্তু এই গণপিন্ডের কোনো সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিলো না- এই অদৃশ্য সংখ্যালঘু যখন নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিলো, দেখা গেলো দৃশ্যমান এদের কোনোভাবেই সংখ্যালঘু বলা যায় না, বরং তাদের পাওয়ার মাইনরিটি হিসেবে অভিহিত করা যায়- এরা ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না , ক্ষমতারটানাটানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে বড়জোর। এদের নেতৃত্বে যারা ছিলো ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তাদের রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতিতে এদের তেমন কোনো কতৃত্ব নেই।
ইনভিজিবল মাইনরিটি এবং মধ্যবিত্ত অভিলাষী তারুণ্যের মাঝখানে বিশাল এক দল শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। সীমিত অংশগ্রহন বাদ দিলে এই বিপুল জনগোষ্ঠী কি কখনও মনে করেছে হেফাজত কিংবা শাহবাগ তাদের জীবনের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন করছে? ডিড দে এভার ফেল্ট দ্যাট দে আর ফাইটিং ফর দেয়ার কজ? আন্দোলন দুটোকে শাহবাগ যাদুঘরের গেটে আর হাটহাজারী মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে অবরুদ্ধ হতে দেখে মনে হচ্ছে শ্রমজীবী বাংলাদেশী মানুষেরা এই দুই আন্দোলনে নিজেদের উদ্দেশ্যপূরণের কোনো সম্ভাবনা খুঁজে পান নি।
ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনৈতিক দলগুলো শাহবাগের গণজাগরণ এবং হেফাজতে ইসলামীর ইসলামী বাংলাদেশ নির্মানের অবস্থান ধর্মঘটকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে। শাহবাগের কেন্দ্র( মুখপত্র এবং গণমাধ্যমের কল্যানে গুরুত্বপূর্ণ হয়েওঠা ডিসিশন মেকিং বডি হিসেবে বোয়ান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর সভাপতি সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে গঠিত সাময়িক আন্দোলন পরিকল্পনা সেল) নিয়ন্ত্রনে সরকারের উদ্যোগ কেমন ছিলো পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি এবং আন্দোলনকালীন স্মৃতিচারণে ভবিষ্যতে কোনো একটা সময় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বিরোধী দল কোনোভাবে এই কেন্দ্রে প্রবেশ করতে চেয়েছিলো কি না কিংবা আর্থিক প্রলোভনের পরিমাণ কতটা ছিলো এবং কোনো প্রমাণ আছে কি না সেটাও জানা যাবে কারণ আন্দোলনের সাথে ঘনিষ্ট সম্পৃক্ত মানুষগুলো ছাপার অক্ষরে কোনো না কোনো দিন এসব প্রকাশ করবে।
হেফাজতে ইসলামীর নেতাদের সাথে বিরোধী দলের সম্পৃক্ততার যত সংবাদ গণমাধ্যমে এসেছে সেটাকে আমলে এনেও বলা যায় হেফাজতের এপ্রিলের ঢাকা কর্মসূচিতে সরকালের নিস্পৃহ নির্লিপ্ত সহানুভুতিমূলক অবস্থান আসলে আন্দোলনের প্রতি সরকারের প্রশ্রয় এবং পক্ষপাতিত্বের নিদর্শন। সরকার নিশ্চিত ছিলো এই আন্দোলন এই ১৩ দফা ঘোষনায় সাময়িক স্থগিত হবে। সরকারের তরফ থেকে কারা হেফাজতে ইসলামীর সাথে যোগাযোগ রাখতো- তারা কি কি ধরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো এসব কখনও জানা সম্ভব হবে না।
মে মাসে শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতের অবস্থান ধর্মঘটের হুমকি এবং সরকারের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হয় সরকার অবস্থান ধর্মঘটের জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। তারা ভেবেছিলো গতবারের মতো এবারও হেফাজতের লোকজন সরকারের সাথে সহযোগিতা করবে- তেমনটা ঘটে নি। আল্লামা শফী সাহেব সরকারের সাথে আলোচনা করে চট্টগ্রামগামী হেলিকপ্টারে উঠে গেলেন- তাকে কি কি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো তা আমরা জানবো না- এই ইনভিজিবল মাইনরিটি নিজেদের বানী নিজেরা সম্প্রচার করতে পারে না। তাদের নেতৃত্বে যারা আছে তারা যদি এমন কোনো ষড়যন্ত্র কিংবা আপোষের সংবাদ প্রকাশও করে মধ্যবিত্ত গবেষক পর্যন্ত তা আদৌ পৌঁছাবে কি না এটা নিয়ে আমি সন্দিহান।
শাহবাগ আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িত মানুষেরা অন দ্যা রেকর্ড সাক্ষাৎকারে যা বলে অফ দ্যা রেকর্ড তারা ভিন্ন একটা বক্তব্য দেয়- এই লুকোচুড়ি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক আন্দোলনচিত্র উপস্থাপনের দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে। যদিও খুব বেশী স্পষ্ট হয় ওঠে না কিন্তু এই ধরণের স্মৃতিচারণ এবং সাক্ষাৎকারে শাহবাগ গণজাগরন সম্পৃক্ত মানুষদের মানসিক অবয়বটা কিছুটা প্রকাশ পায় কিন্তু হেফাজতে ইসলামীর উত্থান নিয়ে কিংবা এই ইনভিজিবল মাইনরিটির উত্থান নিয়ে সাক্ষাৎকারভিত্তিক কোনো প্রকাশনার আগ্রহ আমি দেখছি না। শফীপূত্রের ধন সম্পদের সংবাদ দিয়ে এক ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে কিন্তু শফী পূত্রের ধন সম্পদ কতটা সরকারী অনুদান আর কতটা বিদেশী অনুদান সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাচ্ছে না।
আন্দোলনের ধরণ জনসমর্থন বিবেচনা করলে বলা যায় বাংলাদেশের মানুষজন এখন মোটা দাগে অহিংস আন্দোলনকে বেশী গ্রহনযোগ্য ভাবছে। রক্তপাত - সহিংসতা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ালেও ক্রমাগত সহিংসতা কিংবা ধারাবাহিক উগ্রতা সাধারণ মানুষের পছন্দ নয়। আন্দোলনে অসন্তোষ বৃদ্ধির জন্যে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে রক্তপাতের গুজব রটানো, ভাঙচুড়ের উস্কানি দেওয়া কয়েকজনের ব্যক্তিস্বার্থকে পূরণ করলেও অধিকাংশ সময়ই তা গণের উদ্দেশ্য পুরণে বাধা তৈরী করে-
#### অহিংস গণজাগরণ এবং অহিংস ধর্ম হেফাজতের লড়াই ###
দিনের শেষে সবাই শানতিতে ঘুমাতে বাড়ি ফিরতে চায়
মন্তব্য করুন