পবিত্র মাস
রোজার সময় একান্ত বাধ্য না হলে বাসার বাইরে যেতে ইচ্ছা করে না। জীবন যাপন সংস্কৃতির উপরে গণমানুষের বিশ্বাসের আরোপ আমার ভেতরে যে মানসিক পীড়ন তৈরী করে তা প্রতিমুহূর্তেই উপলব্ধি করি। শুধুমাত্র এই একটি মাস আমাকে কোনো একটা সভ্য দেশের বাসিন্দা হিশেবে জীবনযাপন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তোলে।
পরধর্ম সহিষ্ণুতা, অপরের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ করা, অপরের ধর্মীয় অনুভুতিকে যতটা সম্ভব আহত না করে নিজের জীবনযাপন সংস্কৃতি অক্ষুন্ন রাখবার কোনো সুযোগ থাকে না এই মাসটিতে। সকল নাগরিক সভ্যতাবোধ ঘাড়ের উপরে তার অনিবার্যতা সমেত চেপে বসে। এই একপাক্ষিক পরমত, পরসংস্কৃতি, পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার বোঝা বহন করতে ক্লান্ত লাগে এই বয়েসে।
প্রতি বছর নতুনভাবে উপলব্ধি করি সংখ্যাগুরুকে তুষ্ট করতে গিয়ে আমরা বাংলাদেশে যে সামাজিক সংস্কৃতি তৈরী করেছি সেখানে সংখ্যালঘু মানুষের জীবনযাপন আক্রান্ত না হলেও তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অনেকাংশেই ব্যহত হয়। এই সামাজিক সংস্কৃতি অপর ধর্ম বিশ্বাসের অস্তিত্ব স্বীকার করে না, বরং সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতিকে অবশ্যপালনীয় করে তোলে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই উপলব্ধি করি সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতির চাপে পিষ্ট হতে থাকা জীবন খুব বেশী উপভোগ্য না। টানা এক মাস এক ধরণের কারাবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে আবির্ভুত হয়।
অতিআবশ্যিক ভাবে এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র অসন্তোষ প্রকাশ করলে শুনতে হয় মাত্র একটা মাসই তো মানিয়ে নিলেই হয়।সমঝোতা করো, মানিয়ে নাও,মিলেমিশে থাকতে চেষ্টা করো- একটা মাস একটু প্রকাশ্যে না খেলে কি ক্ষতি হয়? মানিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে সমস্যা সম্ভবত এই এক মাস প্রকাশ্যে পানাহার এক ধরনের সামাজিক অপরাধ হিশেবে গণ্য হওয়া। অতিউৎসাহী- অতি উগ্র কেউ কেউ এই সামাজিক অপরাধের জন্যে মৃদু প্রহার এবং হেনেস্তা করতেও দ্বিধাবোধ করে না। যারা অতি উৎসাহী তারা ব্যক্তিগত ধর্ম পালনের উৎসাহে যে অন্য একজন মানুষের ধর্ম-অধর্ম পালনের স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ করলেন এই বিষয়টা তারা সচেতন ভাবে উপলব্ধি করেন না। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রশ্নে অবিবেচক সামাজিক সংস্কৃতিকে অধিকতর প্রশ্রয় দেওয়া একটি রাষ্ট্র কখনও সভ্য রাষ্ট্র হিশেবে গণ্য হতে পারে না।
খুব বেশী স্বচ্ছলতা না দিলেও শিক্ষকতা পেশার কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। গত কয়েক বছর সরকারী উদ্যোগে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত আরও কিছু বাড়তি সুবিধা তৈরী করেছে। রোজার মাসটাতে নির্বিঘ্নে ঘরে কাটানো যাচ্ছে। এমনিতেই গণপরিবহনের ভীড়, অনেক মানুষের ঘামের গন্ধ এক ধরণের অসস্তি তৈরী করে- তবে শহরের দুরবর্তী অঞ্চলগুলোতে যাতায়তের জন্যে গণপরিবহনের বিকল্প সাশ্রয়ী কোনো যানবাহন এখন সহজলভ্য না। ফলে পকেটের অবস্থা বিবেচনা করে অনেক সময়ই গণপরিবহনে উঠতে হয়।
অপরিচিত মানুষের ভীড়ের সাথে রোজার মাসের বাড়তি সংযোজন মানুষের ক্ষুধার গন্ধ। অসংখ্য মানুষের ক্ষুধার কুৎসিত গন্ধ বাসের ভেতরে ভাসতে থাকে, দিন যত সন্ধ্যার দিকে আগায় গন্ধের তীব্রতা তত বাড়ে, ক্ষুধার্ত মানুষের অসহিষ্ণু ক্রোধ , অস্থিরতার সাথে তার ক্ষুধার গন্ধ মিলে মিশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরী হয় সেটার সহজ বিকল্প পায়ে হাঁটা।
কয়েক দিন আগে নিতান্ত বাধ্য হয়েই মতিঝিলে গেলাম, ফেরার পথে মনে হলো ছেলের জন্যে কিছু খাওয়ার কিনবো। পল্টনের কেএফসি থেকে খাওয়ার কিনে বাসে ওঠা যায়, এক দল ক্ষুধার্ত মানুষের ভেতরে সুস্বাদু খাওয়ারের গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে দীর্ঘপথ বাস ভ্রমন চমৎকার হতে পারতো , পরে মনে হলো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি যেমন তাতে ভর দুপুরে এইসব খাওয়ার নিয়ে পাবলিক বাসে চলাচল করলে পাবলিকের কটু মন্তব্য শুনতে হবে- সেটার পালটা প্রতিক্রিয়ায় আমি বলে বসবো ভাই আমি তো আমার ছেলের জন্যে নিয়ে যাচ্ছি- আপনাকে তো খেতে অনুরোধ করছি না। আপনি আপনার সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্যে ইবাদত হিশেবে না খেয়ে আছেন, আমার ছেলে তো তা করছে না।
পুরো বাস দুই ভাগ হয়ে যাবে, আমার ভাগে হয়তো দুই একজন সহানুভুতিশীল ব্যক্তি পাওয়া যাবে কিন্তু "আপনি আপনার সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্যে" উচ্চারণের জন্যে আমাকে শুনতে হবে আপনার সৃষ্টিকর্তা বললেন কেনো- আপনি কি মুসলমান না? আপনার নাম কি? আপনি কি বাংলাদেশে নতুন আসলেন? প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে গায়ের চামড়া অক্ষত রেখে বাস থেকে নামা সম্ভব হবে না।
কেএফসি বাদ দিয়ে হাতিরপুলের শরমা হাউজ থেকেই কিছু কিনে নেওয়া যায়, ইউনিভার্সিটির ভেতর দিয়ে গেলেই হবে, হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটি পার হয়ে শরমাহাউজে এসে দেখলাম শরমা হাউজ বন্ধ। বিকেল বেলা ইফতারি বিক্রীর সময় দোকানটা খুলবে। ব্যক্তিমালিকানাধীন যেকোনো প্রতিষ্ঠান তার মালিকের মর্জিমফিক চলবে, আমি একজন নগন্য কাস্টমার, আমার ক্ষুধানিবৃতির দিনব্যাপী আগ্রহ রোজার মাসে যদি কমে যায় সেটা নিয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা যায় কিন্তু তাকে দোকান খোলা রাখতে বাধ্য করা যায় না। পরবর্তী গন্তব্য বসুন্ধরা সিটি, সেখানে ফুডকোর্টে সারাদিন খাওয়ার বিক্রি হয়। সাততলা উঠে খাওয়ার নিয়ে আবার নীচে নামবো না কি স্টার থেকে কাচ্চি কিনে নিবো ভাবনাটা স্টারকে প্রাধান্য দিলো, স্টার থেকে কাচ্চি কিনে হাঁটতে হাঁটতে বাসায় ফিরলাম।
অন্য একদিন ছেলে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছি অন্য একটি খাওয়ার দোকানে। রমজান উপলক্ষ্যে তারা বিশেষ ইফতার প্যাকেজ দিচ্ছে, সকল কর্মচারী ইফতারির স্তুপের সামনে বসে আছে, কিছু খাওয়ার কিনে খেয়ে ফেলবো এমন বাসনা ছিলো মনের ভেতরে- খাওয়ার কিনলাম, তারপর কর্মচারী বললো, স্যার মাগরিবের আজানের আগে এখানে কিছু খাওয়া নিষেধ। এখানে খাওয়া যাবে না। প্রতিষ্ঠানের নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, আমি দোকান থেকে খাওয়ার কিনে দোকানে বসে খেতে পারবো না বিষয়টা যদিও এক ধরণের হয়রানি তারপরও সেটা মেনে নিতে হবে।
প্রতিবারই এমন এক একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই, প্রতিবারই নতুন করে ভাবতে বাধ্য হই অধিকারহরণের সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা তৈরী হলে মানুষ কতভাবে স্বাধীন জীবনযাপনের অধিকারবঞ্চিত হয়।
সমস্ত কিছুতেই আমাদের লোক দেখানো ভন্ডামী শতভাগ মাত্রায় উপস্থিত!
সংখ্যাগরিষ্ঠের জীবনযাপন, সংস্কৃতি সংখ্যালঘিষ্টের জীবনাচার ও মনোজগতে কেমন প্রভাব পড়ে, আদৌ পড়তে পারে কি না, সেটা নিয়ে আমরা ভাবি না। ভাবতে চাই না। এটা এক আশ্চর্যরকম অনুভূতি আমাদের। আমরা সংখ্যাতত্ত্বিক গণতন্ত্র এর ধারণা (ভুল ধারণা) দিয়ে জায়েজ করার চেষ্টা করি।
রমজান মাসের অসহিষ্ণুতা দিনে দিনে আরো প্রকট আকার ধারন করছে।
মন্তব্য করুন