ভাষা সংশয়
ভাষার গাঠনিক কাঠামোতে এক ধরণের সারল্য আছে। শব্দের পর শব্দ জুড়ে অর্থদ্যোতনা তৈরীর প্রক্রিয়াটিতে গাণিতিক ধাঁচ আছে কি না গত শতকের মাঝামাঝি এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন ভাষাবিজ্ঞানীরা। শিশুরা যেই পরিবেশেই বেড়ে উঠুক না কেনো তাদের গঠিত বাক্যগুলো নির্দিষ্ট একটি অর্থবোধকতা তৈরী করে। "সবুজ রঙ এর স্বাদ চাঁদ" এমন বাক্য কাঠামো উত্তরাধুনিক কবি এবং ভাষাতত্ত্ববিদেরাই নির্মাণ করে, স্বাভাবিক শিশুরা এসব সংকট থেকে মুক্ত। এই বাস্তবতাকে কেন্দ্রে রেখে নোয়াম চমস্কি ভাষার ভেতরের অন্তর্নিহিত ধাঁচের একটা সাধারণ সূত্র অনুমাণ করেছেন- সেটার পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য বিতর্ক আছে। এতসব বিতর্কের পরেও অস্বীকার করা যাবেনা মানুষের ভাষা ব্যবহারের ধাঁচে আঞ্চলিক পার্থক্য থাকলেও সেই ভাষাভাষী প্রতিটি শিশুই একই প্রকরণ মেনেই ভাষার ব্যবহার শিখে যায় শৈশবে।
কাঠামোগত তফাতটা খুব বেশী প্রকট ভাবে উপস্থাপিত হয় যখন একটি প্রবাসী শিশু নিজের ভাষা খুঁজে কিংবা যখন ভিন্ন কাঠামোর একটি ভাষায় তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় এবং সেই আরোপিত ভাষায় তাকে নিজের ভাবনা গঠন করতে হয়।
ইংরেজী আর বাংলা ভাষায় ক্রিয়াপদের ব্যবহার, কর্মবাচ্যের উপস্থাপন এইধরণের কিছু তফাত আছে। সাহিত্যে-নাটকে যে মাণ ভাষা মোটামুটি প্রচলিত সেই আধুনিক বাংলা গদ্য ভাষাটা অষ্টাদশ শতকে নির্মিত হয়েছে, সেই নির্মাণের ফলে আমাদের ভাষা কাঠামো অনেক বেশী সরল। ঐতিহ্যের দায় তাকে বহন করতে হয় না, প্রামাণ্য অতীত উদাহরণ প্রায় অপ্রচলিত হওয়ায় সেই কাঠামোকে নতুন করেই উদ্ভাবন করতে হয়েছে। এক শতাব্দীতে ভাষা বেশ কয়েকবার বাঁক বদল করে বঙ্কিম- মধুসুধন- বিহারীলাল-রবীন্দ্রনাথ-অক্ষয় কুমার এবং এমন অসংখ্য ভাষাজীবী মানুষদের কল্যানে একটা নির্দিষ্ট আকার পেয়েছে। ফলে বাংলা আঞ্চলিক ভাষায় ইংরেজী ভাষার মতো না-বোধক অব্যয়- না-বোধক প্রত্যয় ক্রিয়াপদের আগে ব্যবহারের রীতিটা ততটা আদরনীয় হয়ে উঠে নি। মুই ন যাইয়ুম আঞ্চলিক ভাষায় তেমন সমস্যা তৈরী না করলেও মাণ ভাষায় এবং মাণ ভাষার প্রাবল্যে লোক ভাষ্যে "যাবো না", "করবো না" ধাঁচের বাক্য কাঠামো বেশী প্রচলিত হয়েছে।
বাংলা ভাষার এই আরোপিত রীতিতে আমরা মোটামুটি শিক্ষিত মানুষেরা নিজেদের উচ্চারণের আঞ্চলিকতাসমেত কথা বলে অভ্যস্ত। একেবারে গোঁজামিল একটা ভাষা পরিস্থিতিতে জন্ম নেওয়ার পর ঋকের নিজের কথ্য ভাষা খুঁজে নিতে প্রায় ৩০ মাস সময় লেগেছে। মাঝের সময়টাতে বাবা মা দাদা জাতীয় একক শব্দের বাইরে বড় একটা বাক্য তৈরীতে তাকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয়েছে। বাংলা ভাষায় বাক্য ব্যবহার বিধি চর্চার অভ্যস্ততা হওয়ার আগেই ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষা শুরু করায় এখন তার বাংলার ভেতরে ইংরেজী কাঠামো প্রবল-
আমি এটা দেখার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না - বাক্যটার প্রতিটা শব্দ বাংলা হলেও এটা কোনো বাংলা অনুভুতি প্রকাশ করে না। আমাদের মতো বাঙালের জন্যে ঋকের সাথে কথা বলাটা কিছুটা কঠিন। তার সকল অনুভুতির অর্থ খুঁজতে এক ধরণের অনুবাদপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয় আমাদের।
আনন্দিতার ক্ষেত্রে এই সংকট তৈরী হয় নি। ও পুরোপুরি বাঙাল পরিবেশেই জন্মেছে- সারা দিন আশেপাশে বাংলা ভাষাই শুনেছে। এখনও স্কুল শুরু করে নি তাই স্কুলের ভাষাবিধি তার শব্দ ব্যবহার, বাক্যগঠন প্রক্রিয়াকে এখনও প্রভাবিত করে নি।
বাংলা ভাষার শিশুতোষ কবিতার বিয়েপ্রীতিপ্রবল ( অধিকাংশ ছোটোদের ছড়া মানেই বিয়ের আয়োজন, নইলে সন্তানের প্রতিপালনের বর্ণনা) । একই সাথে এই ধরণের শিশুতোষ ছড়া-কবিতা সহজলভ্য নয়, ফলে আনন্দিতার ক্ষুদ্র জীবনের অধিকাংশ সময়ই কেটেছে ইংরেজী নার্সারী রাইম আর এডুকেশন্যাল রাইম শুনে। ও ঠিক মতো কথা বলতে শেখার আগেই ও নাউ এই নো মাই এবিসি নেক্সট টাইম ওন্ট ইউ সিং উইথ মি শিখেছে। সেই ধাঁপ পেরিয়ে ইংরেজী বর্ণ চিনতে শিখেছে, শুধুমাত্র সহজলভ্য এবং বহুপ্রজ বলেই ও এখনও বাংলা বর্ণমালা শিখতে না পারলেও ইংরেজী বর্ণমালা এবং ইংরেজী নাম্বার শিখে ফেলেছে।
বিভিন্ন ধরণের কার্টুন দেখে ছবি আর প্রতিক্রিয়া দেখে ইংরেজী বাক্য তৈরী করা শিখেছে। কিন্তু আলাপচারিতা শিখে নি।
ড্যাডি আর ইয়ু স্লিপীং, ওয়েক আপ ওয়েক আপ
এই বাক্যের উত্তর তাকে বাংলায় দিতে হয়। তাহলে ও বুঝে আমি কি বলছি।
গত পরশু বললো ড্যাডী হোয়ার আর ইয়ু গোয়িং
বললাম যাস্ট লুকিং এরাউন্ড, উইল বি ব্যাক সুন।
পালটা প্রশ্ন আসলো, ড্যাডী হোয়ার আর ইয়ু গোয়িং
বললাম মা একটু বাইরে থেকে আসতেছি।
বললো ওকে, বাই- সি ইয়ু সুন।
কখন কি প্রশ্ন করতে হবে, সেই প্রশ্নের ধরণ কি রকম হওয়া বাঞ্ছনীয় সেই শিক্ষাটা কার্টুন থেকে পেলেও কি প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন তৈরী হচ্ছে- সেটা বাংলায় কি রকম হওয়া বাঞ্চনীয় এই সব বুঝার পরিপক্কতা এখনও তৈরী হয় নি।
ইন্টারনেট খুঁজে ক এ কলা খ এ খাই এতো বেশী খেতে নাই গানটা পাওয়া গেলো, ভুল এবং বিশ্রী উচ্চারণে বাংলা স্বরবর্ণ এবং ব্যাঞ্জন বর্ণ পরিচয় পাওয়া গেলো- সেসব শ্রুতিকটু শিশুশিক্ষা উপকরণ, খুব বিশ্রী ধাঁচের টু ডি এনিমেশন এবং বিয়েকাতর শৈশব ছড়ার ভেতরে আটকে থাকা আমরা ধর্মীয় বিবেচনায় বাল্য শিক্ষা বই সংশোধন করেছি। অ তে অজগর ঐ আসছে তেড়ের বদলে অ তে অজু করে নামাজ পড়ো তে উত্তীর্ণ হয়েছি আমরা। কিন্তু প্রক্রিয়াটিকে শিশুবান্ধব, সুরেলা করেউঠতে পারি নি। সিসিমপুরের উদ্যোগটার বাইরে তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টাকে ভাববে এমন প্রতিষ্ঠানও নেই। এইসব সীমাবদ্ধতার মাঝেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বেড়ে উঠতে হবে।
বাংলা ভাষার শিশুতোষ কবিতার বিয়েপ্রীতিপ্রবল ( অধিকাংশ ছোটোদের ছড়া মানেই বিয়ের আয়োজন, নইলে সন্তানের প্রতিপালনের বর্ণনা) ।

ইন্টারেস্টিং লাগলো গোটা পোষ্টটাই!
মন্তব্য করুন