রকমারি
১.
ফেসবুকে বইপড়ুয়া নামে একটা গ্রুপ আছে। এই গ্রুপে যেতে ভয় লাগে। হীনমন্যতা জাগে। সবাই এতো এতো বই পড়ে যে নিজেকে ওখানে রাখতে অস্বস্থি হয়। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ধরণের বই আছে। সেসব বই অনেকেই নিয়মিত পড়েন, আলোচনাও করেন। অনেকের বিশ্লেষণ ক্ষমতা দেখেও আমার ঈর্ষা হয়। তাই পারতপক্ষে আমি ওই গ্রুপে যাই না। এর নাম যদি হতো বউপড়ুয়া গ্রুপ আমার সেখানে পড়ে থাকতে সমস্যা হতো না।
(বইপড়ুয়া গ্রুপের সঙ্গে আমার পরিচয় করে দিয়েছিল নজরুল। নজরুলরে ধিক্কার)
এরমধ্যে আবার সর্বনাশ করেছে রকমারি ডটকম। অনলাইনে বই কেনার সাইট। কোথাও যেতে হবে না, ঘরে বসেই বই। খরচ মাত্র ৩০ টাকা। গরীব মানুষের টাকা খরচের নতুন একটা জায়গা হয়েছে এই সাইটটি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী দিয়ে হাতেখড়ি। তারপর আবার রকমারিতে ঢুকি, তৃঞ্চার্তের মতো বইয়ের তালিকার দিকে তাকিয়ে থাকি, অর্ডারের তালিকায় নতুন নতুন বই যুক্ত হয়, টাকার দিকে তাকাই, তালিকা কাটছাট করি, ফাইনাল অর্ডার দিতে দেরি করি। একসময় দিয়েই দেই।
রকমারিতে অনেক আগে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। আমার আগ্রহ এখানেই। এসব বই এখন আর চোখে পড়ে না, তাই কেনাও হয় না। কিন্তু রকমারিতে ঠিকই পেয়ে গেলাম।
২.
আশরাফ কায়সার একসময়ে সাংবাদিক ছিল। বিচিত্রায় কাজ করতো। এখন বিজ্ঞাপন জগতের বড় কর্তা। আশরাফের একটা বই পেলাম, রকমারিতে। ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড’। মূলত স্বাধীনতার পর থেকে ৯০ পর্যন্ত যত রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হয়েছে তার বিবরণ আছে বইটিতে। গোগ্রাসে গিলছি। অনেক অজানা তথ্য জানছি। ভুলে যাওয়া অনেক জানা তথ্য আবার মনে পড়ছে, অনেক প্রশ্নের উত্তরও পাচ্ছি।
বইটিতে কয়েকটি অংশ রয়েছে। যেমন,
উপমহাদেশে সশস্ত্র আন্দোলনের পটভূমি
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দলসমূহের অন্তঃদ্বন্দ্ব
বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যার সূচনা
আওয়ামী লীগের শাসনামল
মোশতাকের তিন মাসের শাসন
জিয়াউর রহমানের সামরিক ও বেসামরিক শাসন
এরশাদের শাসনামল
জামায়াতে ইসলামির হত্যাযজ্ঞ
ছাত্র রাজনীতিতে হত্যা ও সহিংসতা
সশস্ত্র বাম রাজনীতিতে অন্তর্দ্বন্দ্ব
রাজনীতির পাঠকদের ভাল লাগবে বইটি।
৩.
কবিতা পড়তে ভাল লাগে। কিন্তু সব কবিতা বুঝি না। যে কবিতা বুঝি, ভাল লাগে-কিন্তু কেন ভাল লাগলো সেটি বলতে পারি না। ভাল লাগলে মনে হয়, কেউ যদি একটু বুঝিয়ে দিতো। ঠিক এই কাজটি করলেন জয় গোস্বামী।
বইটির নাম গোঁসাইবাগান। একটা কবিতা কেন ভাল লাগে, বিশেষ বিশেষ লাইনের নতুন কী অর্থ বের করে, যতি চিহ্ন দেওয়ায় অর্থ কিভাবে বদলে গেল, কবি আসলে কী বলতে চেয়েছেন-এসব কিছুই জানিয়েছেন জয় গোস্বামী। আমার মতো কবিতাকানা আর ছন্দকানা মানুষের জন্য এই বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে শঙ্খ ঘোষ-সুনীল-শক্তি হয়ে নতুন এবং নাম না জানা অনেক কবির কবিতা পড়ার সুযোগ তো আছেই, আর আছে সেই সব কবিতার দারুণ সব বিশ্লেষণ।
প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুটাই সবচেয়ে লোভনীয়। ২৮ অধ্যায়ের শুরুটা বলি-‘সম্পর্ক একমন একটা জিনিষ, কোনো কোনো মানুষ কেবল সেটার জন্যই বাঁচে। বলতে পারতাম সব মানুষ, সাহস পেলাম না। টাকাপয়সার জন্যেও বাঁচে নাকি অনেকে। রাতে শুতে যাওয়ার আগে একবার উলটে দেখে নেয় দুটো-তিনটে পাশবই। অ্যাকাউন্টগুলোয় নজর দিয়ে মনে জোর পায়। বাকিগুলো আজ আর দেখাই হল না। না দেখলেও হবে। কাল দেখব। এমন মানুষও আছে জগতে। হয়তো কোনো লেখক, রাতে শুতে যাওয়ার আগে পাতা উলটে দেখে নেন, কোন পর্যন্ত লিখেছি আজকে। এমন ছেলেও হয়তো ছিল কখনও, খাওয়া হয়নি সারাদিন, সন্ধেয় দুটো মুখে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু মনে কী আনন্দ! সারাদিন মাথায় তিনটে কবিতা সে ভেবে রেখেছে। এখন কপি করে শুতে যাবে! কেউ বা ঘুমানোর আগে চোখ বন্ধ করে ভাবল কোনো মেয়ের তাকিয়ে থাকা চোখ।’
৪.
তোমার পরনে সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি
হাতে প্লাস্টিকের গোলাপি প্যাকেট
আর মাত্র শাঁখা পলা। ক্ষয়ে যাওয়া হাওয়াই দু’পায়ে।
তুমি খুব সেফটিপিন ভালবাসো মনে হয়।
মনে হয়, আর কিছু ভালবাসার কথা
মনেই হয়নি তোমার কখনও।
বোঝা যায়, তুমি বিজ্ঞান জানো না, কাব্য নয়।
গান কিংবা আলপনায় সামান্যও গুণপনা নেই
(যাদের ওসব থাকে তারাও একটু উজ্জ্বল হয়)
তোমার জলুস নেই, মুখের চামড়া খসখসে
এমনকী, টিকেট কাটছে, খুচরো পয়সা মেলাতে পারছ না,
কন্ডাক্টর মুখ করল। তোমার দু’চোখে ভয়।
ফাটা ঠোঁটে অর্থহীন হাসি।
সবাই হেনস্থা করছে। বাস থেকে নামলে কোনও মতে।
আচ্ছা বলো, এবার কী করবে তুমি...বাড়ি যাবে...বর ঘরে নেই
ছেলেমেয়েরাও নেই, রান্না করবে ভালোমন্দ কিছু?
তাও বুঝি পারো তুমি? তেল নেই, গোটা দুই আলু পড়ে আছে
ওসব বললে কি হয়। যারা পারে, অন্নপূর্ণা, চালেডালেও অমৃত বানান
রাত বাড়লে একে একে ঘরে ফিরল তোমার সংসার
খাওয়া ও বিছানা হল। রতি হল। কিছুই পারলে না।
তারপর মধ্য রাত্রে, চুপিচুপি ছুঁয়ে দিলে স্বামী আর সন্তানের মুখ
আর ওরা স্বপ্নে নীল হয়ে গেল।
আমি বলেছিলাম, তুমি পারো।
শুধু কেউ বিশ্বাস করলো না।
মন্দাক্রান্তা সেনের এই কবিতাটি গোঁসাইবাগান থেকে তুলে দিলাম। কারণ এটি আমার কাছে তুলনামূলকভাবে সহজ কবিতা বলে মনে হয়েছে। তারপরেও জয় গোস্বামীর ব্যাখ্যা পড়ে মনে হল, এরকম এক কবিই তো চাই, যিনি এতো সহজ করে সব কবিতা বুঝিয়ে দেবেন।
৫.
হেই বক্তৃতা বাবু!
তুই হুই শহরের সাততলা বাড়ী থেকে
নামলি মাচায়,
এলি গাড়ী চড়ে মিটিং করতে
আমাদের শরীরের কালো রঙ সাবান মাখিয়ে ফর্সা করতে,
আমাদের ছেলে মেয়েদের ভালো,সভ্য করতে ;
এলি যেন লাট সাহেবের নাতি!
বক্তৃতা দিয়ে যাবিও
সেখানে—কল টিপলেই জল পড়ে।
ঘর আলো হয় ঘুটঘুটে কালো রাতে;
আবার বিজলি পাখাও ঘোরে-
বক্তৃতা দিয়ে শরীরে যদি ঘাম লাগে তোর, বক্তৃতা বাবু!
তুই বড় ভালো ছেলে।
আমাদের জন্য কত যে খাটিস-পিটিস!
কেবল ঘরের বিজলী পাখাটা বন্ধ হলেই মেজাজ গরম;
জলকে বরফ করার যন্ত্র-সেটাও বিকল!
তুই না রাজার বেটা!
রেশনে চাল ছেড়ে দিয়ে খাস বাসমতী চাল-
তবু আমাদের জন্য রাত্রে ঘুমাস না তুই ;
আহারে সোনার বাবু!
হেই বক্তৃতা বাবু ! হেই বক্তৃতা বাবু ! থু !
-বক্তৃতা বাবু / বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বইপড়ুয়া গ্রুপে যাই তবে কিছু বলার যোগ্যতা আমার নাই। তাই চুপ থাকি।তবে সবার আলোচনা বা বিশ্লেষন দারুন উপভোগ করি।
বইপড়ুয়া গ্রুপে আপনার যেতে ভয় লাগে, লেখা পড়ে কিন্তু তা মনে হয়নি।
ভাল লাগলো লেখাটা
আহা আপনার লেখাটা পড়ে সত্যি ভীষণ লোভ হচ্ছে ওই গ্রুপে জয়েন করতে, তা কি করে সম্ভব যদি জানান সবার ত আলোচনা করার দরকার নেই । চুপটি করে এক কোণে বসে থাকব না হয়, আর প্রাণ ভরে মণিমুক্তা আহরণ করব
রকমারি আনন্দে থাকেন সবসময়!
দুইটা কবিতাই দারুন।
তবে একর্ডিং টু জেনেভা - বইপড়ুয়া নাকি পঁচা কারন তারা জেনেভারে দলে নেয় নাই
হ, ঠিকইতো। তারা অমূল্য রত্ন মিস দিলো
আমিও বইপড়ুয়াতে যাই ----- জ্ঞানীলুকদের কাছ থেকে দেখার জন্যে
১. কি আর বলি! ফকিরের জন্য তো তাইলে কোন তালিকারই দরকার নাই।
কবিতাগুলো সুন্দর। বিশ্লেষণটা মনে ধরছে।
জয় গোস্বামীর বইটা পড়তে চাই।
কবিতা দুইটা একদম ধারালো।
বইপড়ুয়া তে মাঝে মাঝেই যাই,
কথা বলার সাহস আর সুযোগ মিলে না খুব বেশি সময়।
কেবল হিংসিত হই!
রকমারি ট্রাই করা হয় নি কখনও।
আমার কেন জানি লাইব্রেরী গিয়ে খুঁজে বের করে বই কিনতেই বেশি ভাল লাগে!
গোসাঁইবাগানের হদিস দেওয়ায় ধন্যবাদ।
গরীপ গুব্রা মাইনষেগোর লাইগা দুইন্যার কুনু ভালুবাসা নাই
মন্তব্য করুন