শাহবাগ এর কথিত 'নাস্তিকতা' এবং ‘সত্যব্যবসায়ীদের’ যুথবদ্ধতা
সত্যের বিপরীতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ধর্মাশ্রিত মিথ্যাচার এবং ধর্মের মতলবী ব্যবহার নতুন নয়; পৃথিবীর ইতিহাসে এ পদ্ধতি পুনপৌনিকভাবে ব্যবহার করেছে অপশক্তিসমূহ। মৌলবাদীশক্তি। প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তি। সামরিক শক্তি। এমনকি গণতন্ত্রের লেবাসে অগণতান্ত্রিক শক্তি। বুদ্ধিজীবিতার ছলে বুদ্ধির বিকিকিনিতে অভ্যস্ত পেশাদার বুদ্ধিজীবীমহলও। সুতরাং মতাদর্শিক লড়াইয়ে টিকতে না পারার ভয় ও শংকায় আকন্ঠ নিমিজ্জিত হয়ে কাউকে বা কোন একটি গোষ্ঠীকে ‘নাস্তিক’ বিধর্মী’ হিসেবে আখ্যায়িক করা একটি পুরনো প্রতিক্রিয়াশীল কৌশল। খ্রীস্টেরও জন্মের প্রায় চারশ’ বছর আগে, খ্রীস্টপূর্ব ৩৯৯ সালে এ কৌশলটি ব্যবহার করেছিল সে সময়ের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। সক্রেটিস এর বিরুদ্ধে। সে সময় একই অভিযোগে সক্রেটিসকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল সক্রেটিস নাস্তিক। সক্রেটিস ধর্মে বিশ্বাস করেন না। সক্রেটিসের চিন্তা, যৌক্তিকতা আর দর্শনের গভীরতার সামনে দাঁড়াতে না পেরে, টিকতে না পারার আশংকায় সে সময়ের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী শেষপর্যন্ত ধর্মকেই নিয়ে এসেছিল সামনে। আপাত সফলও হয়েছিল। সক্রেটিসের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত সক্রেটিসই টিকে গেলেন। যারা সক্রেটিস এর মৃত্যুদন্ড প্রদানে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সফলতার হাসি হেসেছিল তারা কেউ বেঁচে রইলেন না। বরং নিক্ষিপ্ত হলেন ইতিহাসের ডাস্টবিন-এ। উল্টো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে জীবন দিয়েও বেঁচে থাকলেন সক্রেটিস। আরো প্রবলভাবে, আরো বেশি দৃশ্যমান হয়ে; ইতিহাস এর পাতায়; মানুষের চিন্তার বিবর্তনের এক উজ্বল আলোক বর্তিকা হয়ে।
বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের নানা ধাপে, নানা পরিক্রমায় ধর্মকে কে টেনে আনা হয়েছে। সম্মিলিত মানুষের মুক্তির আকংখা ও তা অর্জনে গতিরোধ করার উদ্দেশ্য। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময়ও ধর্ম কে সামনে নিয়ে আসা হয়েছিল। বলা হয়েছিল বাংলা হিন্দুদের ভাষা। উর্দু বর্ণমালার সাথে আরবি বর্ণমালার মিল আছে। এ হাস্যকর যুক্তিতুলে তাকে ইসলামী বর্ণমালা হিসেবেই প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছিল। রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এমনকি স্রেফ ধর্মের দোহাই তুলে বাংলাভাষার দুই শক্তিমান কবি, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে পরস্পরের প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে দাঁড় করাবার অপচেষ্টাও হয়েছে। এখনও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু এ দুজনের ধর্মীয় পরিচয় এর কারণে কে বেশি শ্রেষ্ঠ-এ বিতর্কও চলেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনটাই টিকেনি। পাকিস্তানী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে শেষপর্যন্ত বাঙালী জাতির অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনায় বিজয়ী হয়েছে। বাঙালী পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য জানকবুল করা লড়াকু জাতি হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সাথে বাংলা ভাষাও। ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালী জাতিকে, তাদের মধ্যে সংখ্যার বিচারে মুসলমান এর আধিক্য থাকার পরও, উর্দু ভাষার ‘সুরা’ খাওয়ানো যায় নি। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ধর্মাশ্রিত ভাষার সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে অসম্প্রদায়িক বাংলা ভাষাই জায়গা করে নিয়েছে ইতিহাস-এর পাতায়। বাংলা স্বীকৃতি পেল রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে। তারই ধারাবাহিকতায় ২১-এ ফেব্রুয়ারি দিনটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যা অন্ধকারের বিপরীতে আলোর পথযাত্রীদেরই ত্যাগ আর বিজয়ের মহিমার চিহ্ন ও স্বীকৃতি।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধেও ধর্ম এসেছিল। প্রবলভাবে। না ধর্ম নিজে আসেনি। ধর্মকে আনা হয়েছিল। সুপরিকল্পিতভাবে। ধর্মাশ্রিত মিথ্যাচার দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্য। বলা হয়েছিল পাকিস্তান না থাকলে ইসলাম থাকবে না। গণমানুষের মুক্তির আকাঙ্খা ও মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে অপব্যাখ্যা দিয়ে ইসলামকে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চলেছিল। বাঙালীর স্বত:স্ফুর্ত মুক্তিসংগ্রামকে ইসলাম এর বিপরীতে বিধর্মীদের লড়াই-এ রকম বয়ান খুব জোরালোভাবেই পরিবেশিত হয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর, তাদের নেতা গোলাম আযম, নিজামী, কাদের মোল্লা, মুজাহিদ গংরা পবিত্র ইসলাম ধর্মের নামে নিযুক্ত হয়েছিল ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধর্মাশ্রিত মিথ্যাচার টেকেনি। টিকতে পারেনি। সত্যেরই জয় হয়েছে। নিকষ-কালো অন্ধকারের বিপরীতে আলোর রেখাই উদ্ভাসিত হয়েছে। দ্বিজাতি তত্বের ভুল গর্ভে জন্ম নেয়া পাকিস্তান টিকতে পারেনি। ধর্মের দোহায় দিয়ে, ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, ধর্মের নামে মানুষ খুন করে, ধর্ষন করে পাকিস্তান এর অখন্ডতার শেষ রক্ষা হয়নি। পাকিস্তানকে রক্ষা করা যায়নি। বরং প্রবল প্রতিরোধ, সংগ্রাম আর আত্বদানের বিনিময়ে সাম্প্রদায়িক পশ্চাদপদ পাকিস্তানি মতাদর্শের বিপরীতে জন্ম নিয়েছে একটি নতুন দেশ। প্রতিক্রিয়াশলতার বিপরীতে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
তবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার, ধর্মের নামে মিথ্যাচার, বিপুল জনগোষ্ঠীর ধর্মের প্রতি সরল বিশ্বাসকে পুঁজিকরে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা শেষ হয়ে যায়নি। এর বড় প্রমাণ বিগত ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে ৭১ এর যুদ্ধাপরাধী জামাত নেতা কাদের মোল্লার রায় ঘোষিত হওয়ার পর, মুহূর্তে গর্জে উঠা শাহবাগ এর তারুন্যের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এর বিরুদ্ধেও নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলছে সে একই পুরনো কায়দায় ধর্মাশ্রিত মিথ্যাচার। ঠিক একই কায়দায় ধর্মের ব্যবহার। মূলত: ৭১-এ সংঘটিত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হওয়ার পর থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলামকে ব্যবহার করা হচ্ছে সুকৌশলে। তবে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার বদৌলতে এবারের মিথ্যার মাত্রা অনেক বেশি গভীর; বৈচিত্রময়। এবং ভয়ানক। সম্ভবত বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক রঙ্গলাল সেন এর কোন একটি লেখায় পড়েছিলাম। অনেক দিন আগে। এ মুহূর্তে লেখার শিরোনাম বা বই কোনটির নাম মনে পড়েছে না। তিনি তাঁর সে লেখায় কার্ল মার্ক্স-এর উদৃতি দিয়ে বিজ্ঞানের মানবিকায়নের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি নিজে রাজনীতি নিরপেক্ষ। কিন্তু তার ব্যবহার রাজনীতি নিরপেক্ষ নয়। তার মানেই রাজনীতিই ঠিক করে দেয় বিজ্ঞানের বা প্রযুক্তিগত আবিস্কার কতখানি গনমানুষের কাজে আসবে। আর কতখানি আসবে না। কতখানি মানুষের পক্ষে ব্যবহৃত হবে। আর কতখানি বিপক্ষে। বিজ্ঞানের বিমানবিকায়ন এবং রাজনৈতিক ব্যবহার কতখানি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে মানুষের নিকট ইতিহাসে তার নিকৃষ্টতম প্রমাণ, আমেরিকা কর্তৃক জাপানে পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণ। সুতরাং বিজ্ঞান বা কোন প্রযুক্তি যদি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে পড়ে, সাম্প্রদায়িক শক্তি যদি একটি প্রাগ্রসর প্রযুক্তি নিজেদের হাতে পায়, শুধু ব্যবহারকারীর কারণেই সেটি আলোর পরিবর্তে অন্ধকার এর প্রতিনিধি হয়ে উঠে। প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে প্রযুক্তি তার সম্ভাবানা হারিয়ে হয়ে উঠে ধর্মাশ্রিত মিথ্যাচারের বাহন। আর একটি জনগোষ্ঠী যদি অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া হয়, লেখাপড়ার দিক থেকে, সচেতনতার দিক থেকে, সে মানুষগুলোর মধ্যে যদি ধর্মের প্রতি সহনশীলতা থাকে, তারা যদি ধর্মের প্রতি সরল বিশ্বাসী হয় এবং একই সাথে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে যদি অসচেতন থাকেন, তবে সে ক্ষেত্রে একটি প্রাগ্রসর প্রযুক্তিও আলো নয়, বরং অন্ধকার, ভয়াবহতা নিয়ে আসে। তার নিকৃষ্টতম নির্লজ্ব উদাহরণ সাম্প্রতিককালে ফটোশপে সুপারকম্পোজ করে প্রচারিত সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গল্প। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ-সংস্কৃতিতে এখনও ধর্মভিত্তিক যাদুকরী বিশ্বাস কতটা প্রবল, আর সে সরল বিশ্বাসকে আশ্রয় করে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে মিথ্যাচার কতখানি জীবন-বিনাশী হতে পারে তার উদাহরণ মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহজুড়ে সারাদেশে জামাত-শিবির কর্তৃক সংঘটিত তান্ডব। যেখানে প্রধানত গ্রামীণ স্বল্প শিক্ষিত অথবা নিরক্ষর মানুষের ধর্মীয় সরল বিশ্বাসকে ব্যবহার করা হয়েছে। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। আমাদের বিল্ডিং-এ যে ছেলেটি দারোয়ান হিসেবে চাকরি করে, যে ছেলেটি এ শহরে এসেছিল গ্রাম থেকে, যার পড়ালেখা নেই, দারিদ্রের কারণে, যাকে আমি আক্ষরিক অর্থেই কখনও নামাজ-কলমা পড়তে দেখিনি, এমনকি শুক্রবারেও না, সে ছেলেটিও রাত দু’টায় আমাদের বাসার ছাদে ঘন্টা দু’য়েক চাঁদের দিকে চোখ মেলে বসে ছিল। চাঁদের বুকে সাঈদীর ছবি দেখা যাওয়ার সংবাদে। যুদ্ধাপরাধীর বিপরীতে ওয়াজেন সাঈদীকে দেখতে পাবে বলে। স্রেফ ধর্মের প্রতি সরল বিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে এবং যাদুকরী বিশ্বাস এখনও লালন করে বলে। ছেলেটির ভাগ্য ভাল। এ সময় সে গ্রামে ছিল না। না হয় মসজিদ থেকে মাইকে সাঈদীর ছবি দেখা যাওয়ার মিথ্যা গল্পশুনে এ ছেলেটিও হয়তো রাস্তায় নেমে আসতো। তারপর ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম চর্চা না করেও ধর্মীয় সরল বিশ্বাসের কারণে ধর্মের নামে জীবন ও মুত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে অনাকাংখিতভ তান্ডবে লিপ্ত হতো। এমনকি শহীদের বটিকা খেয়ে নিজের পরিবার এর জন্য অত্যাশিত অনিশ্চয়তা তৈরি করতো।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠন পরবর্তী এবং কাদের মোল্লা ও সাঈদীর রায় ঘোষিত হওয়ার পর অনলাইনভিত্তিক এবং অনলাইন এর বাইরে নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার-প্রপাগান্ডায় ধর্মাশ্রিত মিথ্যাচার এর এ রকম অসংখ্য উদাহরণ এখন আমাদের সবার সামনে। ১৭ মার্চ ইংরেজি দৈনিক ডেইলী স্টার ধর্মাশ্রিত মিথ্যাচার নিয়ে এর প্রধান প্রতিবেদন ছাপে। আট কলাম জুড়ে প্রথম পৃষ্ঠার অর্ধেক, ৫ম পৃষ্ঠায় পুরোটা জুড়ে মিথ্যা ছবি ও মিথ্য ক্যাপশন এর বিপরীতে আসল ছবি, এবং পৃষ্ঠা-১৯ এর চার কলাম জুড়ে জামাত-শিবির এবং বিএনপির সমর্থক তিনটি পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন মিথ্যা সংবাদ এর উৎস, মিথ্য সংবাদ এর ধরন এবং মূল সংবাদটি কোথায় কবে ছাপা হয়েছিল তার বিস্তারিত তথ্য হাজির করে। এ রকম একটি প্রতিবেদন ছাপার জন্য প্রতিবেদক জুলফিকার আলী মানিক কে শুধু প্রশংসা নয়, তার প্রতি বিনীত কৃতজ্ঞতা। এ প্রতিবেদনটি দেখার পর ধর্মানুরাগীতো অবশ্যই, সত্যনিষ্ঠ যেকোন বিবেকবান মানুষের শরীর-মন এক সাথে আঁতকে উঠার কথা। সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হচ্ছে, যে কাবাশরীফ সারা পৃথিবীর বিশ্বাসী মুসলিমদের কাছে একটি পবিত্র স্থান হিসেবে স্বীকৃত, যেখানে প্রতি বছর সারা দুনিয়া থেকে কোটি কোটি মুসলিম নর-নারী পবিত্র হজ্বব্রত পালন করতে যান, সে কাবা শরীফের ইমামদের নিয়ে মিথ্যাচার এর এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। যেন ধর্মের নামে মিথ্যাটা একটা বৈধ শিল্প। কাবাশরীফের ইমামরা এক সাথে দাঁড়িয়ে পবিত্র কাবাশরীফের গেলাফ বদল করেছেন। এটি একটি রুটিন কাজ। প্রতি বছর অক্টোবর মাসে এটা করা হয়। কাবাশরীফ এর গেলাফ বদলের সে ছবিটি জামাত-বিএনপির মুখপত্র হিসেবে পরিচিত তিনটি দৈনিক ছেপেছে। ফেইসবুক সহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে প্রচার করা হযেছে। তাতে বলা হয়েছে যে, জামাত নেতাদের বিচারের বিরুদ্ধে কাবা শরিফের ইমামরা প্রতিবাদে নেমেছেন। মানববন্ধন করেছেন। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কাবাশরীফের ইমামরা দলমত নির্বিশেষে বিশ্বমুসলিম সম্প্রদায়েরর কাছে ধর্মীয় দিক থেকে সম্মানিত ব্যক্তি। সুতরাং তাদের ব্যাপারে বিশ্বমুসলিমের একটি সামাজিক মনস্তত্ব্ব আছে। দুর্বলতা আছে। মূলত: সে দুর্বলতাটাকেই উসকে দিয়ে, তাকে রাজনৈতিক পুজিতে রূপান্তরিত করে তার ফসল ঘরে তোলার লক্ষে যাবতীয় মিথ্যার আয়োজন। পৃথিবীর সকল ধরনের ধর্ম চর্চার একটি মৌলিক উপাদান হচ্ছে সত্য কথা বলা। সকল ধর্মই মিথ্যাকে পাপ বলে গণ্য করেছে। কিন্তু কথিত ধর্মের হেফাজতকারীদের কাছে এ রকম মিথ্যার চাষাবাদ-এ কোন পাপবোধ নেই। অপরাধবোধ নেই।
গণজাগরণ মঞ্চের শুরুতেই জামাত-বিএনপির মুখপত্র হিসেবে পরিচিত প্রধান তিনটি পত্রিকার অপপ্রচারের ধরন সাংবাদিকতার যাবতীয় নীতি, নৈতিকতা আর ব্যাকরণকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। তাদের অপ্রচারের নানা কৌশলের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে শাহবাগ আন্দোলন-এ অংশগ্রহণকারীদের গায়ে নাস্তিকতার ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া। ব্লগার রাজিব নৃশংসভাবে খুন হওয়ার পর একটা মওকা পেয়ে যায়। রাজিবের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গাটিকে সামনে নিয়ে আসে। তাকে পুঁজিকরে রাজিবের নামে নানা পোস্ট দিতে থাকে। সেসব পোস্টের স্ক্রীন শর্ট নিয়ে তা আবার পত্রিকায় ছাপতে শুরু করে। সমাজের যে অংশটির ইন্টারনেট সম্পর্কে কোন ধারণা নেই, যাদের ফেইসবুক একাউন্ট নেই, যারা কম্পিউটার এর ফটোশপ সম্পর্কে কোন ধারণা রাখেন না, যারা এর আগে কোন দিন ব্লগ এর নাম শুনেন নি, যারা জীবনে একবারও ব্লগ পড়েন নি, সে মানুষগুলোর কাছে মিথ্যসংবাদ পরিবেশেন করে, তাদের সরল ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে, তাদের ক্ষেপিয়ে রাস্তায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়। তবে ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যাপারে প্রথমদিকে ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশেষ করে বেসরকারি-কওমী মাদ্রাসার একটি অংশকে ক্ষেপিয়ে তোলা সম্ভব হলেও, এবং তাদেরকে মিছিলে নামিয়ে পেছন থেকে বিভিন্ন নাশকতা ঘটানো সম্ভব হলেও মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার প্রবাহটা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখা যায়নি। এর মধ্যে আলেমদের মধ্য থেকে একটি বড় অংশ জামাত-শিবির এর বিপরীত স্রোতে হাটতে শুরু করে। তারা বুঝতে পারেন যে তাদের ধর্মীয় অনুভূতির রাজনীতিকরণের একটি প্রক্রিয়া চলছে। খুব জোরালোভাবে। কলকাঠিটা পেছন থেকে অন্য কেউ নাড়ছে। যে পক্ষটিকে তারা নিজেরাও সমর্থন করেন না। সমর্থন করতে পারেন না। গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিকদের মঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এ সব প্রয়াস অনেকটা ব্যর্থ হওয়ার পর জামাত-শিবিরকে ছাপিয়ে মূল ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা জিয়া। তিনি মুন্সিগঞ্জের ১৫ মার্চের জনসভায় সরাসরিই ঘোষণা দেন। বলেন, শাহবাগ নাস্তিকদের চত্বর। শাহবাগ-এ যারা যায় তারা ধর্মকর্ম মানে না, তারা নাচ গান ও অপকর্ম করছে। আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রীর ব্যবহৃত ‘অপকর্ম’ শব্দটির অর্থ এখানে অস্পষ্ট। যার অনেক অনেক অর্থ হতে পারে। আমার ধারণা তিনি খুব সচেতনভাবে এ রকম একটি অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করেছেন। যাতে অগণিত নেতিবাচক অর্থ করার সুযোগ থাকে। বেগম জিয়ার বক্তব্যের পর আমার সাথে অন্তত তিনজন ব্যক্তির কথা হয়েছে, যারা মনে প্রাণে বিএনপি করেন। বিএনপির সমর্থক। এ তিনজনের একজনও বিএনপি নেত্রীর নাস্তিকতার সনদ বিতরণ কর্মসূচি পছন্দ করতে পারেনি। উল্টো কঠিন সমলাচোনা করছেন। একজন শুধু শান্তনা হিসেবে বলেছেন, এটা ভোটের রাজনীতি। এর সাথে বাস্তবতার মিল সব সময় খুজে পাওয়া সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার যে, গত জাতীয় নির্বাচনে ধর্ম, তথাকথিত ভারত বিরুধীতা-এগুলোর কোনটাকে বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে মৃতসঞ্জিবনী হিসবে কাজে লাগাতে পারেনি। যেটা এর আগে সম্ভব হযেছিল। তারপরও বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দল বিএনপি নাস্তিকতা-আস্তিকতা মেরুকরণের দিকে ঝুকলেন। ধর্মটাকে সামনে নিয়ে আসলেন। আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার কৌশল হিসেবে। একবারও ভাবলেন না যে, ঢালাওভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে নাস্তিক বলা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও অনৈতিক। অনুমোদিত। শাহবাগ এ গিয়েছিল এ রকম লাখো নারী-পুরুষ, তরুন-তরুনী, যারা ব্যক্তিগত জীবনে কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাস করেন, কখনও চর্চা করেন, কখনও করেন না, তারা সকলেই যখন একজন জাতীয় নেত্রীর কাছ থেকে এ রকম বক্তব্য শুনেছেন, একজন জাতীয় নেত্রী তাদের সবাইকে নাস্তিক বলছেন, আমি জানি না তখন তাদের কেমন অনুভূতি হয়েছিল। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব অস্থির লাগছিল। অস্বস্থি লাগছিল। সাথে লজ্জ্বাও। আমার মনে হয়েছে বিএনপির মধ্যে এতদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে সামান্য যে সম্ভাবনাটি নিবু নিবু করে জ্বলছিল, যার দিকে তাকিয়ে তরুনরা বিএনপি জামাত এর সংগ ছাড়বে বলে আশান্বিত হয়েছিল, আজ সে নিবু নিবু করা আলোটি একেবারে ধপ করে নিবে গেল। আমার খুব মনে পড়ছিল সে মেয়েটির কথা। সে তরুনিটির কথা। ৮ মার্চ গণজারণ মঞ্চে যে মেয়েটি বক্তৃতা করেছিল। আমি ঐ মেয়েটিকে চিনি না। জানি না। তার নামও জানা নেই। তবু তার একটি কথা আমার মনে পড়ছে। আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রীর কে উদ্দেশ্য করে মেয়েটি বলেছিল- মাননীয় নেত্রী, আমি জানি, আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী হিসেবে আমরা আপনাকে বলছি, আপনি রাজাকারদের পক্ষ ছাড়ুন, জামাত শিবির এর পক্ষ ছাড়ুন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের প্রতি সমর্থন দিন। আমার এ মুহুর্তে খুব মনে পড়ছে হুমায়ুন আজাদ এর কথা। তিনি তার ‘দ্বিতীয় জন্ম’- বই এর এক জায়গায় লিখেছেন, বিএনপি জিয়ার বেতার ঘোষণার উপর দাঁড়িয়ে কাজ করছে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। জামাত ও অন্যান্য ঘাতক-রাজাকারদের সংগে বিএনপি এমনভাবে আছে যে তাদের পৃথকভাবে চেনা যায় না।
আবারও সক্রেটিস এর কথায় ফিরে যাই। সক্রেটিস এর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছিল তার সব কটিই ছিল মিথ্যা। বিচারে শুনানীর সময় সক্রেটিসের যুক্তির কাছে দাঁড়াতে না পেরে শেষপর্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পক্ষ থেকে বলা হল সক্রেটিস নাস্তিক। সেটিও ছিল মিথ্যা কিন্তু ধর্মাশ্রিত। ধর্ম ঢাল হিসেবে ব্যবহার হল। অভিযুক্ত করে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হল। মৃত্যুদন্ড ঘোষণার পর তার বন্ধুরা, তার শুভাকাংখীরা, যারা চেয়েছিল যেকোন ভাবে হোক সক্রেটিসকে বাঁচিয়ে রাখাটা জরুরি, তারা সক্রেটিসকে মুক্ত করার একটা বুদ্ধিও বের করে ফেলেছিল। তারা পরিকল্পনা করেছিল সামান্য কিছু অর্থ খরচ করে কারাগার থেকে সক্রেটিস এর পালাবার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু সক্রেটিস কে রাজি করানো যায়নি। সক্রেটিস এর যুক্তি ছিল তাতে সক্রেটিস বেঁচে গেলেও সত্যটা মরে যাবে। সত্যটাকে বাঁচিয়ে রাখাটাই প্রধান কর্তব্য। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত সত্যটাই বেঁচেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনও সেইসব চিরায়ত সত্যেরই অংশ। যে চেতনা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কথা বলে। সমতার কথা বলে। অন্ধকারের বিপরীতে আলোর কথা বলে। বুদ্ধির মুক্তির কথা বলে। কিন্তু সে আলোক-উজ্জ্বল চেতনার বিপরীতে বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সে ক্লান্ত বাংলাদেশকে গণজাগরণ মঞ্চ নতুনভাবে হাটাতে শুরু করেছে। নতুন প্রজন্মের হাত ধরে এ চলার পথে আবারও প্রবিবন্ধকতা হিসেবে হাজির হয়েছে ধর্মাশ্রিত মিথ্যাচার। ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রকৃত ধর্মানুভূতির সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই। ধর্মীয় আধ্যাত্বিকতার দীর্ঘ ঐতিহ্যের বিপরীতে রাজনৈতিক ধর্ম, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ্য চাষাবাস চলছে। কিন্তু আলোর পথে মানুষের ক্রমাগত এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস সত্য হলে, সত্যের বিপরীতে ‘সত্যব্যবসায়ীদের’ চলমান যুথবদ্ধতা অথবা সম্মিলিত মিথ্যার চাষাবাস কোনটাই টিকবে না। টিকতে পারে না। যেমনটি টিকেনি ৫২, ৭১-এ। অতএব আস্তিক-নাস্তিক মেরুকরণের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক প্রচেষ্টা দিয়ে তরুন প্রজন্মের মনে আলোর পক্ষে যে চেতনাগত ঐক্য তৈরি হয়েছে তাকে ধপ করে নিবিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। এ চেতনার জয় হবেই। আজ না হোক আগামী কাল। কারণ বাংলাদেশের জনমিতিক কাঠামোতে এ তরুনরাই এখন মূলস্রোতধারা। জনসংখ্যার মূল অংশ। উল্লেখ্য, গণজাগরণ মঞ্চ দেখে আ’লীগ নেতারা এখন খুশীতে বগল বাজাচ্ছেন। কিন্তু তাদের ভুলে গেলে চলবে না, এ মঞ্চ তৈরি হয়েছিল সরকারি দলের প্রতি তরুনদের সংশয় থেকে। জনমিতিক কাঠামোয় এ তরুনরাই এখন সংখ্যগরিষ্ঠ। এ সংখ্যাগরিষ্ঠের, এ মূলস্রোতধারার মূলআকাংখাকে বুঝা না বুঝার ভান করে যদি যুদ্ধাপরাধীমুক্ত অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার তারুন্যের আলোকিত স্বপ্নটাকে উপেক্ষা করা হয়, সে একই নির্বাচন এর কারণে, ভোটের রাজনীতির জন্য, তবে জেগে উঠা তরুনদের টার্গেট-এ জামাত-শিবির-বিএনপির সাথে আরো একটি উইকেট যুক্ত হবে। আজ হোক কাল হোক তরুনরা সে উইকেট এর বিপক্ষেও দাঁড়াবে। অতএব সাবধান।
Thank you so much..............
Sorry keno jani bangla lekha jacche na
অবশ্যই রুখে দাঁড়াবে
রুখতেই হবে।
মন্তব্য করুন