নতুন ঘর চাই (ছোটদের গল্প)
চার বছরের তুলতুলে ছোট্ট শিশু মৌ'মনি দৌড়ে তার আব্বার ঘরে গিয়ে কানে কানে নালিশ করছে,
‘আব্বু দাদীমা খুব চেঁচামেছি শুরু করেছে আবারও। দাদীমা আপনাকে, আপনার আব্বাকে, আপনার আব্বার ছেলেদের সহ আপনার দাদাকেও খুব গালমন্দ করে চলছে। আমাকে ছাড়া ঘরের সকলকে নাকি বের করে দেবে।‘
কেন মা'মনি? তোমার দাদীমনিকে তুমি কি তোমার নূতন দালান বাড়ির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছ?
না আব্বু আমি বলিনি। আম্মুর মুখে শুনেছে।তাই হয়ত মনে পড়ে গেল। চার বছর বয়সী বোরহান সাহেবের' শিশু কন্যা মৌ'মনির কথা শুনে মেয়েকে কুলে তুলে কাঁধে করে নিয়ে মৌ'মনির দাদীমা, মানে বোরহান সাহেবের 'মা' এর কাছে এল। মায়ের ইজিচেয়ারের পাশে বসে বোরহান সাহেব মিনতি করল বলতে শুরু করল, ''মা আপনি আবারও উত্তেজিত হয়ে গেলেন।আমরা এখনো আপনার অনুমতির অপেক্ষায় বসে আছি।’’
''আপনি যতক্ষন আমাদের পূরনো বাপদাদার আমলের এই বাঁশের বাড়ি ভেঙ্গে নূতন দালান বাড়ি বানানোর অনুমতি দিবেন না ততক্ষণ আমরা আপনার এই ঘর ভাঙ্গবনা। তবে একটা কথা চিন্তা করুন মা,আমরা পাঁচ ভাই সকলেই বিয়ে করেছি। সকলের ছেলে সন্তান আছে। আমাদের এখন আলাদা থাকার ঘর দরকার। আমরা বাপ দাদার এই পুরানো জরাজীর্ণ ঘুনে ধরা বাঁশের বাড়িতে আর কত কাল থাকব? আমরা দু'ভাইও কোন রকম থাকতে পারছিনা। এই পুরনোবাঁশের ঘরটি ভেঙ্গে, নূতন দালান বানানোর অনুমতি দাওনি বলে।''
''তোমার বড় তিনটি ছেলে তোমার সঙ্গে রাগ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।ওরা এখন পরের বাড়িতে ভাড়া থাকছে। আমাদের এত বড় বাড়ি করার জায়গা থাকতে তোমার ছেলেরা মানুষের ঘরে ভাড়া থাকছে।শুধু তোমার কথার অবাধ্য হয়নি বলেই এই পুরানো বাড়িটি ভেঙ্গে বিল্ডিং করিনি। এখনো সময় আছে তুমি ভেবে চিন্তে নূতন বাড়ি করার অনুমতি দাও। আমরা এই শত বছরের পুরনো বাঁশের বাড়িটি ভেঙ্গে একটি বিল্ডিং তুলবো। এখন আমাদের পাঁচ ভাইয়ের টাকার অভাব নেই।'
বোরহান সাহেবের সঙ্গে তার ছোট্ট মেয়ে মৌ'মনিও বলল,
:-হ্যাঁ দাদীমনি ওই নূতন দালান বাড়িতে তোমার জন্য আলাদা ঘর তৈরী করবো। বড় আব্বুর জন্য,সেজ আব্বুর ও চাচুদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা ঘর তৈরী করবো। তোমাকে আর ঐ দূরের খোলা পায়খানায় কষ্ট করে গিয়ে পায়খানা করতে হবেনা। দূরের ঐ বাঁশবাগানের পঁচা পুকুরে মুখ ধৌতেও গোসল করতে হবেনা। তোমার শোয়ার ঘরেই সব পেয়ে যাবে।
তালপাতার ঐ পাখা দিয়ে সারা রাত কষ্ট করতে হবেনা। আমাদের নূতন ঘরে বিদ্যুতের পাখা থাকবে, বিদ্যুতের আলো থাকবে। ওই পাখা নিজে নিজেই সারাক্ষণ ঘুরতে থাকবে। ওই তেলের চেরেকের মিট মিট আলো তুমি দেখতে পাওনা।
তোমার কি মনে নেই তেলের চেরেকের ঐ আঁধারে আলো গুলোতে তুমি ভাতের পাত্র মনে করে গরম তরকারির পাত্রে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে হাত পুড়ে ফেলেছিলে। এখনো তো সেই দাগ রয়ে গেছে। আমাদের ওই নূতন দালান ঘরে বিদ্যুতের ফকফকা বাতি জ্বলবে। লক্ষ্মী দাদীমনি আব্বুর সঙ্গে ঝগড়া করোনা। তুমি এক্ষুণি বলো এই পুরনো বাঁশের ভাঙ্গা ঘরটি ভেঙ্গে ফেলে নূতন দালান ঘর বানাতে।
বোরহান সাহেব ও তার ছোট মেয়ে মৌ'মনির এতক্ষণের এতোকথা শুনার পর নব্বই বছরের বৃদ্ধা পুরোনো মানুষটি তারচতুর্থ ছেলেকে ও আদুরে নাতনীকে সোজা সাপটা জবাব দিল, এবং বলল,
আমি তোমাদের বাপ মেয়ের কোন কথা শুনতে পায়নি। এতক্ষণ আমি ঘুমছিলাম। আর কোন কথা না বলে আমার পাশ থেকে চলে যাও। না হলে আমি এখন...।
শেষ মেষ আর কোন কথা না বলে অসহায়ের মতো মৌ’মনিকে নিয়ে তার আব্বা রান্না ঘরে মৌ'মনির মায়ের কাছে গিয়ে রান্না কতদূর এগোল তার তদারকিতে গেল।
(দুই)
রাত্রে খাবার ঘরে মৌ'মনি,তার আব্বা, আম্মা,ছোট চাচা,চাচী ও তার দীদামনি একত্রে খাবার খেতে বসলো। কারো সঙ্গে কারো কোন কথা নেই।বলা যায় নিরব ঝগড়া চলছে। আজ দু'মাস ধরে এমন অবস্থা বিরাজ করছে।এক শত বছরের পুরনো বাঁশের ঘর ভেঙ্গ নূতন দালান ঘর বানানোর বিষয় নিয়েই এই মান অভিমান ঝগড়া। গত এক মাস আগে বোরহান সাহেবের বড় তিন ভাই তাদের ছেলে সন্তান ও স্ত্রীদের নিয়ে যার যার মতো বেরিয়ে যায়। শুধুমাত্র এই নূতন ঘর বাঁধার বিষয় নিয়ে। তাদের কথা হচ্ছে বাপদাদার আমলের পুরনো জরাজীর্ণ বাঁশের এই ঘর ভেঙ্গে সকলের জন্য আলাদা আলাদা করে ঘর বাঁধবো। আর তাদের নব্বই বছরের বৃদ্ধা মায়ের কথা হচ্ছে বাপদাদার দিনের একমাত্র স্মৃতি চিহ্ন এই পুরনো ঘর কোন দিনই ভাঙ্গতে দিবেনা। তাদের বৃদ্ধা মা'র কথা হচ্ছে, ''আমি মরে গেলেই কেবল এই পুরনো ঘর ভাঙ্গতে পারবে।'' এখনো এই ঘরে তার পাঁচ ছেলে অনায়াসেই থাকতে পারবে বলে তার মন্তব্য।
কিন্তু তার ছেলেদের কথা হচ্ছে আধুনিক যুগে এই সকল পুরনো বাঁশের ঘর জীবন যাপনের উপযোগী নয়। তাদের বৃদ্ধা মা'র পাঁচ ছেলে মায়ের কথার অবাধ্য হতে রাজী নয়। তাই তারা ঘর ভাঙ্গতে ও পারল না বাঁধতে ও পারল না। শেষমেষ বড় তিন ছেলে বাইরে ঘর ভাড়া নিয়েছে আর দু'ছোট ছেলে বাপ দাদার পুরনো বাঁশের ঘরে বৃদ্ধা 'মা'কে নিয়ে থাকছে।
রাত্রে খাবার খাওয়ার সময় বোরহান সাহেবের বৃদ্ধা মা বোরহান সাহেবের স্ত্রীকে বলল, ''বৌ'মা আমার মাছের কাঁটাগুলো আলাদা করে দাওতো। আমি ভাল দেখতে পাচ্ছিনা।''এই কথা গুলো শুনার বৃদ্ধার ছোট নাতনী মৌ'মনি বলে উঠল,'' এখন দেখ দাদীমনি। এই তেলের চেরেকের মিট মিট আলোতে তুমি মাছের কাঁটা দেখতে পাচ্ছনা। এই বাঁশের ঘর ভেঙ্গে নূতন দালান ঘর হলে বিদ্যুতের আলোতে তুমি সব দেখতে পাবে।''
মৌ'মনির নূতন দালান ঘরের কথা শেষ হতে না হতেই তার আব্বা, আম্মা, চাচা সকলেই মৌ'মনির কথার সঙ্গে সুরমিলিয়ে বৃদ্ধাকে আর ও একবার বুঝাতে চেষ্টা করছে যে, ''এই মুহূর্তেই আমাদের একটি নূতন বাড়ি তৈরীর প্রয়োজন। পুরনো বাঁশের বাড়িটি এখন বসবাসের জন্য অনুপযোগী। যদি টাকা পয়সা না থাকতো তাহলেই কেবল বাপদাদার আমলের পুরনো বাঁশের বাড়িতে থাকা দরকার হতো। এখন নূতন দালান করার জন্য সব আয়োজন সম্পন্ন। শুধু বৃদ্ধা 'মা'এর অনুমতি সাপেক্ষেই এই পুরনো ঘর ভেঙ্গে ফেলা ও নূতন দালান জোড়ন দেয়া।''
ভাতের থালায় এই সব কথা যখন বৃদ্ধাকে বয়ান করছিল তার ছেলেরা। তখন বড় ধরনের একটি ঝগড়া বাঁধিয়ে ফেলল সে। শেষ পর্যন্ত আর কারোরই খাবার খাওয়া হলনা। খাবার অসমাপ্ত রেখে সবাই মান অভিমান করে যার যার বিছানায় চলে গেল। শেষ বারের মতো বৃদ্ধা মৃত্যুর কসম দিয়ে বলল, ''আর একবার যদি এই ঘর ভেঙ্গে ফেলার কথা বলা হয় তাহলে হয় আমি বের হয়ে যাব ঘর থেকে। না হয় তোমরা সকলেই বার হয়ে যাবে। আর যদি আমার কথা অবাধ্য হয়ে জোর করে ঘর ভাঙ্গা হয় তাহলে আমি পুকুরে ঝাঁপদিয়ে প্রাণ দিয়ে ফেলবো।''
এরপরে পুরনো ঘর ভেঙ্গে নূতন ঘর বাঁধার ব্যাপারে বৃদ্ধার কোন ছেলে,ছেলের বৌসহ কেউই আর বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলার সাহস করেনা। এমনকি মৌ'মনিও। এই ক'টা দিন এব্যাপারে কোন কথা বলল না। তবে সে এ ব্যাপারে খুব দু'শ্চিন্তায় আছে এবং নিজেকে এক অসহায় জীবনে মনে করে কারো সঙ্গেই কোন কথা না বলে দিন কাটাচ্ছে।
(তিন)
আজ রাতেও খাবার ঘর কারো সঙ্গে কেউ কোন কথা না বলে যার যার খাবার খেয়ে বিছানায় শুতে গেল। মৌ'মনি গত দু'মাসের সব ঘটনা ও আজ ক'দিন ধরে এই সব বিষয়কে খুব মন দিয়ে অনুধাবন করছে। সে খুব গবেষণায় মগ্ন থাকে সব সময়। কি করে এত বড় একটি পারিবারিক যুদ্ধের সমাধান করা যায়। মৌ'মনি নিজে নিজে ভাবছে কেউই এর সঠিক সমাধান দিতে পারছেনা। সে নিজে কেন বসে থাকবে,তার একটি কিছু করা চাই। সে এর একটি সমাধান অবশ্যই বের করবেই।
গভীর রাত। ভাবতে ভাবতে সে শোয়া থেকে বসলো। তার দু'পাশে তার মা ও বাবা ঘুমানো। মৌ'মনির ঘুম আসছেনা সে আজ একটা কিছু করবেই। কি করে তাদের পুরনো ঘর ভাঙ্গা ও নূতন ঘর করা যায় সে বিষয়ে গত ক'দিন ধরে একটি বিষয় খুঁজে পেয়েছে সে। ধীরে ধীরে মৌ'মনি খাট থাকে নেমে এলো।আস্তে আস্তে তার দাদীমনির ঘরে ঢুকলো। দাদীমনির বিছানার পাশে সারারাত একটি চেরেক জ্বলতে থাকে। কেউ অনুভব করতে না পারে মতো দাদীমনির ঘরের জ্বলন্ত চেরেকটি হাতে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলল। মৌ'মনি গত বছরের একটি অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাল।তারএখনো মনে পড়ে। সে গত বছর রান্না ঘরে সন্ধ্যাবেলা চেরেক নিয়ে খেলা করছিল। কেমনে কেমনে তার হাতের চেরেক থেকে রান্না ঘরে আগুন ধরে গেছে সে বুঝতে পারেনি। কে কোথায় আছে সবাই দৌড়ে এসে আগুন নিভিয়ে ছিল।
ঠিক যেই ভাবা সেই কাজ।বাড়ির সবাই নীরবে নাক ডেকে ঘুমুচ্ছে।মৌ'মনি তার দাদীমনির জ্বলন্ত চেরেকেরসাহায্যে রান্না ঘরের একপাশে আগুন ধরিয়ে দিলো। আগুন দ্রুত জ্বলতে সাহায্য করার জন্য রান্না ধরে রাখা কেরোসিনেরবোতল থেকে সব কেরোসিন বাঁশের বেড়া ও চালের নিকটে ঢেলে দিল।
রান্নাঘর সহ সম্পূর্ণ ঘরটি অনেকদিনের খট খটে পুরনো বাঁশের বেড়া ও ছাউনি দিয়ে তৈরী ছিল। তাই এক নিমিষেই আগুন ধরে যায় সমস্ত ঘরে।
শত বছরের পুরনো বাঁশের ঘরে যখন আগুন ধরে গেল। দাউদাউ করে আগুনের মাত্রা নিমিষেই বেড়ে গেল। এই ফাঁকে মৌ'মনি তার মা,বাবাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতে গেলো। বাবা আগুন ধরেছে ঘরে। সবাই হুড়মুড় করে ঘুমথেকে উঠে ঘরের বাইরে এসে আগুন নিভানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আশেপাশের প্রতিবেশীরাও ছুটে এলো। ঘর থেকে বৃদ্ধামা'কে বের করে নিয়ে এলো বোরহান সাহেব ও তার ছোট ভাই। আগুন নিভানোর চেষ্টায় যখন নিজেদেরকে ব্যস্ত করে তুলল সবাই তখন মৌ'মনি তার বাবা ও চাচাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বললো,
আব্বা,আমিই এই পুরনো ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছি। এই আগুন নিভানোর দরকার নেই। এই পুরনো ঘর পুড়ে গেলেইতো আমরা নূতন দালান ঘর বানাতে পারবো।
ছোট মৌ'মনিকে কোলে নিয়ে বোরহান সাহেব,তার ছোট ভাইসহ স্কলেই শত বছরের বাপ দাদার বাঁশের পুরনো ঘরটি প্রচন্ড আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করল। তাদের এই ঘর পুড়ার সময় কান্নার বদলে সকলের মুখে হাসি ছিল। দুঃখ আর বেদনার পরিবর্তে ছিল আনন্দ।
ঘর পুড়ার এই আনন্দের মধ্য দিয়েই বোরহান সাহেব,মৌ'মনি ও সকলেই খুঁজে পেলো একটি ‘নূতন দালান’ তৈরীরসুযোগ। পূর্ণ হলো তাদের অনেক দিনের স্বপ্ন।
সুনদর চেষটা। বানান আর ভাষারিতির দিকে লখখ্য রাখলে আরো উপভোগ্য হতে পারতো লেখাটি
সুন্দর গল্প। চালিয়ে যান।

চমৎকার গল্প...
চলুক
মন্তব্য করুন