ঋকের জন্মদিন
ঘড়ি ধরে দেখবে, যদি দুইটা ব্যাথার মাঝের সময়ের ব্যবধানটা ৫ মিনিটের কম হয় আর যদি চাপটা ১ মিনিটের বেশী সময় থাকে তাহলে সোজা হাসপাতালে চলে আসবে- ডাক্তার ফোন নাম্বারও দিয়েছিলো, যেকোনো জরুরী মুহূর্তে ফোন করার জন্য, প্রথম বার যারা বাবা-মা হবেন তাদের জন্য উপদেশ হাসপাতালে যাওয়ার ব্যাগটা আগেই গুছিয়ে রাখবেন-
মোবাইলের ঘড়ি ধরে ব্যাথার সময়সূচি মাপছি, ব্যাগ গুছিয়ে রাখা হয় নি, যেকোনো সময় গাড়ী লাগবে, পরিচিত সবাইকেই বলে রেখেছি, দিনে-রাতে যেকোনো সময় গাড়ীর দরকার হলে ফোন করবে বন্ধুরা সবাই এমনই নিশ্চয়তা দিয়েছে।
আমাদের প্রতিবেশী নেপালের ছেলে মেঘ নিরুলাকে রাত ৪টায় ফোন দিয়ে দিনটা শুরু করেছিলাম।
বেবী ইজ রেডী টু কাম? আই এম কামিং
মেঘের গাড়ীতে চড়ে কয়েক মাইল দুরের হাসপাতালে পৌঁছানোর পর থেকেই অপেক্ষার শুরু,
বিধি-বন্দোবস্ত চমৎকার, সাথে সাথেইএকটা লেবার রুম পাওয়া গেলো, সেখানে বিছানা, মনিটর, মনিটরের সাথে অনেকগুলো তার- দুইটা মনিটরের একটাতে বাচ্চার হার্টবীট, মায়ের ব্লাড প্রেশার, মায়ের হার্ট বীট আর তামপাত্রা দেখাচ্ছে অন্য মনিটরে ব্যাথার পরিমাণ মাপছে
নির্দিষ্ট সময় পর পর সেই মনিতরের আঁকাবাঁকা রেখাগুলোর উচ্চতা বাড়ছে, উপস্থিত নার্স বলছে ইয়্যু আর হ্যাভিং এনাদার কনট্রাকশন, রিলিফ ইয়োর সেলফ, ডোন্ট স্ট্রাগল,
দুইটা ব্যাথার মাঝের সময় মাপছে, তারপর অনেক রকম মাপ শেষ করে বলছে এখনও সময় লাগবে
সকাল দশটায় ডাক্তার এসে বললো বেবীর পজিশন ঠিক নেই, বাকি সব ঠিক আছে-
জোয়ানা এসে উপস্থিত হয়েছে সকাল ৭টায়, ওর ৯ মাসের মেয়েকে প্রতিবেশীর জিম্মায় রেখে। ও সম্পূর্ন সময়টাতে সাহায্য সহযোগিতা করবে- আত্মবিশ্বাস জোগাবে- মিউজিকে অনার্স করে ওরা একটা চার্চে কাজ করে, ওর জামাই ডেভিড চার্চের ব্যান্ডের ড্রামার, জোয়ানা অর্গান বাজায়, ও গান লিখে সুরও করে, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চার্চের ভলেন্টিয়ার- ওদের চার্চের অনেকেই নিয়মিত লিপির খোঁজ নিয়েছে, বেবী শাওয়ার করেছে, অনাগত বাচ্চার জন্য বিভিন্ন ধরণের উপহার নিয়ে এসেছে, আমরা হাসপাতালে সেইসবের কয়েকটা নিয়েও এসেছি।
রাজা, কুর্নিয়া, মেঘ সবাই কেবিনের বাইরে দাঁড়ানো, সবাই ঘরে এসেছে, শুভেচ্ছা জানিয়েছে, বলেছে আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি, কোনো কিছুর প্রয়োজন হলেই জানাবে। আমি ঘরের বাইরে যাচ্ছি, প্রায় অপরিচিত হাসপাতালের করিডোর ঘুরে ঘুরে ক্যাফেটেরিয়া খুঁজে বের করেছি,সেখানে গিয়ে কফির মগ নিয়ে হাসপাতালের বাইরের বেঞ্চে বসে সিগারেট টানি, আবার অন্য কোনো পথে ফিরে আসি। ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে আবার যাই, হাসপতালের বেঞ্চে নইলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানি, হাসপাতালের নিজস্ব বাস সার্ভিস আছে, বাস স্টপেজের পাশে এসট্রে রাখা, সেখানে সিগারেট টেনে আরও সামনে গিয়ে হাঁটি- আবার ফিরে আসি। আমার করনীয় কিছুই নেই,
ইয়্যু আর নট ডায়ালেটেড এনাফ বক্তব্যটা পরিবর্তিত হয়েছে, এখন প্রশ্ন একটাই ডিড ইয়োর ওয়াটার ব্রোক?
পরের বার ফিরে এসে দেখলাম ডাক্তার বলছে যদি অনুমতি দাও তাহলে আমরা বাইরে থেকে তোমার ওয়াটার ব্রেক করবো, আমরা একটা পিন দিয়ে সেটা ফুটো করে দিবো, তোমার সম্মতি লাগবে-
লিপি তখন এসব সম্মতির উর্ধ্বে, যা হোক কিছু একটা করো, অনেক ব্যাথা। কিছুক্ষণ পর পর আল্লাহ আল্লাহ হুংকার দিচ্ছে , অবশেষে ঘড়িতে ৩টা বাজবার সময় পুশ পুশ এ লিটলবিট মোর, পুশ ইট আউট
আমি পাশে দাঁড়িয়ে দেখছি আমাদের ছেলের মাথাটা বের হয়েছে, ডাক্তার ঘাড়ের পাশে হাত দিয়ে টেনে বের করলো- আমার বুকের ভেতরটাতে একটা মোচড় দিলো, এত জোরে টানছে কেনো, হাতে ব্যাথা লাগবে তো
অভিজ্ঞ হাতের টানে বের হয়ে আসলো ছেলে , তারপর তার নাড়ী কেটে মায়ের বুকে রাখলো কিছুক্ষণ, পরে পাছায় থাবড়া দিয়ে কাঁদালো, ওজন মাপলো, তারপর বললো ওর নি:শ্বাস নিতে সামান্য সমস্যা হচ্ছে- ওকে অক্সিজেন টেন্টে রাখতে হবে, চিন্তা করো না, ওর বেশী অক্সিজেন দরকার, ওর ফুসফুস ততটা অক্সিজেন টানতে পারছে না।
কিছুক্ষণ পর ওকে ফেরত দিয়ে গেলো, রাজার কাছে সংবাদ পেয়ে রেহনুমা, অঞ্জলি এসেছে হাসপাতালে, ওরা সবাই বাইরে অভিনন্দন জানালো, ৭ বছর আগে এমন এক দিনে আমি একটা ছেলের বাবা হয়ে গেলাম , এর আগে আমার কোনো দিন ছোটো ছেলে ধরবার অভিজ্ঞতা ছিলো না, লিপিরও অভিজ্ঞতা আমার সমান, একদিনের বাচ্চাকে ধরতে হয় কিভাবে আমাদের জানা নেই, বাচ্চাকে ডায়াপার পরায় কিভাবে আমাদের জানা নেই।
আমি হাসপাতালের অন্যপাশে গিয়ে জীবনে প্রথম ক্যামেরা কিনলাম, ক্যাননের কোনো একটা, সাথে ফিল্ম। ফিল্ম কিভাবে লাগায় সেটাও জানা নেই, সান্তনা একটাই নির্দেশনা অনুসরণ করে সব কাজ করা যায়। ক্যামেরা কিনে পরমানন্দে কেবিনে গিয়ে ঋকের ছবি তুললাম।
প্রয়োজনে মানুষ অসাধ্য সাধন করে,আমরাও শিখলাম । একেবারে গ্রাম্য সংস্কৃতির মতো চার্চের মায়েরা প্রথম এক সপ্তাহের প্রতিদিন আমাদের খাবার দিয়েছে, গ্রীক মেয়েটা দিয়েছে তাদের রান্না, ইটালিয়ান মহিলা বিশাল এক বাটি পাস্তা পাঠিয়েছে, সব মিলিয়ে প্রথম দুই সপ্তাহের প্রতিটা দিনই ছিলো উৎসব, রেহনুমা আসছে, অঞ্জলি আসছে, তারা নিজের ভাষায় কথা বলছে- সার্বিয়ার মেয়ে মারিয়া আবিস্কার করলো সত্যটা, ছোটোদের সামনে সবাই উল্টাপাল্টা শব্দ উচ্চারণ করে, সেসবের কোনো অর্থ নেই, বাচ্চাও কিছু বুঝে না, যারা বলছে তারাও কিছু বুঝে না, যারা শুনছে তারা কোনো অর্থ খুঁজে পাবে না এইসব শব্দের, তারপরও বাঙালী লবজে গুটু, গুটলু, এইসব শব্দ পরিচিত আমাদের।
জোয়ানা একদিন ডিনারে এসে বললো কি রকম লাগছে,
বললাম সবই ভালো, শুধু কোলে নিতে সমস্যা হয়, মনে হয় জেলোর মতো হাতের ফাঁক দিয়ে নীচে পরে যাবে- এই সমস্যা বাদ দিলে তেমন জটিলতা নেই।
জোয়ানা পরবর্তীতে তার পরিচিত সবার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছে- লুক দিস ইজ রাসেল, হি থিংকস বেবী ইজ লাইক জেলো।
আমি ভয়ে প্রথম দুইমাস ঋককে কোলে নিতাম সাবধানে, কোনোমতে কোলে তুলে পায়ের উপরে রাখতাম, সেখানেই ঘুম, সেখানেই খাওয়া, সেখান থেকে তুলে বেবী কটে রাখা, বেবী শাওয়ারে একটা স্ট্রলার পাওয়া গেলো , সেটাতে ঋককে রেখে নিয়মিত প্রতিদিন বিকেলে বাইরে বের হওয়া, নদীর পাশ থেকে রাস্তার ফুটপাতে স্ট্রলার ঠেলতে ঠেলতে অন্য রাস্তায় বাসায় ফিরে আসা।
ধীরে ধীরে ঋক বড় হয়ে গেলো, ঘরের এলেমেলো জিনিষ ধরে ধরে দাঁড়াতে শিখলো। সে সময় পর্যন্ত বিষয়টা আনন্দময় ছিলো- এমন কোনো একদিন, ঋক তখনও হাঁটতে শিখে নি, হামাগুড়ি দিতে পারে, আমি কম্পিউটারে বসে আছি, লিপি ঋককে নিয়ে বাইরে কোথাও, সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছি, দেখি ঋক হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠছে-
বাবা হওয়ার একটা উৎকণ্ঠা থাকে, উদ্বেগ থাকে, যেকোনো মুহুর্তে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটবে , বাচ্চা ব্যাথা পেতে পারে, পৃথিবীর সবগুলো পাথরকে ফোমে মুড়ে দেওয়া সম্ভব না, বাসার সবগুলো আসবাবের কোণা মুড়ে দেওয়া সম্ভব না, অনেক জায়গায় অনেক রকম দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, রান্না ঘরের দরজা বন্ধ রাখো, বাথরুমের দরজা বন্ধ রাখো, সিঁড়ির সামনে ব্যারিকেড দিতে হবে- এইসবের ভেতরেও আনএটেন্ডেন্ট বাচ্চা কিভাবে সিঁড়ির মাঝধাপে?
লিপির এমন অসাবধানী আচরণ মেনে নেওয়ার মতো মানসিক পরিস্থিতি তখন ছিলো না, প্রায় ৬ বছর পরে এখনও লিপির সেই দিনের অসাবধানী আচরণকে কোনো যৌক্তিক আবহ দিতে ব্যার্থ আমি, লিপি উদাসীন এবং অসাবধানী একজন মা এই পরিচয়ের জটিলতা থেকে এখনও বের হয়ে আসতে পারি নি।
গত ৭ বছরের সবগুলো দিনই আনন্দময় ছিলো না, অনেক সময়ই, তবে ইদানিং ঋত হওয়ার পর অনেক বেশী, ঋকের আচরণে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হয়েছে, মাঝে মাঝে অসভ্য বর্বরের মতো চিৎকার করেছি, পরবর্তীতে লজ্জিত হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি, নিজের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়েছি-
জন্মের প্রথম দিন থেকে বেবি বাই উইকস পড়া শুরু হয়েছিলো, অসাধারণ একটা বই, নেসলে কোম্পানির ছাপানো, প্রথম ৫২ সপ্তাহে বাচ্চার কি কি শাররীক মানসিক পরিবর্তন হবে,আদর্শ ওজন কত হবে, কোন পরিস্থিতিতে ডাক্তার ডাকতে হবে, কোন পরিস্থিতিতে কি আচরণ করতে হবে, বিস্তারিত লেখা আছে সেখানে। অনেক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লেখা আছে , এই চমৎকার বইটার কোনো বাংলা অনুবাদ নেই। আমি মাঝখানে ভেবেছিলাম বইটা অনুবাদ করবো, বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নিয়েও কাজ আগানো সম্ভব হয় নি। এখনও সেই পড়া অব্যহত আছে।
তবে এখন ততটা নিয়মিত পড়া হয় না, এই বয়েসে ছেলে মেয়েরা মুখে মুখে তর্ক করবে, বাজে কথা শিখবে, উল্টোপাল্টা আচরণ করবে- এসবকে কিভাবে মোকাবেলা করতে হয় সেসবের বিশেষজ্ঞ বয়ানও আছে, তবে বাঙালি বাবার মতো চিৎকার ধমকের অভ্যস্ত অতীত থেকে বের হয়ে আসা সব সময় সম্ভব হয় না।
ঋক কেক কাটতে পছন্দ করে, সম্পূর্ণ অকারণে মাসের মাঝামাঝি গিয়ে একটা কেক নিয়ে এসে মোমবাতি জ্বালিয়ে জন্মদিন করা হয়েছে- গত কয়েক বছরে অন্তত ২০ বার জন্মদিন করা হয়েছে বাসায়, প্রতিবারই মোমবাতি জ্বালিয়ে কেক কাটা হয়েছে, হাত তালি দেওয়া হয়েছে, ওর এইসব ছোটোখাটো বিষয়ে আনন্দ পাওয়ার অভ্যাস গত এক বছরে কমে গেছে-
তবে ও জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত বেশ লক্ষী ছেলে, কোনো যন্ত্রনা দেয় নি, কখনও বড় কোনো অসুখে ভুগে নি, তেমন অহেতুক জিদ করে নি, কান্নাকাটি করে নি, ভালোবাসায় আমাকে সামলে রেখেছে গত ৭ বছর।
সবসময় এরকম লক্ষী ও সুস্থ থাকুক ঋক। বাবা-মা'কে ভালবাসায় ভরিয়ে রাখুক, তাদের জন্য নিয়ে আসুক সম্মান।
ওর জন্মদিন কত তারিখে? জন্মদিনের শুভেচ্ছা থাকলো।
এই ২৮শে জুন,
প্রথম বাবা হওয়ার আনন্দের কাছে সব কিছুই তুচ্ছ !
সুন্দর অনুভূতির প্রকাশ, ভাল লাগলো
অনেক অনেক শুভকামনা ঋকের জন্য
বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে টু ঋক...
সবকিছুর সাথে একমত
বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে টু ঋক
বিলেটেড হ্যাপি বার্থডে টু ঋক...
মন্তব্য করুন