আমাদের না লেখা ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাসের ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ খুব সচেতন ভাবেই অনুচ্চারিত রয়ে গেছে, যারা প্রত্যক্ষদর্শী, রাজনীতিতে নিমজ্জিত ছিলেন তারাও এই সময়কালের রাজনীতি বিষয়ে খুব বেশী আলোচনা করতে অনাগ্রহী, একটি স্বাধীন দেশের সূচনার সাড়ে তিন বছর যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, আমাদের সচেতন বুদ্ধিজীবীগণ এই হারানো সময়ের রাজনৈতিক আবর্তে প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খা্চ্ছেন, বিভিন্ন ধরণের তথ্য উপস্থাপন করছেন, রাজনৈতিক বিরাগ থেকে কিংবা রাজনৈতিক সুবিধা অর্জনের লোভে তারা যেসব তথ্য উপস্থাপন করছেন সেখান থেকে বাস্তবতা অনুধাবন করা দুরহ।
আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি নেই, সুতরাং অপরাপর ব্যক্তিদের স্মৃতিচারণ সম্বল করে এই সময়ের অস্পষ্ট একটা ছবি নিজের ভেতরে তৈরি হয়েছে। রওনক জাহানের বাংলাদেশ পলিটিক্স প্রবলেমস এন্ড প্রমিজেস কিংবা তালুকদার মনিরুজ্জামানের রেভ্যুলেশোন এন্ড আফটারম্যাথের একাডেমিক বিশ্লেষণের সাথে সে সময়ের বিভিন্ন ব্যক্তির স্মৃতিচারণ কিংবা দিনলিপি এক ধরণের সহায়তা করেছে।
তারই ধারাবাহিকতায় পড়লাম আব্দুল হকের লেখকের রোজনামচায়চার দশকের রাজনীতি-পরিক্রমা ১৯৫৩-১৯৯৩ এবং ইকবাল আনসারী খানের The third eye- glimpses of the politics । পড়ার আগে ধারণা ছিলো না ইংরেজী ভাষা কতটা বিষাক্ত, তিক্ত অনুভুতি ধারণ করতে পারে। তেঁতো ভাষায় রাজনীতিবিদদের স্থুলতা কিংবা অন্তঃসারশূণ্যতা তুলে আনতে গিয়ে তার ভাষায় খুব তীব্র ভাবেই প্রত্যাশা ভঙ্গের তিক্ততা ফুটে উঠেছে।
আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সহসভাপতি আলী আমজাদ খান এবং আনোয়ারা খাতুনের সন্তান হিসেবে ইকবাল আনসারী খানের অতীতের পাতা খুলে কি বলার আছে সে আগ্রহ থেকেই বইটা কিনেছিলাম। শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই তাদের বাসায় অবস্থান করেছেন, লেখক তাদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন, একই সাথে সভা সমিতিতে গিয়েছেন, মিছিল করেছেন। তার কাছে থেকে দেখা এইসব রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে তিনি বইয়ের ফ্ল্যাপের ভাষায় " সৎ এবং নিরাবেগ" মন্তব্য করেছেন। তবে তার মন্তব্যগুলো এসব রাজনীতিবিদদের স্থুলতাই প্রকট করে তুলেছে।
ভাষা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহন করার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নামী নেতাদের সাথে নিত্যদিনের বসবাসের ফলে এসব নেতাদের সম্পর্কে ভক্তদের যে শ্রদ্ধা-বিনয়মিশ্রিত অমায়িক অনুভুতি, লেখকের ভেতরে তার লেশমাত্র নেই। ব্যক্তিগত তিক্ত উচ্চারণ সব সময়ই সত্য এমনটা মেনে নেওয়া কঠিন। তবে আতাউর রহমান খান যখন তাকে "সৎ" এবং "নিরাবেগ" থেকেই তার অবস্থান থেকে সত্য তুলে ধরতে বলেছেন তখন তিনি সেখানে ভাষার কারুকার্যে তিক্ততা আড়ালের চেষ্টা করেন নি।
তাদের অনেক বিশ্লেষণের সাথে আমি একমত নই, অনেক ঘটনার বর্ননা তারা যেভাবে দিয়েছেন সেটাই ঐতিহাসিক সত্য এমনটা মেনে নিতে আমার আপত্তি আছে, কিন্তু তারা যেভাবে এ সময়টাকে দেখেছেন সেটার গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ভৌগলিক ব্যপ্তি এবং যারা সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো না কোনো পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন তাদের মানসিক উপলব্ধি ব্যস্তানুপাতিক। বাংলাদেশের ভৌগলিক ব্যপ্তিতে ছড়িয়ে পরা এই স্বাধীনতা আন্দোলন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদেরও সরাসরি আক্রান্ত করেছে, নিতান্ত অনিচ্ছুক হলেও যুদ্ধের ভয়াবহতা তাদের স্পর্শ্ব করেছে, এই দুর্যোগকালীন সময়ে তারা নিজস্ব অভিজ্ঞানে এক ধরণের স্বাধীন দেশের স্বপ্ন লালন করেছেন নিজের ভেতরে, সেই কল্পনা পুরণের স্বপ্ন বুকে নিয়ে একটা অস্থির রক্তপাতের ভেতরে বসবাস করেছেন এবং যাদের কথা লোকমুখে কিংবা রেডিওতে শুনেছেন, তাদের কারো কারো দুর্ভোগের জীবন সরাসরি অবলোকন করেছেন তারা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পৃথিবীতে অনন্য, অনেক ধরণের তথ্য উপস্থাপন করা যায় তবে স্বাধীন দেশে মানুষের প্রত্যাশাপুরণের ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে সবাই সর্বপ্রথম যে ঘটনাকে প্রধান্য দিয়েছে, স্বাধীনতার প্রথম প্রহরে শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন। যদিও সম্পূর্ণ সময়টাতেই বাংলাদেশের প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিটি মুক্তিকামী জনগণ পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি মুজিবের নামে শ্লোগান দিয়েছে, পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুজিবকে ছিনিয়ে নিয়ে আসার অনুপ্রেরণায় মৃত্যু বরণ করেছে কিন্তু স্বাধীন দেশে মানুষের দুর্ভোগের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষ একই স্বরে আক্ষেপ করেছে "যদি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন না করে শেখ মুজিব বাংলাদেশে কিংবা ভারতে থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতেন তাহলে হয়তো শেখ মুজিব উপলব্ধি করতে পারতেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশের সাধারণ মানুষ কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছে, কতটা ক্ষতি আর ক্ষত বুকে পুষে তারা স্বাধীন দেশে মুজিবের আগমণের প্রতীক্ষা করেছে, ভেবেছে মুজিবের হাতে সেই রূপকথার কাঠি যা স্পর্শ্ব করালেই তাদের স্বাধীন দেশের স্বপ্নকল্পনা বাস্তবায়িত হয়ে যাবে।
আমাদের রাজনীতিতে সব সময়ই আত্মকেন্দ্রীক, একগুঁয়ে পরমতঅসহিষ্ণু ক্ষমতালিপ্সুরাই দেশ এবং রাজনৈতিক দলের কর্ণধার হয়েছেন, রাজনৈতিক বিরোধীদের হেয় এবং হয়রানী করার ন্যুনতম সুযোগ ব্যবহার করা, অনাকাঙ্খিত হলেও একদা রাজনৈতিক সহকর্মীদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা এবং অহেতুক কোনো না কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের চর হিসেবে রাজনৈতিক সমাবেশে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং তাদের অন্ধ স্তাবক অনুসারীদের সেসব কুৎসা আরও দ্রুত আরও আবেগ এবং অহেতুক তথ্যে সম্প্রচারের বাস্তবতাটুকু আমাদের মেনে নিতে হবে। নাগরিক হিসেবে আমরা খুব বেশী গণতান্ত্রিক কিংবা পরমতসহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে পারি নি।
শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহিদ সুহরাওয়ার্দী, খন্দকার মোশতাক, মাওলানা ভাসানী, শাহ আজিজুর রহমান, মোহন মিঞা, নান্না মিঞা, জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া শেখ হাসিনা এবং একই কাতারে হয়তো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতাদের টেনে নিয়ে আসা যায়। এদের প্রত্যেকেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেনেস্থা করেছেন, এদের প্রত্যেকের ভেতরেই বাইনারী ব্যক্তিত্ব প্রবল, ক্ষমতাসীন অবস্থায় এদের ভাবভঙ্গী এবং ক্ষমতাচ্যুত অবস্থায় এদের আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সময়কালে রাজনীতিবিদদের ভেতরে একটা কৌতুক প্রচলিত ছিলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বদেশে ফিরে এলেন, বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দলের নেতারা দলে দলে তার কাছে গিয়ে আনুগত্য প্রকাশ করেছেন, এমন সময় তার সাথে দেখা করটে গেলো বাংলাদেশ পকেটমার সমিতির সদস্যরা।
বঙ্গবন্ধু আমরাও তো আপনার নামে শ্লোগান দিয়েছি, দেশের স্বাধীনতায় আমাদের অবদান রেখেছি, আপনি তো সভা সমিতিতে চোর ডাকাতদের নির্মূলের ঘোষণা দিচ্ছেন এখন আমাদের রুটি-রুজির বন্দোবস্ত কিভাবে হবে?
শেখ মুজিবুর রহমান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন ব্যাটারা তোদের কথা আমি ভাবি নি এটা ভুল। এই যে গত সপ্তাহে রেসকোর্সে বিশাল জনসভা হলো, সেখানে আমি আমার দাবির সপক্ষে সবার সমর্থন চাইলাম, বললাম আপনারা দুই হাত তুলে আমার কথায় সমর্থন জানান, তখন তোরা কি বাল ছিড়লি?
শেখ মুজিবুর রহমান ব্যক্তিগত জীবনে বাক্যব্যবহারে খুব বেশী সংযত ছিলেন না, ফয়েজ আহমেদ কিংবা তার ঘনিষ্ট অন্যান্যদের স্মৃতিচারণে বিষয়টা স্পষ্ট সুতরাং "বাল ছিড়া"র মতো বাক্য তার মুখে দেওয়ায় সুশীল হৃদয় আক্রান্ত হওয়াটা বিব্রতকর হবে।
১১ই জানুয়ারী ১৯৭২ শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে ফেরার পরপরইসাময়িক সাংবিধানিক নির্দেশে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নির্দেশ অনুসারে
প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভা গঠন করবেন, এই নির্বাচিত মন্ত্রীসভার হাতেই সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভুত থাকবে। রাষ্ট্রপতি হবেন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রধান।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত সকল নির্বাচিত মেম্বার অফ ন্যাশনাল এসেম্বলী এবং মেম্বার অফ প্রভিন্সিয়াল এসেম্বলীর প্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হবে এবং এই গণপরিষদ সংবিধান রচনা করবেন।
যদিও ১২ই জানুয়ারী থেকে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু তারপরও তিনিই ছিলেন রাষ্ট্রের সকল সিদ্ধান্তের প্রাণকেন্দ্র, সুতরাং ২৩শে মার্চ ১৯৭২, রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে প্রদত্ত শাসনতান্ত্রিক নির্দেশ অনুসার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যে দলের টিকেটে নির্বাচিত হয়েছেন সেই দল ত্যাগ করলে অথবা দল থেকে বহিস্কৃত হলে সদস্যপদ হারাবেন ঘোষণাটি নিজের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করেই তিনি রাষ্ট্রপতির দ্বারা আদায় করে নিয়েছিলেন ভাবনাটা অসংগত নয়।
পরবর্তীতে আমীরুল ইসলাম( বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা কমিটির একজন সদস্য) লিখেছেন ১৯৭২ এর সংবিধানের ৭০ ধারা মূলত পাকিস্তানের সময়কালের রাজনৈতিক ফ্লোর ক্রসিং নিয়ন্ত্রনের ধারণা থেকেই প্রণীত হয়েছিলো। যদিও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পথপরিক্রমায় এই ধারাটা এক ধরণের স্পষ্ট বাধা কিন্তু বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি স্বত্বেও এ ধারাটি সংশোধনের কোনো উদ্যোগ সাংবিধানিক কিংবা অসাংবিধানিক কোনো সরকারের পক্ষ থেকেও নেওয়া হয় নি।
আব্দুল হক তার দিনলিপিতে লিখেছেন শেখ মুজিবের দুর্ভাগ্য তাকে তারা জনপ্রিয়তার বিনিময়ে স্বদেশ নির্মাণ করতে হবে, তিনি অনুমাণ করেছিলেন স্বদেশ গঠনের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমান জনপ্রিয়তা হ্রাস পাবে। অবশ্য তার নজির দেখা গিয়েছিলো ৭২ এর মার্চেই, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি,চোরাচালানি এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের স্বেচ্ছাচারীতায় প্রধানমন্ত্রীর স্নেহবৎসল প্রশ্রয় সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতরে এক ধরণের হতাশার জন্ম দিয়েছিলো।
মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে মুক্তিযোদ্ধা এবং সংঘবদ্ধ অপরাধীরা সশস্ত্র ডাকাতি করেছে, নিরীহ মানুষের বাসা দখল করেছে, তাদের উচ্ছেদ করেছে, নিজেদের ভেতরে গোলাগুলি করেছে, আব্দুল হকের রোজ নামচা থেকে বলা যায় ১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত ঢাকায় বিভিন্ন ছুঁতায় গোলাগুলি করার এক ধরণের প্রবনতা তৈরি হয়েছিলো, দালাল পরিচয় দিয়ে যেকনো কাউকে হত্যা করা, কারো উপর নির্মম নিপীড়ণ করা তেমন অপরাধ বিবেচিত হয় নি।
১২ই মার্চ সর্বশেষ ভারতীয় সৈন্যদের দেশ ত্যাগ এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপাংশের নেতাদের ভেতরে অন্তর্কলহের জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়এলাকায় এবং অন্যান্য অঞ্চলে রাজনৈতিক হত্যার প্রকোপ বৃদ্ধি নিশ্চিত করেছিলো এই সশস্ত্র তরুণদের উপরে কারো কোনো নিয়ন্ত্রন নেই। এরা যেমন ডাকাতি করছে ঠিক তেমন ভাবেই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে অনেকেই ডাকাতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে। আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা ধ্বসের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৭২ এর ৩০শে মার্চ, সেদিন খুলনায় শেখ মুজিবুর রহমানের সফরের সময় রিলিফে দুর্নীতির অভিযোগ করে কয়েকশত লোক বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
শেখ মুজিবুর রহমান দলের উপরে নিজের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন আনার বাসনায় তাজউদ্দি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামানদের বিরোধীদের রাজনৈতিক মিত্র ভাবছেন, শেখ মনি, তোফায়েল কিংবা এইসব তাজউদ্দিন বিরোধী নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের কানে ক্রমাগত বলছে মুজিবনগর সরকারের এইসব নেতারা তার অগোচরে ভারতের সাথে সমঝোতায় এসেছে। দলের উপরে নিজের প্রভাব নিরংকুশ রাখতে এদের শক্ত হাতে রাজনৈতিক ভাবে দমনের চেষ্টা করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান যেমন ভাবে তিনি অতীতেও রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করেছেন।
৫ই নভেম্বর সংবিধান অনুমোদিত হওয়ার পর সে সংবিধানের ভিত্তিতে যখন ঘোষণা করা হলো ১৯৭৩ এর ৭ই মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তখন আওয়ামী লীগ , বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ মোজাফফর বাদে সকল রাজনৈতিক দলই একজোট হয়ে নির্বাচনের উদ্যোগ হিসেবে মাওলানা ভাসানির নেতৃত্বে সম্মিলিত বিরোধী জোট গঠনের চেষ্টা করছিলো। শেখ মুজিব বলেছিলেন মাওলানাকে তিনিই সামলাবেন, তাই মাওলানা ভাসানী যখন সম্মিলিত বিরোধী দল গঠনে সম্মত হলেন ঠিক তার পরপরই শেখ মুজিবুর রহমান সন্তোষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্যে মাওলানা ভাসানীকে বিপুল অঙ্কের টাকা এবং নির্মাণ সামগ্রী পাঠিয়ে দিলেন, সম্মিলিত বিরোধী দল গঠনের চেয়ে ব্যাটা শেখ মুজিবকে অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেন ভাসানি।
একই সাথে সরকারী খরচে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো এবং আওয়ামী লীগের পেশী শক্তির ব্যবহারের ফলে সংসদে বিরোধী দলের উপস্থিতি নগন্য হয়ে গেলো। যদিও আওয়ামী লীগের নেতারা এবং শেখ মুজিব এটাকে সংবিধানের রেফারেন্ডাম হিসেবে ঘোষণা করে পরবর্তীতে ভাষণে বলেছেন এই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ আসলে সংবিধানকে স্বীকার করে নিলো কিন্তু সে সংবিধানও দীর্ঘদিন অবিকৃত থাকে নি। বিরোধী দলকে দমন করতে জরুরী অবস্থা জারীর সংশোধন এসেছে, তবে ১৯৭৫ এর জানুয়ারীর ৪র্থ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক চরিত্রকেই সম্পূর্ণ বদলে দেয়।
শেখ মাজিবুর রহমান চাইলেই সকল রাজনৈতিক দল মতের উর্ধে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় পরামর্শকের ভূমিকা গ্রহন করতে পারতেন, কিন্তু ক্ষমতালিপ্সুতা সম্ভবত তাকে এমন অভিভাকত্বের দায়িত্ব নেওয়া থেকে বিরত রেখেছিলো। তিনি যে সংক্ষিপত দুই টার্মে মন্ত্রী হিসেবে যঠেষ্ট সফল ছিলেন এমনটা বলা যাবে না, কিন্তু এই প্রশাসনিক অযোগ্যতা স্বত্বেও তিনি বাংলাদেশের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করলেন যে দায়িত্ব পালনের মেধা, যোগ্যতা কিংবা দক্ষতা তার ছিলো না। নিজের আত্মজ্ঞান, কৌতুকবোধ, দরাজদিল ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিনি সকল সংকটের তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজেছেন কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের কথা ভাবেন নি।
দালাল আইন প্রসঙ্গে আব্দুল হকের উপলব্ধিতে এক ধরণের সততা আছে, তিনি মন্তব্য করেছেন যদি দালালদের তালিকা তৈরির দায়িত্ব আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের না দিয়ে প্রশাসনের উপরে ছেড়ে দেওয়া হতো তাহলে ব্যক্তিগত বিদ্বেষে অসংখ্য মানুষকে দালাল ঘোষণা করে হয়রানি করার সুযোগ তৈরি হতো না।
সুতরাং
১৯৭৩এর ১৬ই মে বাংলাদেশ সরকার১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) বলে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত কতিপয় শ্রেণীর লোককে ক্ষমা প্রদর্শনের কথা ঘোষণা করেন। অবশ্য কয়েকটি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত কিংবা অভিযুক্ত ও গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের বেলায় এই ক্ষমা প্রদর্শণ প্রযুক্ত হবে না। যাদের বেলায় প্রযুক্ত হবে তাদেরকে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সদাচরণ ও বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের মুচলেকা দিতে হবে। [ সূত্র আব্দুল হক, লেখকের রোজনামচায় চার দশকের রাজনীতি পরিক্রমা ১৯৫৩-১৯৯৩]
একই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরিতে ব্যপক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়, যে কারণে ১৯৭৩ এর জুন মাসের শেষে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ অভিযোগ করে বলেছিলো ভারতে ১ লক্ষ ৩০ হাজার এবং বাংলাদেশে ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ছিলো, অথচ মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট বিতরণ করা হয়েছে ১১ লাখ। এই ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের দৌরাত্ম্যে আজ মুক্তিযুদ্ধ ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা দেশে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে।
বিভিন্ন ধরণের প্রশাসনিক ব্যর্থতা সত্ত্বেও বলা যায় শেখ মুজিবুর রহমান দুর্নীতি বিষয়ে উদাসীন হলেও ব্যক্তিগত জীবনে খুব বেশী দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন না। তার ঘনিষ্ঠ জনেরা তার নাম ব্যবহার করে দুর্নীতি করেছে, তিনি এ বিষয়ে খুব বেশী কঠোর অবস্থান গ্রহন করতে পারেন নি। হয়তো সে কারণেই জিয়াউর রহমান নিজের সৎ ভাবমুর্তি অক্ষুন্ন রাখতে নিজের আত্মীয় কিংবা বন্ধুদের কাউকেই প্রশাসনের সাথে ঘনিষ্ট হতে দেন নি। যদিও তার স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় জিয়াউর রহমানের দুরদর্শীতার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত প্রচন্ড পরাক্রমশীল মাওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত কারিশমা স্বত্ত্বেও তার বিষহয়ে তার সমসাময়িক রাজনৈতিক অনুসারীদের মূল্যায়ন সব সময়ই ঋণাত্মক। দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো মাওলানা ভাসানী কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের স্মৃতিচারণেই খুব বেশী শ্রদ্ধাশীল অবস্থান ধরে রাখতে পারেন নি, এমন কি রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত দিনলিপিতেও মাওলানা ভাসানীর নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানহীনতা ফুটে উঠে। । তার বিরুদ্ধে তার ছত্রছায়ায় রাজনীতি করা ব্যক্তিদের মূল্যায়ন অনুদার। তাদের অভিযোগ "মাওলানা" কখনই চাইতেন না কোনো সভায় অন্য কেউ অধিক গুরুত্ব অর্জন করুক। এবং এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তিনি দীর্ঘ মোনাজাত জুড়ে দিতেন। পরবর্তী সময়েও যে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছলো এমন নয় বরং প্রতিবারই দেখা গিয়েছে তার অনুসারীরাই তাকে দল থেকে বরখাস্ত করেছে নইলে তাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেছে।
আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন এবং এর পরবর্তী সময়ে উত্তরবঙ্গকে আলাদা প্রদেশ স্বীকৃতি দিতে হবে এমন একটি বায়বীয় অপ্রয়োজনীয় আন্দোলন দানা বাধে। স্বাধীন বাংলাদেশে মাওলানা ভাসানী প্রথমেই উত্তরবঙ্গকে আলাদা প্রদেশের মর্যাদার দাবী জানান। পরবর্তীতে তিনি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা ভাষাভাষী জনগণদের নিয়ে আলাদা একটি রাষ্ট্র গঠনের বিপ্লব শুরু হবে এবং সে আন্দোলনকে দমন করার ক্ষমতা ভারত সরকারের নেই। তার হঠকারিতার অন্য একটি প্রমাণ হলো হুট করে খন্দকার মোশতাকের সরকারকে সমর্থন জানানো। স্বাধীন বাংলাদেশে তার এমন রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা অতিবয়স্ক অবস্থায় মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে চাওয়ার আগ্রহের বাইরে অন্য কিছুতে ব্যখ্যা করা সম্ভব না।
তিনি সামরিক শাসন বিরোধী ছিলেন, তার সমর্থন চেয়ে জিয়াউর রহমান ইত্তেফাকের মালিক ব্যারিস্টার মইনুলকে পাঠিয়েছিলেন, ভাসানী প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে বললেন এই বাড়ীর উঠানে বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা আসন পেতে বসেছে, আর এই জেনারেলের এত সাহস সে নিজে না এসে আমার সমর্থন চায়? মইনুল হোসেন মাওলানাকে বললেন বাইরে টিভি রেডিওর লোকজন উপস্থিত আছে, আপনি কি তাদের সামনে কথা বলবেন না। মাওলানা গেঞ্জি লুঙ্গি বদলে গোসল সেরে জিয়াউর রহমানের সরকারকে তীব্র সমর্থন জানালেন। অগণতান্ত্রিক ভাবে ক্ষমতা দখল করা আইয়ুব খান এবং জিয়াউর রহমানের ব্যাপারে লাল মাওলানার আচরণ দুর্ভাগ্যজনক হলেও এরশাদের সময়ের জামায়াতে ইসলামীর আচরণের সমতূল।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ক্ষমতালিপ্সুতা এবং চরিত্রহীনতার অসংখ্য নজির তুলে আনা সম্ভব, তাদের পক্ষ পরিবর্তনের চাঞ্চল্যকর ইতিহাসও আছে, ১৯৭১ এর ৩১শে মার্চ বায়তুল মোকাররমে এসে ক্ষুব্ধ আইনজীবীদের নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হামলার বিরোধিতা করে কালো পোশাক পরে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন ঘোষণা করা শাহ আজিজুর রহমান আত্মীয়ের লাশ আর রক্ত মারিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সমর্থনে জাতিসংঘে বক্তৃতা করেছেন। একাত্তরের মার্চে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে ধনীদের বসতভিটায় আগুণ জ্বালিয়ে দেওয়া উচিত, এদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা উচিত , এদের বৌ বেটিদের দামী শাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া উচিত বক্তৃতা দেওয়া শাহ আজিজুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রি হয়ে ব্যক্তিমালিকানায় কল কারখানার পরিমাণ বৃদ্ধির সপক্ষে বক্তৃতা দিয়েছেন।
আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস স্থাপন করা উজবুক জনতারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হয়েছেন, প্রতারিত হওয়াটাই তাদের নিয়তি।
মধ্য রাতই এমন একটি চমৎকার লেখা সদ্ব্যহারের শ্রেষ্ঠ সময়
লেখা ভাল্লাগসে এবং পড়ে জানলাম অনেক কিছু রাসেল ভাই। ধন্যবাদ।
আবদুল হকের বইটা কিনছি কিন্তু ইকবাল আনসারীরটা কেনা হলো না সেইদিন কাল যেয়ে দেখি সন্ধ্যায় মেলাও শেষ!
রওনাক জাহানের বইটা পড়ছি কিন্তু তালুকদার মনিরুজ্জামানেরটা পড়া হয় নাই এখনো।
না লেখা ইতিহাস পড়ে নতুন কিছু জানলাম। দূর্দান্ত হইছে!
দূর্দান্ত লেখা, বইগুলো পড়ে ফেলতে পারলে আরো ভাল লাগতো
এই বাক্যটা কি উল্টা হইছে ?
নাহ বাক্য ঠিক আছে। জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতায় থাকার সময়ে তার কোনো আত্মীয় স্বজনকে ক্ষমতার আশেপাশে আসতে দেন নি, তাদের কথাও কেউ জানে না। আত্মীয় স্বজনদের দুর্নীতির দায় ব্যক্তিকে বহন করতে হয় শেখ মুজিবুর রহমানের পরিণতি দেখে তার এই উপলব্ধি হয়েছিলো ঠিকই।
খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বকালে অবশ্য চকলেট আপা, সাঈদ ইস্কান্দার, দুর্নীতিতে গর্বিত পুত্র তারেক রহমান এবং তার বন্ধু-বান্ধবদের কথা বিবেচনা করে বলা যায় জিয়াউর রহমান যথেষ্ট দুরদর্শী ছিলো।
বর্তমানের মহাজোট সরকারের স্বজনপ্রীতি এবং দুর্নীতির অনেক অভিযোগ আছে, যেহেতু শক্ত কোনো প্রমাণ নেই তাই এগুলোকে গুজব হিসেবে হিসেবের বাইরে রাখলাম।
ও । সেই অর্থে বলেছেন । বুঝলাম ।
শেখ মাজিবুর রহমান চাইলেই সকল রাজনৈতিক দল মতের উর্ধে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনায় পরামর্শকের ভূমিকা গ্রহন করতে পারতেন, কিন্তু ক্ষমতালিপ্সুতা সম্ভবত তাকে এমন অভিভাকত্বের দায়িত্ব নেওয়া থেকে বিরত রেখেছিলো। তিনি যে সংক্ষিপত দুই টার্মে মন্ত্রী হিসেবে যঠেষ্ট সফল ছিলেন এমনটা বলা যাবে না, কিন্তু এই প্রশাসনিক অযোগ্যতা স্বত্বেও তিনি বাংলাদেশের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করলেন যে দায়িত্ব পালনের মেধা, যোগ্যতা কিংবা দক্ষতা তার ছিলো না। নিজের আত্মজ্ঞান, কৌতুকবোধ, দরাজদিল ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিনি সকল সংকটের তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজেছেন কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের কথা ভাবেন নি।
কপি পেষ্ট করে কি বুঝালেন ভাই ? কিছুই বুঝলামনা । খোলাসা করুন প্লিজ !
শেখ মুজিবের মত এত বড় মাপের নেতা আমার জীবদ্দশায় আমাদের দেশে আমি হয়তো আর দেখে যেতে পারব না . কিন্তু তিনিও দুরদর্শী ছিলেন না . ক্ষমতার লোভের উর্ধে উঠতে পারেন নাই . লোভ করেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা হারিয়ে অকালে খুন হয়ে যান .
তারমানে আমাদের রক্তে কোন সমস্যা আছে. আমরা হয়তো স্বীকার করতে চাইব না কিন্তু এটাই সত্যি.আমরা ক্ষমতা পেলেই সব ভুলে যাই.
বইগুলি একটিও পড়িনি। দুর্দান্ত লিখেছেন। জানলাম অনেক কিছু। খুবভাল লাগল আপনার লেখা।
বিরোধীদলীয় রাজনীতিতে শেখ মুজিব হ্য়তো সর্বকালের সেরা, তেমনি রাষ্ট্র পরিচালনায় হ্য়তো সর্বকালের ব্যর্থ। এই দুইয়ের সবচেয়ে বেশি ধারাবাহিকতা হয়তো ম্যান্ডেলাই বজায় রাখতে পেরেছেন...
~
মন্তব্য করুন