অযথা
আনন্দিতা কথা বলতে শেখার পর যখন কাকের ডাক নকল করে ক্বা আ আ ক্বা আ আ বলতে শিখলো আমরা সবাই খুব খুশী ছিলাম। আনন্দের পোঁটলা কাকের ডাক ডাকলে, বেড়ালের ডাক ডাকলে সে প্রতিভা পরিচিতজনদের দেখানোর ভেতরে এক ধরণের নির্ভেজাল আনন্দ ছিলো। বাচ্চারা খুব দ্রুত বদলে যায়, আগ্রহ বদলায়, উৎসাহ বদলায়, কয়েকমাস আমাদের আবদার মিটিয়ে ক্বা আআআ ক্বা আআ ডেকে নতুন আগ্রহে শিখলো দ্যা ডগ সেইজ বাও বাও দ্যা কাউ সেজ মু মু, তারপর ইন্টারনেটের নার্সারি রাইমকে নিজের মত আধাবাংলায় স্মরণ করতে শিখলো।
বাসা ভর্তি শিক্ষক, সবাই কোনো না কোনো সময় স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি যায় ছাত্র পড়াতে আর ছাত্র পড়ানোর কৌশল শিখতে। যন্ত্রযুগে কম্পিউটারের নার্সারি রাইম আর এত এত উৎসাহী শিক্ষকের চাপে দ্বিতীয় জন্মদিনের আগেই বড় হাতের ইংরেজী বর্ণমালা চিনে ফেললো। প্রতিভা নয় বরং ছবির সাথে উচ্চারণ মেলাতে পারার দক্ষতা অর্জন করে ফেললো।
তার এইসব এডভেঞ্চারের কিছুটা আমার জানা, ইন্টারনেট থেকে নার্সারি রাইম নামানো, বাচ্চাদের শিক্ষনীয় ভিডিওগুলো ঋকের জন্যে নামানো আর ঋকের সাথে নিয়মিত দেখতে দেখতে গত ৬ বছরে এনিমেশন ছবি আর বাচ্চাদের শিক্ষনীয় ভিডিওর বড় একটা সংগ্রহ তৈরী হয়েছে। দুর্ঘটনায় কিছু হারিয়ে ফেললেও মোটামুটি মানের একটা সংগ্রহ জমানো আছে। ডিজনীর ম্যাজিক ইংলিশ, সিসেম স্ট্রীট, বার্নীজ ওয়ার্ল্ড আর হুপলাকিডজের ভিডিওর সাথে ঋকের অর্ধেক বাংলা অর্ধেক ইংরেজী মেশানো বাক্যালাপ। সেসব ছড়া গান আর ছায়াছবির বদৌলতে প্রায় সারাদিনই এক ধরণের ইংরেজী আবহে কেটেছে আনন্দিতার।
সময়ের সাথে ওর পছন্দ বদলায়, স্পিরিট স্ট্যালিয়ন অফ দ্যা সিরামন দেখে ওর ঘোড়া চরিত্র পছন্দ হয়েছে, ও নিজেকে বেবী হর্স ঘোষণা দেওয়ার পর আমাকে ড্যাডী হর্স, লিপিকে মাম্মি হর্স আর ঋককে ভাইসা হর্স হতে হয়েছে। আনন্দিতা কোলে বসে ঘোড়ার মতো নেইইইহহহহ করে আর আমাদের ওর নাকে নাক ঘষতে হয়।
পরোক্ষ পদ্ধতিতে ছবি আর শব্দকে এক করতে পারার দক্ষতা বেড়েছে এটা অবশ্য জানা ছিলো না। এক দিন বিকেলে আনন্দিতাকে নিয়ে এয়াস্তায় হাঁটার সময় ও বললো বাবা দেখো থ্রি- আমি আতিপাতি খুঁজে কোথাও থ্রি খুঁজে পেলাম না। বাবা বাবা ঐ যে দেখো থ্রি- আশে পাশে গাছ আর দেয়ালে সুলভ ইন্টারনেটের বিজ্ঞাপনে থ্রি খুঁজে না পেয়ে আনন্দিতার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম শব্দটা থ্রি না শব্দটা ট্রি, তবে উচ্চারণটা আমাদের দেশজ ট্রি নয় কিছুটা ট আর ঠ এর মাঝামাঝি উচ্চারণ। বার্নি কিংবা ডিজনী কোথা থেকে গ্রহন করেছে বলা কঠিন।
এই ধরণের ছোটোখাটো চমকে দেওয়া পরিস্থিতি বাদ দিলে সাম্প্রতিক সময়ে ওর কথা বলা এবং শব্দবাছাইয়ের দক্ষতা বেড়েছে অনেক বেশী। ও কথা বলা শিখেছে অনেক দিন তবে শব্দ গুছিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করে কথা বলা শুরু করেছে খুব বেশীদিন হয় নি। অবশ্য সেসব কথাবার্তার অধিকাংশই নানাবিধ অভিযোগ। আবদার, অনুযোগ অভিযোগের ফাঁকে ফাঁকে যা কিছু বলে সেটুকু বেশ মজার।
বাসার কেয়ার টেকার প্রায় নিয়মিত পানির মোটর ছেড়ে বন্ধ করতে ভুলে যায়, আমি ছাদে উঠলে কিংবা শব্দ পেলে নীচে গিয়ে মোটর বন্ধ করতে বলি, চাচা কিছুটা দৌড়ে গিয়ে মোটর বন্ধ করে। আনন্দিতাকে নিয়ে একদিন নীচে গিয়ে বললাম চাচা ম্যাশিন বন্ধ করেন ছাদে পানি পরতেছে। পরের দিন আনন্দিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলছে বাবা দাদা বলছে মেশিন বন্ধ করো, শুধু পানি পরছে আর পানি পরছে, সারাদিন আর সারাদিন।
জানালা ধরে উপরে উঠে টিউব লাইট ধরে ঝুলে যাওয়ার আগ্রহ কিংবা বিছানার রেলিংএ দাঁড়িয়ে লাফানো কিংবা সারা দিনের এই ধরনের নানাবিধ ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকান্ডে বিরক্ত চিন্তিত, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আম্মা একদিন সম্ভবত ওকে ভুতের ভয় দেখিয়েছে। বিকেল বেলা আমাকে দেখে সদ্য শেখা শব্দ ব্যবহার করে ফেললো। বললো বাবা জানালার ঐখানে ভুত আছে, তোমাকে কামড়ায় দিবে।
ভুতের ভয় দেখানোর বিষয়টা আমার পছন্দ না কিন্তু সেটা নিয়ে বাড়তি কিছু বলাও যাবে না। বললাম সমস্যা নাই, আমি ভুতকে মেরে আলু ভর্তা করে ফেলবো। আলু ভর্তা করে ওকে গাছের উপরে ঝুলায় রাখবো। ভুতের কল্পিত শাস্তি পছন্দ হওয়ায় পরের দিন আবার জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বললো বাবা বাবা তুমি ভুতকে মেরে কোথায় ঝুলায় রাখছো?
জানালার সামনের আম গাছ দেখিয়ে বললাম ঐ গাছের ডালে। তুমি কি ড্যাডি ভুত মারছো? আমি একটা বেবি ভুত মেরে গাছে ঝুলায় রাখছি। মাম্মি হর্স মাম্মি ভুত মারছে। পরের দিন জানালায় ঝুলার সময় আম্মা যখন বললো জানালায় ঝুলবে না, ভুত কামড় দিবে, ও পালটা জবাব দিলো দিদা হর্স বাবা হর্স ভুতকে মেরে গাছে ঝুলায় রাখছে। এখন প্রায় প্রতিদিন আমাকে একবার করে জানালায় দাঁড়িয়ে গাছের ডালে ঝুলে থাকা ড্যাডি ভুতকে দেখাতে হয়।
আনন্দিতা ওয়ান টু থ্রি ফোর ফাইভ ওয়ান্স আই কট এ ফিস এলাইভ সিক্স সেভেন এইট নাইন টেন দেন আই লেট ইট গো এগেইন- ওয়ান টু বাকল মাই শ্যু থ্রি -ফোর শাট দ্যা ডোর, ফাইভ সিক্স পিক আপ স্টিকস শিখে যাওয়ার পর ইন্টারনেটের কল্যানে আকৃতি আর রংএর নাম শিখে যাওয়ার বিষয়টাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে লিপির দুশ্চিন্তা মেয়েটা বাংলা শিখলো না। এ বি সি ডি আর কতদিন শিখবে। ওকে বাংলা শেখাতে হবে। স্বরে অ স্বরে আ শিখবে কবে? ওকে এক দুই শিখতে হবে না?
বাংলা ভাষার বর্ণমালা শেখানোর সিডি ডিভিডিগুলোর অধিকাংশের উচ্চারণে জড়তা আছে। ডলফিন কিংবা এই রকম একটি প্রকাশনীর ব্যাঞ্জন বর্ণের উচ্চারণে একটা শিশু বেশ জোর দিয়ে উচ্চারণ করে বোর্গেজ্জ্ব , ক্ষিয়, ড এ শুণ্য ড় ঢ এ শূণ্য ঢ় বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন। ব্যাঞ্জন বর্ণের বর্গ পঞ্চকে উপস্থিত 'জ' এবং বর্গ পঞ্চকের বাইরের 'য' এর উচ্চারণ কিছুটা আলাদা এবং যদি শিশুদের এই দুই শব্দের উচ্চারণের সমতাটা আলাদা করে চিহ্নিত করতে হয় তবে তাদের বর্ণ দুটোকে আলাদা করে রাখতে হবে। সে কারণে বর্গীয় "জ' আর অন্তঃস্থ " য" এর আগমণ। একে ভুল উচ্চারণ তার উপর অপছন্দনীয় এসোশিয়েশন, দুটো মিলে বাজারের সিডি কিনে ওকে বর্ণমালা শেখানোর ইচ্ছাটা ছিলো না।
ঋকের সময়ে প্রচুর সিডি ডীভিডি দেখা হয়েছে। এদের একটার ভেতরে আছে এ ঐ উ ঔ- ও এর উচ্চারণ কেউ উ করতে পারে আমার ধারণা ছিলো না, কিন্তু কিশোরগঞ্জের মানুষদের অবিরাম ওকারকে উকার উচ্চারণ করতে দেখেছি।
সিসিমপুরের বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ বাদ দিলে বাংলা ভাষায় বর্ণমালা বিষয়ে মোটামুটি নির্ভেজাল উচ্চারণের নমুনা পাওয়া যায় টোনাটুনিতে। টোনাটুনির ছড়া, কবিতা, গল্প গান কম্পিউটারে কপি করা আছে, সেসব দেখতে দেখতে আনন্দিতার বাংলা উচ্চারণের দক্ষতা বাড়ে নি তেমন কিন্তু খুকি ও কাঠবেড়ালী ছড়াটা পছন্দ হয়েছে। দুপুরে আমাকে ডেকে বললো বাবা আমাকে কাঠবিড়ালীর গল্প শুনাও- আমি শুরু করলাম একটা ছিলো ছোট্ট কাঠবিড়ালী, গাছের উপরে নাচতেছিলো, গাছের এই ডাল থেকে ঐ ডালে দৌড়াচ্ছে-
ওটা না পেয়ারার গল্প শুনাও-
আমিও খুব পেয়ারা খাই যে একটা আমাকে দাও
বাংলা ছড়া গান শোনার পর থেকে নতুন যন্ত্রনা হলো ছাদে গিয়ে বাঁদুর দেখে শুরু করছে আমাকে আদুর বাদুরের গানটা বলো- পায়রা দেখে শুধু করলো পায়রার গানটা বলো- আমি হেঁড়ে গলায় মধু এনে আদুর বাদুর চালতা বাদুর কলা বাদুরের বিয়ে টোপর মাথায় দিয়ে গাই। আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম গাই, চেষ্টা করি শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলতে। সব সময় সম্ভব হয় না। সিসিমপুরের দাঁত ব্রাশের গান ও দাঁত মাজিরে ও দাঁত মাজিরে ব্রাশে পেস্ট দিয়া ও দাঁত মাজিরে- আর ব্রাশ ব্রাশ ব্রাশ ব্রাশ ব্রাশ ব্রাশ ব্রাশ ব্রাশ ব্রাশ ব্রাশ ব্রাশ ব্রাশ ইয়োর টিথ এন্ড ইয়োর টিথ উইল বি হ্যাপী - কখন ইংরেজ মুডে আর কখন বাংলা মুডে থাকে বলা কঠিন। তাই বাবা দাঁত ব্রাশের গান শুনাও আব্দারের সাথে এক ধরনের দ্বিত্বতা থাকে- তাৎক্ষণিক উচ্চারণের পরপরই বুঝা যায় আসলে গানটা বাংলা না কি ইংরেজী হবে। নিজের মর্জি মতো কিছু না হলেই বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের হবে বাবা আমাকে দাঁত ব্রাশের গান শুনাচ্ছে না।
টোনাটুনির কল্যানে ওর সাথে কথা বলাটা ইদানিং অনেক মজাদার অভিজ্ঞতা হয়ে উঠেছে। বাবা বাবা দেখো আম গাছ- আমটি আমি পেড়ে খাবো। আমি নিজের মতো গল্প বানানোর চেষ্টা করি- ও মনোযোগ দিয়ে শোনা চেষ্টা করে আর গল্পের মাঝখানে প্রশ্ন করে- আজকে দুপুরে শুয়ে শুয়ে ওকে গল্প শুনাচ্ছিলাম সুবুজ ভুত আর টুনটুনি পাখীর গল্প।
একটা সবুজ ভুত টুনটুনি পাখীর ঘরে ঢুকে ঘুমায় পরছে। টুনটুনি এসে দেখে সবুজ ভুত ওর বিছানায় ঘুমাচ্ছে-
বাবা টুনটুনি পাখীর বাসা কোথায়?
সামনের গাছে , যাও বারান্দায় গিয়ে দেখো।
বাবা বাবা মা টুনটুনি কোথায় গেছে?
মা টুনটুনি স্কুলে গেছে, একটু পরে আসবে, তুমি ঘুমাওতোমার চোখের ভিতরে ঘুম দৌড়াচ্ছে।
বাবা বাবা বেবীভুতটাকে কোথায় ঝুলায় রাখছো?
বেবী ভুত এখন টুনটুনির খাটে ঘুমাচ্ছে। বেবী ভুত টুনটুনিকে বলতেছে আমার চোখে অনেক ঘুম, আমাকে ঘুমাতে দাও
বাবা উঠো বাবা , চোখ খুলো।
তোমাকে আমি খেয়ে ফেলবো
না আমাকে খাও না তুমি। চোখ খুল
বাবা তুমি কোথায় যাও?
বন্ধুর সাথে দেখা করতে
কোন বুন্ধু?
কৌশিক আংকেল, তুমি দেখছো না?
কোনটা কৌশিক আঙ্কেল, গ্রীন ড্রেস পরা
হুমম ঐটাই
কোথায় যাবা? সামনের পাশে
হুমম, এখন যাই
কৌশিকের সাথে প্রায় নিয়মিত অনিয়মিত যোগাযোগের কল্যানে এক ধরণের পারিবারিক বন্ধুত্ব তৈরী হওয়া কিংবা নিয়মিত সাক্ষাতের জন্যে কৌশিক আনন্দিতার পরিচিত মুখ। বাবা তোমাকে কৌশিক আঙ্কেল বানায় দি - বলে আমার মুখ টেনে, গাল টেনে একটা ভরাট বড় ভাব আনার প্রচেষ্টা, তারপর বলা কৌশিক আঙ্কেল কথা বলো।
আদুরে একটা পোস্ট। বাচ্চাদের নিয়ে রাসেল ভাইয়ের লেখা এত্ত ভালো লাগে!!! এত্ত সুইট!!!
ইশ! এত্ত সুইট করে কেমনে লেখে মানুষ!
পুরা লেখা ভর্তি এত্ত এত্ত আদর, চমত্কার।
সবার ভালো হোক।
খুব সুন্দর একটা লেখা।
কিউট পোষ্ট!
এক কথায়, মিষটি
মন্তব্য করুন