জীবনযাপন
বিশ্রী একটা সময় যাচ্ছে। নিশ্চিত বুঝতে পারছি সামনে এমন কয়েকটা সিদ্ধান্তে সমর্থন দিতে হবে যা পরবর্তী সম্পূর্ণ সময়েই অনুশোচনার কারণ হবে কিন্তু সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেসব বাক্য ব্যবহার করতে হবে সেসব বাক্য ব্যবহারে এক ধরণের অনীহা আছে নিজের ভেতরে। ভালো সিদ্ধান্ত এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে এক ধরণের বৈরিতা আছে, ভালো লাগার সিদ্ধান্তগুলো অনেক সময়ই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত হয় না আর পরিস্থিতি বিবেচনা করে নেওয়া সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তগুলোতে হৃদয়ের সমর্থন থাকে না।
বিশ্বকাপের কল্যানে রাত জেগে খেলা দেখার পর যখন পৌঁছালাম ঋকেরবর্ষসমাপনি উৎসবে মনে হয়েছিলো সবগুলো প্রয়োজনীয় বিষয়ই দেখা হবে না, কিন্তুয়ামাদের সুভাষণপ্রীতি সেটুকু আশংকা দূর করে দিয়েছে।
ঋকের গ্রাজুয়েশন শেষ হলো, সমাপনী অনুষ্ঠানে বাংলা ইংরেজী সব সমবেত গানেই কণ্ঠ দিয়েছে ঋক, ভুল উচ্চারণ, কয়েকটা জায়গা তাল আর সুর ভুল করার মত ত্রুটিগুলো বাদ দিলে উপস্থিত শ পাঁচেক মানুষের সামনে কোনো ভয় না পেয়ে গান গাওয়ার সাহস অর্জনের জন্যেই ভালো লেগেছে।
চেষ্টা করলে আরও ভালো ফলাফল করতে পারতো, ও তো আসলে ক্লাশে প্লেস করার মতো ছেলে কিন্তু ভীষণ অমনোযোগী বাক্যগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ না আমার কাছে। ফলাফলের চেয়ে বড় অর্জন আসলে এই ধরণের উৎসবে সরাসরি অংশগ্রহন করতে পারা।
যেকোনো বিষয়কে প্রতিযোগিতামূলক করে তোলাতে পারঙ্গম আমরা। আমার ছেলে৮মাস বয়েসে মা ডেকেছে আর আমার ছেলে ১০ মাস বয়েসে হেঁটেছে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত মানুষদের সাথে আমাদের বসবাস। ছেলে ১০ মাসের বদলে ১৫ মাসে হাঁটতে শিখলে কিছুটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে নিশ্চিত কিন্তু যে ছেলে ১০ মাসে হাঁটতে শিখেছে সে যে হেঁটে হেঁটে বাকী ৫ মাসে ইউরোপে চলে যাবে না এটুকু নিশ্চিত জেনেও কেনো এই ধরণের অযথা কথা চালাচালি করে লোকজন আমি অনেক সময়ই বুঝি না।
হিন্দি চ্যানেল আর বাংলা চ্যানেলের ট্যালেন্ট হান্টের ফাজলামি দেখলে বিরক্ত লাগে অনেক সময়, ৭ বছরের বাচ্চা বড়দের প্রেমের গানে কোমর দুলিয়ে নাচছে, আর বুড়ো ভাম বিচারক চমৎকার নেচেছো, কি শক্তি, কি আত্মনিবেদন জাতীয় বাক্য বলছে দেখলে যতটা না বিরক্ত লাগে তার চেয়ে বেশী বিরক্ত লাগে এইসব বাচ্চাদের অভিভাবকদের দেখলে। টিভিতে মুখ দেখানোর আনন্দ আর সার্টিফিকেটের মোহে বাচ্চাদের শেখার আনন্দকে বাজারভিত্তিক সংস্কৃতিতে বিক্রী করছে।
কয়েক দিন আগে কোনো একটা ওয়েব সাইট থেকে মোটা একটা মেয়ের অন্তর্বাস পরা ছবি মুছে দিয়েছিলো। বিজ্ঞাপনের মডেলদের মতো মাপমতো শরীর সবার নেই, তার উপরে আমাদের সৌন্দর্যের ধারণাটা গত ১০০ বছরে অনেকটা বদলেছে, আবার একই সাথে অন্তর্জাল ভিত্তিক সহজ এক্টিভিজমে একাত্মতা প্রকাশের জোর তাগিদও মানুষের ভেতরে আছে।
সেই মেয়ে কয়েকটা সাক্ষাৎকার দিয়ে, গান গেয়ে বিশাল একটা প্রতিবাদী জলসার আয়োজন করেছিলো, সেই আয়োজনের সমর্থনে চিকনমোটাছেলেবুড়োখুকীখালাম্মা সবাই নিজেদের ন্যাংটা পাছার ছবি তুলে শেয়ার করছে। প্রতিবাদটা প্রয়োজনীয়, শাররীক ত্রুটির কারণে যদি কেউ নিজের ওয়েব সাইট থেকে কোনো ছবি মুছে দেয় অশ্লীলতার অভিযোগে সেটা নিন্দনীয় কিন্তু এত আয়োজন করে পাছার ছবি বিপননের কোনো অর্থ খুঁজে পেলাম না।
সেটাও বাজার সংস্কৃতিতে নিজের অংশগ্রহন বৃদ্ধি করা।গতকাল লিপির জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঋক বাসা সাজিয়েছিলো। মায়ের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ও একটা গান করবে, স্কুলের অনুষ্ঠানে গেয়েছিলো গানটা। মা-বাবা তোমরা অনেক ভালোবাসো আমাদের, আমাদের জন্যে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছো ধাঁচের গানের কথা।
ও নিজের আনন্দে স্কুলের গ্রাজুয়েশন সেরিমনির আদলে একটা অনুষ্ঠান করতে চাইলো, তবে আমাদের বিদগ্ধ জনসমাজ, যারা নিয়মিত টেলিভিশনে বাচ্চাদের কোমর দুলানো আর চিকন গলার গান শুনে মুগ্ধ তারা বিষয়টাকে অন্য আরেকটা টেলিভিশন প্রোগ্রামের আদলেই গ্রহন করলো। এখানে সুর ভুল হলো কেনো, এখানে বাক্যটা এমন হবে না, এটা ঠিক করে করো- যাকে উপলক্ষ্য করে এই আয়োজন সেও উপস্থাপনার ভেতরে যে ভালোবাসা সেটাকে অগ্রাহ্য করে মার্কসীট হাতে নিয়ে পয়েন্ট গুনতে ব্যস্ত।
এটা তো ঠিক হলো না, এটা আরও ভালো করতে পারতে তুমি। ঋকের লাফালাফিতে ঋতও তার ক্ষুদে প্রতিভার ঝলক দেখানো শুরু করলো।তার তূণে তেমন লক্ষ্যভেদী বাণ নেই। কম্পিউটারে শোনা নার্সারী রাইম আর বিভিন্ন সময় শোনা বাংলা ছড়া নিজের মতো বলে, মাঝপথে ভুলে যায়, কিন্তু এই বিষয়টার ভেতরে এক ধরণের আনন্দ অনুভব করে।
অহেতুক মার্কসীট হাতে নিয়ে বসে বসে তুমি ১০ তুমি ৯ তুমি সাড়ে পাঁচ নম্বর দেওয়া মানুষগুলো যেভাবে পারফেকশনিস্ট আচরণ করে সেটার সাথে মানিয়ে নেওয়া কঠিন। ও যদি একটা অর্ধেক ছড়া বলে, যদি ১০টা অফনোটসমেত একটা গান গায় সেখানে পৃথিবী উলটে যাওয়ার কিছু নেই।
এমনিতে পৃথিবী সংকীর্ণ হতে হতে নিরাপত্তাহীন শহরে ড্রইং রুমের চার দেয়ালে শৈশবকে বন্দী করতে পেরেছি আমরা। এখন বাণিজ্যিক প্রয়োজনে তৈরী হওয়া অনুষ্ঠানগুলোর কল্যানে যেটুকু ব্যক্তিগত আনন্দ উল্লাস ছিলো সেটাকেও অন্য সবার পাল্লায় মাপছি। আমার পরিবারের সবাই যে ভীমসেন যোশীর পরিবারের সদস্য তাও না। এদের প্রত্যেকে যখন গান গায় সেটার ভেতরে অফনোট থাকার চেয়ে বেশী থাকবে ভুল স্কেলে গান গেয়ে যাওয়ার ব্যাধী।কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া, কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া এরা আবার বিজ্ঞ বিচারক হয়ে যায়।
আমার মনে হয় না স্কুল থেকে নিয়মানুবর্তীতা এবং বন্ধু তৈরীর কৌশলের বাইরে বাড়তি কিছু শৈশবে শেখা সম্ভব। আমাদের স্কুলের মান, আমাদের শিক্ষকদের মান এতটা উন্নত না। সেটুকু সময় স্কুলে কাটাবে একটু খোলা পরিসরেদৌড় ঝাঁপ করে কাটাক, ওকে তো পরের বছরই স্পেশ্যাল থিওরী ওফ রিলেটিভিটি আর জেনেরেল থিওরী ওফ রিলেটিভিটির পেপার লিখতে হবে না। ও প্রতিযোগিতা করে হাইজেনবার্গ হবে না, শোয়ার্সচাইল্ডের মতো সৈনিক গণিতবিদ হবে না। আমাদের দেশের শিক্ষা পরিস্থিতিতে আমাদের তীব্র চাপে বড়জোর গোল্ডেন জিপিএ পাবে আর যদি আমরা বাড়তি চাপাচাপি করে তাহলে শিক্ষার প্রতি যে অনুরাগ এখন ওর আছে সেটা বিরাগে পরিণত হবে। যে বিষয়ে শেখার আগ্রহ জানার আগ্রহ সেটার বদলে পরীক্ষার পড়া পড়ে জীবনে খুব বেশী অর্জন করা সম্ভব হয় না কখনও।
পুরা লেখাটাই চমত্কার,
ভাবানোর মত কথাগুলো ভালো লাগলো অনেক।
এখনতো আমরা বাচ্চাদের মাপি কে কত বেশী মুখস্ত রাখতে পারলো সেই হিসাবে ...
দু:খ থেকে লিখেছেন তারপরও কয়েক জায়গায় হেসে ফেললাম
কাউকে বোঝানো যায় না, কিছু বলার নেই।
মন্তব্য করুন