ইউজার লগইন

বেড়ে ওঠা

ঋক আর্ট এক্সিবিশনের জন্যে শহরের ছবি এঁকেছে, ব্যাস্ত রাস্তা, কয়েকটা গাড়ী, কিছু মানুষ হাঁটছে আর শহরে মাত্র ৩টা বাড়ী।বাড়ীর সামনে পরিচয় লেখা- একটা কিডজ এন্ড মম, একটা সিপি আর একটা এটিএম বুথ। যে ঢাকা শহরে আমরা থাকি সে শহরে বাড়ীর আড়ালে দিগন্ত লুকানো। এত এত বাড়ীর কংকাল দিন-রাত ঘাড়ে চেপে বসে আছে অথচ তার কল্পনার শহরে গুরুত্বপূর্ণ তিনটা স্থাপনা-
সে শহরে অন্য সব স্থাপনা তার জন্যে গুরুত্বহীন।

পিতৃত্বের নয় বছর পর নিজের সাথে ঋকের সময়ের তুলনা করে কিছুটা অবাক হচ্ছি- যে বয়েসে আমি অন্য সব ছেলের সাথে শহরের রাস্তায় অবলীলায় হাঁটতে পারতাম- অন্তত চেনা চৌহদ্দির ভেতরে যতটুকু দুরত্ব পায়ে হেঁটে চলে যেতে পারতাম, হারিয়ে যাওয়ার আশংকা নিয়েও যতদুর যেতে পারতাম কিংবা যেভাবে দেয়াল বেয়ে ছাদে আর ছাদের কিনার ঘেঁষে গাছের ডালে উঠে যেতে পারতাম- ঋক তার কিছুই পারে না। কয়েকটা বাসা পরেই ওর বন্ধুর বাসা- সেখানে তার একা যাওয়ার অনুমতি নেই। গলির ভেতরে অযথা গতির প্রতিযোগিতায় নামা যন্ত্রশকটের সামনে ওকে একা যাওয়ার অনুমতি দেওয়া কঠিন। এই শহরে নিয়ম মেনে কিছুই চলে না। গাড়ী আর মোটর সাইকেল নিয়ম ভেঙে একে অন্যকে ডিঙিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা করে, ফুটপাতে উঠে যায় বেয়ারা মোটর সাইকেল আরোহী এবং ফুটপাতে হেঁটে যাওয়া মানুষের দিকে কঠোর চোখে তাকায় যেনো ফুটপাত তাদের হাইওয়ে আমরা পথচারী অযথা হাইওয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তায় ওয়াক সাইন দেখলে হাঁটবে শিখিয়ে লাভ নেই- এখানে পথ পেরুতে গেলে মোটর সাইকেলে চাপা না পরে রাস্তা পারি দেওয়ার সুযোগ সামান্য।

প্রতিবার ভাবি সময় হয়েছে-এখন ওকে নিজের মতো অন্তত রাস্তায় হাঁটতে শেখানো দরকার। তবে রাষ্ট্র বদল করে কিছুটা নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রে না যাওয়া পর্যন্ত সেটা সম্ভব হবে না। অমঙ্গল আশংকা সব সময়ই থাকে, দুর্ঘটনার সম্ভবনা সব সময়ই থাকে- সেটুকু ঝুঁকি মেনে নেওয়া যায় কিন্তু এই অসভ্য শহরে নিয়মহীনতাই নিয়ম।

বিজয় দিবসের আগে আগে স্কুলে পরীক্ষার রেজাল্ট দিতো- সেই রেজাল্টের সপ্তাহে কিছুই ভালো লাগতো না। ভুলে যাওয়ার শত চেষ্টায়ও মনে থাকতো আগামী রবি বার সকালে স্কুলে যেতে হবে। তারপর শেষের সেই দিন ঘুম থেকে উঠে ভাবা -অবশেষে এলো শেষের সেই ভয়ংকর দিন, আজ পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে, যারা বছরের প্রথম দিন থেকে বইয়ের পাতার গন্ধ নিয়ে, কবিতার প্রথম ১২ লাইন মুখস্ত করে দাঁড়ি কমা সহ লিখতে শিখেছে, যারা ভাগ আর ভগ্নাংশের পুলসিরাত পার হয়েছে তারা হয়তো কোনো ভাবে উতড়ে যাবে কিন্তু যারা ব্যাকবেঞ্চার, স্যারের লাঠির বাড়ি আর কানমলা যাদের নিত্যবরাদ্দ ছিলো তারা উদ্বিগ্ন, কোনোমতে সাড়ে ৩৩ হলেই খুশী, আপাতত এইটুকু ডিঙিয়ে নেই আগামী বছর নিশ্চিত বছরের প্রথম দিন থেকেই- আর সেই প্রথম দিনটা কখনও আসতো না।

বাংলায় ৫০, ইংরেজীতে ৪৮ অংকে কোনোমতে ৭০ এই রেজাল্ট কার্ড বাসায় নিয়ে আসলেও পিঠের উপর দিয়ে তেমন ধকল যাইতো না- অন্তত অংকে তো ফার্স্ট ডিভিশন আছে। আমার সারা জীবনের লক্ষ্য ছিলো কোনোমতে ৬ এর ঘর ডিঙিয়ে যাওয়া, প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হওয়ার লড়াই না, মানসম্মান নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশন মার্ক রেখে পাশ দিয়ে যাওয়া। ফার্স্ট ডিভিশনের লড়াইটা কানকোর পাশ দিয়ে যেতো, হাজারে ৫৬০ আর হাজারে ৫৩০ এর আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে জীবন বরবাদ

যুগের ফের,আমাদের ফার্স্ট ডিভিশন এখন এ গ্রেড আর স্কুলের নিয়ম ভেদে সেটা ৯০ থেকে ৮০% এর ভেতরে উঠা নামা করে। ঋকের উপরে বাড়তি কোনো প্রত্যাশার বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার আগেই ও লেটার মার্কের চিপায় আটকে পরলো। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এখন আমি জানি পড়া শোনা বিষয়টা বইয়ে নাক গুঁজে পরে থাকা নয় বরং পঠিত বিষয়ের উপস্থাপনের উপরে নির্ভর করে। সিলেবাসের পরিধির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কে কিভাবে পড়াচ্ছে। হাইস্কুলের বুড়ো স্যারগুলো যারা তাদের ২৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনে পড়ানোর কৌশলটা রপ্ত করতে পারে নি, খিটমিটে বাংলা আর হেড মাওলানা স্যার যাদের হাতের সরষে তেলে মসৃন লাঠি তারা কেউই আসলে ভেতরে পড়ার আগ্রহ তৈরী করতে পারে নি আমাদের।

স্কুলের বইয়ের সাথে সহপাঠের গল্প ছড়া কবিতাগুলো আলাদা করে সময় নিয়ে পড়েছি কিন্তু কখনও ক্রিটিক্যাল এনালাইসিস করা হয় নি, কেউ শেখায় নি হাতে ধরে কিভাবে গল্প পড়তে হবে। বাংলা ব্যাকরণ আর ইংলিশ গ্রামারের বিভিন্ন বিধি বিধান মুখস্ত করে শুদ্ধ ভাষা চর্চার আগ্রহ তৈরী হয় নি। যুগের প্রেক্ষিতে বলা যায় আমরা ছিলাম মোটামুটি খারাপ একটা স্কুলের বখে যাওয়া ছাত্র যাদের জীবনের লক্ষ্য ছিলো ১০০তে সাড়ে ৩৩

ঋকের পড়ানোর সবটুকু ঝক্কি লিপির ঘাড়ে, ঋক আমার কাছে পড়তে বসলে আহ্লাদী করে, আমি ঢিলা মাস্টার কিংবা অল্পতে রেগে যাই , পঠিত বিষয় উপভোগ করাটা আমার কাছে পরীক্ষার নম্বরের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ আর এই দৃষ্টিভঙ্গিটা ওকে পরীক্ষায় পিছিয়ে দিতে পারে শঙ্কাটা লিপির আছে। হ্যাপি ওয়াইফ হ্যাপি লাইফ সুতরাং এইসব ঝঞ্ঝাটের বাইরে চলে যাওয়া ভালো।ঋক ক্লাশ টেস্টে ১৮ থেকে ২০ পেলে ওর ক্লাশ টেস্টের খাতা দেখায়, ক্লাশ টেস্টের মার্ক ১৫ থেকে ১৮ হলে খাতা হাপিশ করে ফেলে- আর প্রতি সপ্তাহে এত এত পরীক্ষার ঘনঘটা মনেও থাকে না পরীক্ষার খাতা খুঁজে দেখি। বাংলা আর ভুগোলের অবস্থা এত খারাপ বুঝা গেলো পরীক্ষার কয়েক সপ্তাহ আগে। ওর ভুগোল বই নেই আর ও কিছুটা উদ্বিগ্ন। পরিচিত একজন প্রশ্ন করলো ঋক পড়াশোনা নিয়ে কি বুঝতেছো পরের ক্লাশে উঠতে পারবে

সবই ঠিক আছে কিন্তু পরের ক্লাশে উঠতে পারবো কি না বুঝতেছি না- ওর উত্তরটা আরও স্পষ্ট হলো ক্লাশ টিচারের সাথে দেখা করার পর- চেহারা দেখা মাত্রই অতিরিক্ত উৎসাহী হয়ে বললো আমার অনেক অভিযোগ আছে, আমি আগে বলবো।
আমি শুরু করেছিলাম- শুনলাম ওর না কি ক্লাশ টেস্টের মার্ক খুব খারাপ- তারপর থেমে গেলাম -বললাম ঠিক আছে বলেন
ও ক্লাশে এটেনটিভ না, সারাক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকে , এমনিতে দুষ্টামি করে না কিন্তু অমনোযোগী। আমি অপেক্ষায় থাকলাম কিছুক্ষণ- অনেক অনেক অভিযোগের পরবর্তী অংশ কি? ক্লাশে অমনোযোগী আর পরীক্ষায় বাজের নম্বর পাওয়ার বিষয়টা এত বেশী স্পষ্ট সেটা নিয়ে অবশ্য আমার উদ্বেগ নেই,

শেষের সেই ভয়ংকর দিন আজকে রিপোর্ট কার্ড দেওয়ার দিন ছিলো, আমি রেজাল্ট নিয়ে বের হলাম, ও জিজ্ঞাসা করলো বাবা রেজাল্ট দেখছো?
এখনও দেখি নাই
দেখো না, আমি কি পাশ করছি?
তুমি দেখো
ও রেজাল্ট খুলে প্রথম দেখলো প্রমেটেড টু ক্লাশ থ্রি আর সাথে বইয়ের তালিকা, সে আনন্দ নিয়েই বাসায় ফেরত আসলো।

আমি অবশ্য গ্রাজুয়েশন উপলক্ষ্যে করা অনুষ্ঠান উপভোগ করেছি। ও গ্রাজুয়েশন সং, রবীন্দ সংগীত, বাবা মায়ের উদ্দেশ্যে গাওয়া গান সবগুলোতেই মাইক হাতে ছিলো। মেনে নিচ্ছি অন্তত ১০টা নোট মিস করেছে, কয়েও জায়গায় তাল কেটেছে, রবীন্দ্র সংগীতের উচ্চারণে ভুল ছিলো কিন্তু ওর স্টেজ ভীতি নেই। কয়েক শত মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে নিয়ে গান গাওয়ার সাহস আমার এখনও নাই, ক্লাশের ৩০ জনের সামনে কথা বলা আর স্টেজে অসংখ্য মানুষের সামনে গান গাওয়ার বিষয়টায় আকাশ পাতাল তফাত।

পড়া শোনার চেয়েও এখন মনে হয় এইসব এক্সট্রা কারিক্যুলাম একটিভিটি বেশী প্রয়োজনীয়, মানুষের মানসিক বিকাশের জন্যে বস্তা বস্তা বই গেলা তেম্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না, ও যদি এই রকম বিভিন্ন আর্ট ক্রাফটম্যানশীপের সাথে জড়িয়ে থাকে একটা সময় শিল্পের সাথে পড়াশোনার সম্পর্কটা নিজেই উপলব্ধি করবে। আমি ওর এ আর এ প্লাসের চেয়ে বেশী উদ্বিগ্ন ও এখনও কোনো খেলা শিখলো না। আমি এই সময়টাতে ব্যাডমিন্টন, ফুটবল আর ক্রিকেট খেলা শিখেছি, কানামাছি হাডুডু বৈচি আর গোল্লাছুট খেলে বিকেল কাটিয়েছি, ও কম্পিউটারে জ্যাক এন্ড দ্যা নেভারল্যান্ড পাইরেটস খেলে বড় হচ্ছে।
বাইরে মাঠ নেই, আশে পাশের বাসায় কোনো বন্ধু নেই, প্রতিযোগিতা যা কিছু সবই ঋতের সাথে। অসমবয়সী লড়াইটা দীর্ঘ সময় উপভোগ্য না। ঋকের সার্বক্ষণিক দুশ্চিন্তা সম্ভবত ঋত বেশী মনোযোগ পাচ্ছে। মনোযোগ পাওয়ার এই প্রতিযোগিতায় ঋক যা করে সেটা ঋতের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। এই ভাবনার কেন্দ্রে না থাকার দুশ্চিন্তা ভেবেছিলাম সময়ের সাথে কেটে যাবে কিন্তু তেমনটা ঘটছে না। বড় হয়ে গেছে ধরে নিয়ে ভাবছি ও বুঝতে শিখবে ঋত ওর ছোটো বোন, ওর সাথে প্রতিযোগিতা করার সময় ওকে কিছু বাড়তি সুবিধা দিতে হবে- সেসব বাড়তি সুবিধা কিংবা ছাড় দেওয়ার কোনো আগ্রহ ঋকের নেই।

সবচেয়ে বড় সংকট- ঋতের চেয়ে বেশী মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টাটা যে একটা লোভের চক্কর এটা ও বুঝে আর তারপরও এই লোভ দমনের লড়াইয়ে ব্যর্থ হলে ও নিজের মতো কারণ তৈরীর চেষ্টা করে- সেই কারণগুলো খুব হাস্যকর- বিব্রতকর-করুণ এবং বিরক্তিকর হতে পারে সময় সময়।

পোস্টটি ১৪ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

আরাফাত শান্ত's picture


অবজারবেশনগুলো বেশ লাগলো!

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


ভালো লিখছেন। এরকম চিন্তাভাবনা সব বাবা মায়েদের থাকলে পিচ্চিগুলার শৈশবটা অনেক সুন্দর হতো।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.