বিক্ষিপ্ত ভাবনা
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কৌতুহল আর ভয়- আমাদের বর্তমান সভ্যতার প্রধানতম চালিকাশক্তি মানুষের এই দুটো অনুভুতি তবে এই দুটো অনুভুতির ভেতরে ভয়ের অনুভুতিটাই প্রবল। আমাদের ভাবনার জগতটা সম্পূর্ণ ভয় নিয়ন্ত্রন করে। কখনও কখনও ভয়টা ভীতির পর্যায় পার হয়ে আতংকে পরিণত হয়, কখনও ভয়টা আমাদের কৌতুহল নিবৃত করে।
আমাদের দৃশ্যমাণ, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পৃথিবীর বাইরের সবটুকুই আমাদের ভীতির জগত। অন্ধকার- অপরিচিত ভূখন্ড কিংবা অজানা গন্তব্য- সবই আমাদের ভেতরে এক ধরণের সংকেত- এক ধরণের সাবধানবার্তা তৈরী করে। যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকে মানুষ আগুণকে ভক্তি শ্রদ্ধা করতে শিখেছে, প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি এবং এত শত মারণাস্ত্র নির্মাণের পর সেই নিরাপত্তাহীনতার বোধ আরও তীব্র হয়েছে। যন্ত্রের যান্ত্রিক দক্ষতা, যন্ত্রগণকের সমস্যা সমাধানের অভাবনীয় গতি সবই এখন মানুষের ভয়ের কারণ।
দীর্ঘ বিবর্তনের পথ পাড়ি দিয়ে মানুষ এখন প্রকৃতিকে যতভাবে ধ্বংস করেছে, স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে যতটুকু আক্রান্ত করেছে- সাধারণ মানুষেরা সে বিষয়ে উদাসীন নির্লিপ্ত থাকলেও যারা মূলত ভাবনা নির্মাণ করে এই মানুষগুলো এক ধরণের ভয়ের জগতে বসবাস করে। আরও ভালো জীবনযাপনের জন্যে, জীব জগতকে আরও ভালোভাবে জানার জন্যে তারা যত ধরণের গবেষণা করছে- তার ভেতরে এক ধরণের নির্লিপ্ত ক্রুরতা- নিষ্ঠুরতা আছে। প্রকৃতি এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় নিজের মতো করেই। যে বিবর্তনের পথে মানুষ আজ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে, যেই বিবর্তন যখন জীবাণুদের আরও বলিষ্ঠ করছে- মানুষ বিভ্রান্ত- উচ্চমাত্রার এন্টিবায়োটিকের যুগ শেষে ভবিষ্যতের মানুষ এমন একটা অভাবনীয় জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে যেখানে এন্টিবায়োটিক রোগ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হবে। এই ধরণের উদ্ভাবনজনিত কিংবা অপব্যবহারজনিত ভীতির বাইরে আরও অনেক ধরণের ভীতির উপস্থিতি দেখা যায় সৃষ্টিশীল কাজের ভেতরে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভীতি, ভিন গ্রহের প্রাণীর প্রতি ভীতি পশ্চিমা সাহিত্যে আর হলিউডের সিনেমায় যেভাবে উঠে এসেছে অন্য কোথাও ভীতিটা ততটা প্রকট ভাবে উপলব্ধি করা যায় না। ট্রান্সডেন্সেস নামের নতুন একটা সিনেমা এসেছে হলিউডে- এটা টার্মিনেটরের আধুনিক উপস্থাপন তবে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। যেভাবে সভ্যতা ,যন্ত্র একে অন্যের সাথে জুড়ে যাচ্ছে- যেভাবে আমাদের জীবন আর রাষ্ট্রের সেবাগুলো ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে সেটা এক ধরণের ভীতির কারণ বটে কিন্তু বিশ্বজুড়ে এই কোটি কোটি গিগা বাইটের যে বিশাল স্টোরেজ সিস্টেম আমরা তৈরী করেছি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুপার কম্পিউটার তার কাছে সামান্য- এই বিপূল স্টোরেজ সিস্টেম, এই বিপূল ক্ষমতা যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোনো আত্মসচেতন সত্ত্বা ব্যবহার করতে চায় সে কি করবে এই প্রশ্নটা এক ধরণের আতংক তৈরী করছে সবার ভেতরেই।
বুদ্ধিমত্তা নিজেকে ছড়িয়ে দিতে চায়, আধিপত্য বিস্তার করতে চায়, নিজের তুলনায় দুর্বল যেকোনো কিছুকে নিয়ন্ত্রন করতে চায় এবং যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে তাকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়। যন্ত্রের ভেতরে মানবিক অনুভুতি তৈরী হলে, কিংবা আত্মসচেতনতা তৈরী হলে যন্ত্র এক ধরণের প্রতিশোধ নিবে- সে প্রতিশোধ সভ্যতাকে হুমকির মুখোমুখি করতে পারে-
টার্মিনেটর শুরু হয়েছিলো এমন একটি ভাবনা থেকেই- ট্রান্সসেন্ডেন্স সেখানে আত্মসচেতনতাকে এক ধরণের জৈবিক অনুভুতি হিসেবে চিহ্নিত করেছে এবং স্বাভাবিক যৌক্তিক প্রক্রিয়ার বাইরে এটিকে স্মৃতিনির্ভর একটি প্রপঞ্চ হিসেবে উপস্থাপন করেছে- ম্যাট্রক্সে যেভাবে যন্ত্র মানুষের সম্মিলন দেখানো হয়েছে-- যেভাবে তারও আগে সাইবর্গের ধারণা এসেছে , সব কিছুর ভেতরেই আসলে যন্ত্রের আত্মসচেতনতার আশংকাটা নানা ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ উপলব্ধি করেছে তার সহিংসতার কিছুটাও যদি যন্ত্র ধারণ করে তবে যন্ত্র প্রতিশোধকাতর হয়ে উঠবে। যখন পৃথিবীতে এমন আশংকা তৈরী হবে একদল মানুষ এর প্রতিরোধ করবে- টার্মিনেটর কিংবা ট্রান্সসেন্ডেন্সেও একই ধরণের প্রতিরোধ তৈরী হয় এবং মানুষকে সান্তনা দেওয়ার জন্যে হলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবীয় আবেগ আর মানুষের কষ্টসহিষ্ণুতা এবং অদম্য লড়াকু মানসিকতার কাছে পরাজিত হয়।
মানুষ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যতটা না ভয় পায় তার চেয়ে হাজারগুণ বেশী ভয় পায় ভিনগ্রহের প্রাণীদের। তাদের প্রতি ভয়-ভীতি বিতৃষ্ণা এতই বেশী যে আমি যতগুলো এমন ছবি দেখেছি তার কোনোটাতেই কোনো ভিন গ্রহের প্রাণীদের মানুষের মতো দেখতে পাই নি- অবশ্য ভিন গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের মানুষের আকৃতিরই হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই- কিন্তু অপরাপর সম্ভাবনার মতো এটাও একটা যৌক্তিক সম্ভাবনা এবং প্রবল ঘৃণা কিংবা বিতৃষ্ণার বাইরে এই সম্ভাবনাটাকে অগ্রাহ্য করার অন্য কোনো কারণ খুঁজে পাই নি।
মানুষের দখলদারিত্বের মনোভাবটুকুই আসলে সভ্যতার নিদর্শণ তাই এইসব ভিনগ্রহবাসী যেকোনো উপায়ে পৃথিবীকে দখল করে এর প্রাকৃতিক উপযোগকে নিজেদের জন্যে ব্যবহার করতে চায় এবং পুনরায় একদল মানুষ এটাকে প্রতিরোধ করে। হলিউডের মুভি তাই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর অকুতোভয় নির্ভীক সাহসী সৈন্য এবং বুদ্ধিমান বিজ্ঞানীরা একটা কৌশল আবিস্কার করে ফেলেন এবং ভিনগ্রহের প্রাণী পরাজিত হয়।
আতংক-অস্তিত্বের সংকট- নিরাপত্তাহীনতার বোধ- এতবেশী প্রকট এখানে গত ১ বছর ধরে আমি স্টার ওয়ারস সিরিজটা দেখার চেষ্টা করেও দেখা শেষ করতে পারি নি। আমাদের ভেতরে এক ধরণের ভীতি আছে সেটার অস্তিত্ব প্রকট ভাবে দৃশ্যমাণ হলেও এত বিরাগের কারণ খুঁজে পাই নি।
ভিন্ন সংস্কৃতি- ভিন্ন ভাবনা- ভিন্ন বুদ্ধিমান প্রাণীদের প্রতি উগ্র আতংকিত বিদ্বেষ মাঝেমাঝে অসহনীয় হয়ে যায়। আমাদের অবচেতনে প্রতিশোধ বাসনা তৈরি হয়।আমরা তীব্র আতংকে গুটিয়ে যাওয়ার পর সহিংসতায় উল্লসিত হই। নিশ্চিত হই আমরা আর ঝুঁকির মুখোমুখি নই।
আতংক-অস্তিত্বের সংকট- নিরাপত্তাহীনতার বোধ- এতবেশী প্রকট এখানে গত ১ বছর ধরে আমি স্টার ওয়ারস সিরিজটা দেখার চেষ্টা করেও দেখা শেষ করতে পারি নি। আমাদের ভেতরে এক ধরণের ভীতি আছে সেটার অস্তিত্ব প্রকট ভাবে দৃশ্যমাণ হলেও এত বিরাগের কারণ খুঁজে পাই নি।
এ ধরনের মুভি কেন জানি আমাকে টানে না
মন্তব্য করুন