ঈদ
বেঁচে থাকা মানে অবিরাম স্মৃতির কোলাজ তৈরী করা, হঠাৎ চলতি পথে কোনো একটা দৃশ্য দেখেথমকে দাঁড়ানো- হুবহু এমনই কোনো একটা দৃশ্য অতীতে তৈরী হয়েছিলো- সেটার পুনচিত্রায়ন ঘটলো এই মুহূর্তে- আমি একটা মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ভিন্ন একটি মুহুর্তে জেগে উঠলাম- সংলাপ থেমে যাওয়ার পর এক ধরণের শব্দহীন বিবশতা অদৃশ্য পর্দার মতো চারপাশে ঝুলে থাকে - তেমন শব্দহীনতার মূহুর্ত থেকে ধীরে ধীরে বর্তমানের শব্দমুখরতার ফিরে আসা- কেউ ডাকছে না তবু কোনো একটা পিছুডাকের জন্যে উৎকর্ণ হয়ে থাকা।
শৈশবে পূর্নিমা ছিলো না, চাঁদ উঠতো, নিজের মতো চৌদ্দ কলা পুরণ করে নিজেই অমাবস্যায় হারিয়ে যেতো, সারা বছর সেটার অস্তিত্ব খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না, শুধুমাত্র বছরের একটা দিনেই চাঁদের খোঁজে সন্ধ্যা বেলা পশ্চিমের আকাশে তাকিয়ে থাকতাম- ২৯শে রোজার সন্ধ্যা বেলার উৎকণ্ঠা মাগরিবের আজানের পরের কিছুক্ষণ টিকে থাকলেও চাঁদ রাতের বিষয়টা ৯টা নাগাদ নিশ্চিত হয়ে যেতাম, ৩০শে রোজার সন্ধ্যার আকাশ তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না, চাঁদ উঠুক আর নাই উঠুক আজকে চাঁদ রাত, তবে নানী ইফতারি শেষে একবার চাঁদের খোঁজে উঠানে নামতো- তারপর চাঁদ দেখে ঘোষণা করতো এইটা দ্বিতীয় দিনের চাঁদ- ঈদের দিনটা এইভাবে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো সে দুঃখ খুব বেশী থাকতো না-
প্রথম দিনের ফিনফিনে চাঁদ শাড়ীর আঁচল দিয়ে দেখা যায় না, শুধু রেশমী ওড়না দিয়ে দেখা যেতে পারে- এ কথার কোনো গুরুত্ব ছিলো না। বেড়ে ওঠার পর অবশ্য আকাশের চাঁদের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো টেলিভিশনের সংবাদ, ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম আমাদের আকাশে উঁকি দেওয়ার একদিন আগেই সৌদী আরবের আকাশে চাঁদ দেখা যায়।
২৭শে রোজার রাতে মহল্লার সবাই শবে কদর উদযাপনে ব্যস্ত থাকতো, বড়রা মসজিদে, অতি ধার্মিক কেউ ২০শে রোজা থেকেই ইতিক্বাফে বসেছে, মহল্লার মহিলারা পালা করে গিয়ে দেখে আসছে তাকে, এমন ধর্মপ্রাণ মানুষকে দেখাই পূণ্যের কাজ,আমাদের মতো ছোটোরা সকাল থেকেই বাঁশ গেঁথে প্যান্ডেল বানিয়ে ২৭শে রাতের জন্যে প্রস্তুত- সারা রাত ইবাদাত বন্দেগী আর জিকির শেষে ভোর বেলা সেহেরী খেয়ে ঘুমাতে যাবে সবাই। শবে বরাতের রাতে আর শবে কদরের রাতের দোয়া করতো যে ছেলেটা সে সম্পর্কে মামা হলেও ছিলো বন্ধুস্থানীয়- এই বন্ধুত্ব এখনও টিকে আছে- প্রতিবার দোয়ার সময় সে কাঁদতো- আমি অবাক হতাম- তার ক্ষমা চাওয়ার আর ক্ষমা পাওয়ার আকুতি- তার আবেগ- অনুভুতিতে কোনো খাদ ছিলো না- সেই কয়েক মিনিট সত্যি সত্যি কাঁদতো ও আর দোয়াটা শেষ হওয়ার পর আবার নিজের পুরোনো শরীরে ফিরে আসতো। আমাদের জীবনটা নানা ভাবে বদলে গেছে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়- চাকুরী জীবন- বিয়ে - সন্তান ধাপ পেরিয়ে সামাজিক বাস্তবতার আঁচ গায়ে মেখে অনেকটা পরিণত হয়ে যাওয়ার পরও, এখনও ও নামাজের দোয়ার পর কাঁদে, প্রতিদিন নিজের অক্ষমতার জন্যে ,নিজের অজ্ঞাতে হয়ে যাওয়া অসংখ্য অপরাধের জন্যে এমন আকুল ক্ষমা প্রার্থনা আর ক্ষমার আকুতি অবাক করে,
প্রতি শবে কদরে যেমন নিয়ম করে ইবাদাত মেহফিল হতো ঠিক তেমন নিয়ম মেনেই প্রতি ঈদেই দল বেধে বাংলা সিনেমা দেখতে যাওয়া হতো- সম্ভবত সুবর্ণা মোস্তফা আর হুমায়ুন ফরিদীর কোনো একটা ছবি দেখা হয়েছিলো শেষ বার- সময়কাল দেখে নিশ্চিত সেটা অপহরণ না।
তবে একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর রোজার মাসের সিজন্যাল ব্যবসায় নামতো মহল্লার সবাই। শুরুটা হয়েছিলো ঈদ কার্ড দিয়ে- মহল্লার ভেতরেই কেউ একজন ঈদ কার্ডের দোকান খুলেছিলো, ছোটো কার্ড ২ টাকা আর বড় কার্ড ৫ টাকা- তবে চাঁদ রাতের শেষ সময়ে কার্ডের মূল্যহ্রাস হতো তখন অর্ধেক দামেই কার্ড কেনা যেতো। ঈদ মোবারক, পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছার বেশী কিছু লেখা থাকতো না সেখানে- কার্ডের ভেতরে প্রাপকের নাম আর প্রদায়কের নাম লেখার প্রচলন ছিলো তবে উঠতি প্রেমের নিদর্শিন হিসেবে সুর্যোদয় সুর্যাস্ত হৃদয়ের ছবি আঁকা ঈদ কার্ডগুলোর কোনোটাতেই কোনো নাম লেখা থাকতো না, গভীর রাতে সেসব নাম ঠিকানাহীন কার্ড দরজার সামনে রেখে আসা হতো। এই পরিচয়হীন নিবেদনে কোনো প্রেম হয়েছিল কি না বলা যায় না- অন্তত প্রেম বিষয়ে এক ধরণের ট্যাবু তখনও পর্যন্ত মহল্লায় ছিলো। ঈদ কার্ডের হাত ধরে মফস্বল থেকে ধীরে ধীরে শহর হয়ে উঠেছে আমাদের জনপদ- আমরা সংলাপহীন এইসব ঈদ কার্ডে নাগরিকতার প্রথম সবক নিয়েছি।
পরে অবশ্য লাচ্ছা সেমাই, সেমাই মসলা, প্যাকেট সেমাই ইত্যাদির দোকান খোলা হতো, গলির মুখে চৌকি বিছিয়ে ত্রিপল সামিয়ানা ঝুলিয়ে কয়েক মন সেমাই নিয়ে যাত্রা শুরু হতো দোকানের- সুর করে লাচ্ছা সেমাই লাচ্ছা সেমাই চিৎকার করতো ওরা- আমার ব্যবসা বুদ্ধি ছিলো না, ব্যবসার উৎসাহ ছিলো না- তবে এই ভীড়- এই উৎসব উৎসব আমেজটুকু উপভোগ করতাম। রোজার শেষ সপ্তাহে চাচারা টুপি তসবীহ আর আতরের দোকান দিতো- চাচার দোকানে বসে বিভিন্ন ডিজাইনের টুপি দেখে ঈদের জন্যে টুপি বাছাই করতাম, কখনও টুপিটা কেনা হতো- কখনও ভুলে যেতাম। তবে কোনো কারণ ছাড়াই মহল্লার সামনের লাচ্ছার দোকান থেকে চাচার টুপির দোকানের সম্পূর্ণ পথটা অন্তত ২০ বার পায়ে হেঁটে পারি না দিলে চাঁনরাত সমাপ্ত হতো না।
মনে নেই ঠিক কবে ঈদের কাপড়ের উৎসাহ হারালাম, কোনো একটা সময় হয়তো ঈদের কেনাকাটার উচ্ছ্বাস উৎসাহ ছিলো- পিয়ারসনের দোকানটা শুরু হওয়ার পর একবার পিয়ারসনের প্যান্ট কেনা হয়েছিলো- জাম্প কেডস আসার পর শখ করে জাম্প কেডস আর পরবর্তী সময়ে অনেক অনুরোধ করে একবার পাওয়ার কেডস কেনা হয়েছিলো মনে আছে কিন্তু এর বাইরে ঈদের কেনাকাটা মানে মামাকে সাথে নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরা। দোকানে যাওয়ার আগে টেইলার্সের মামার কাছে শার্টের মাপ আর প্যান্টের মাপ নিয়ে যাওয়া তারপর ১ গজ ২ গিরা প্যান্টের কাপড় আর ২ গজ শার্টের পিস কেনা নিয়ে খুব বেশী আগ্রহ তৈরী হতো না। নামাজের আগে ঈদের কাপড় দেখলে পুরোনো হয়ে যাবে এই বিশ্বাসটাও খুব বেশী দৃঢ় ছিলো এমনটা মনে হচ্ছে না এখন- সম্ভবত তখন এটুকু বুঝতে পারতাম বছরের শুরুতে স্কুল ড্রেস আর বছরের মাঝামাঝি ঈদের সময় একটা প্যান্ট একটা শার্ট পাওয়া যাবে, সেটা দিয়েই বছর চালাতে হবে- সে তুলনায় এখন ঈদের আয়োজন অনেক বেশী।
ঋকের প্রথম ঈদে ঋক পাঞ্জাবী পরবে না বিষয়টা আমার জন্যে খুব বেশী অদ্ভুত লাগে নি, শপিং মলে চাইলেই ঋকের মাপের পাঞ্জাবী পাওয়া যাবে না, পাঞ্জাবী সম্ভবত নিউ ইয়র্ক সানফ্রান্সিসকো লস এঞ্জেলস ধাঁচের বড় শহরের বাইরে পাওয়াই যায় না। ঋকের ঈদের পোশাক নিয়ে আমার নির্লিপ্ততায় সবচেয়ে আহত হয়েছিলো লিপি- ঋকের ঈদের পাঞ্জাবী বিষয়ে আমার অনাগ্রহ আমার অপরাপর অসংখ্য অযোগ্যতার তালিকায় নতুন একটা সংযোজন হিসেবে যুক্ত হয়েছে নিশ্চিত ভাবেই- তবে আমার নির্লিপ্ততা- অনাগ্রহ ওকে দ্বিগুণ উৎসাহী করেছিলো । ও ওয়ালমার্ট থেকে গজ কাপড় কিনে নিজের ডিজাইনে একটা পাঞ্জাবী সেলাই করলো সুই সুতা দিয়ে। আমার মতো অনুভুতিহীন একটা মানুষ কিভাবে বাচ্চার ঈদের পোশাক নিয়ে এত উদাসীন থাকতে পারে, তার বাবা থাকলে কিভাবে ঋকের জন্যে পাঞ্জাবী কিনতো সেইসব স্মরণ করে- করিয়ে নিজের হাতে সেলাই করা পাঞ্জাবী ঋককে পরিয়ে নিজের মতো হাসল কাঁদলো-
পহেলা বৈশাখ-ঈদ-পূজা- জন্মবার্ষিকী মৃত্যু বার্ষিকী কিছুই আমাকে স্পর্শ্ব করে না, এক ধরণের অথর্ব নির্লিপ্ততা তৈরী হয়েছে নিজের ভেতরে, সামাজিক উৎসবের নামে এই হৈ হট্টোগোল- এই হুল্লোড় দেখে আমি বিরক্ত হই, মফস্বলের জীবন ছেড়ে মেট্রোপলিটন কারাগারে বন্দী আমি কোথাও উৎসব খুঁজে পাই না। অনেক দিন পর মহল্লার গলিতে ঈদ কার্ডের দোকান দেখে কিছুটা বিস্মিত হলাম, ১০ বছর আগেই কাগজের কার্ডের বদলে ই-কার্ড সংস্কৃতির প্রচলন হয়েছে, এই এসএমএস এমএমএসের যুগে এখনও কি মানুষ মানুষকে ঈদ কার্ড দেয়??
আপনার এই ধরনের লেখাগুলোর এক বিস্ময়কর ফ্যান আমি ভাইয়া!
প্রচন্ড রকম নস্টালজিক একটা লেখা, ভাল্লাগছে খুব।
কিছু পরিচিত আর কিছু অপরিচিত
আপনার লেখা অযথাই আবেগতারিত করল। কি সাবলীল অথচ কত চেনা।
মন্তব্য করুন