সৈয়দ মুর্তজা আলী
রম্যসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাই সৈয়দ মুর্তজা আলী ইতিহাসবিদ ছিলেন। তিনি MUSLIM EDUCATION IN BENGAL 1837-1937শীর্ষক পর্যালোচনায় ব্রিটিশ শাসিত উপমহাদেশে বিশেষত শিক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যাসল্পতার বিভিন্ন কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। কারণগুলোকে ভৌগলিক, ভাষিক এবং আদর্শিক কাঠামোতে ভাগ করা যায় সহজেই। কোম্পানী ক্ষমতাকাঠামো কোলকাতাকেন্দ্রীক হওয়ায় সেখানে প্রথমে স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- কোলকাতা নগরের পার্শ্ববর্তী হুগলী এলাকার কিছু ধনী মুসলিম পরিবারের সন্তান ব্যতীত বৃহত্তর বঙ্গ ও আসামের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ ছিলো না।
যদিও ১৭৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত কোলকাতা মাদ্রাসা ছিলো ইংরেজ শাসকদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তবে সর্বস্তরের মুসলমানদের জন্যে এর দরজা উন্মুক্ত ছিলো না। জমিদারের সন্তানেরাই সেখানে পড়তে পারতো এবং তারা ইংরেজী ভাষায় শিক্ষাগ্রহন করতে আগ্রহী ছিলেন না। কোম্পানীর চাকুরির লোভে কেউ কেউ ইংরেজী পড়তে চাইতেন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ইংরেজী ভাষা শেখানোর জন্যে একজন ইংরেজকে নিয়োগ দিয়েছিলেন কোলকাতা মাদ্রাসায়। শিক্ষক বেচারা দিনের বেলা ক্লাশ নিতে পারতেন না, মাদ্রাসায় পবিত্র অঙ্গন খেরেস্তান পাপী মুরতাদের পদধুলিতে কলুষিত হবে বিধায় তাকে রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে প্রবেশ করতে হতো মাদ্রাসাচত্ত্বরে।
প্রাথমিক পর্যায়ের ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা সময়ের সাথে কমেছে। ১৮৪১ সালে ঢাকা কলেজ স্থাপিত হয়েছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট ঢাকায় স্থাপিত ঢাকা কলেজে পরবর্তী ৫০ বছরে মুসলিম শিক্ষার্থী মোট ছাত্রের ১০ ভাগের এক ভাগেরও কম ছিলো।
ইংরেজী শাসকেরা উর্দু-ফার্সীর বদলে হিন্দুয়ানী বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দিয়েছে। খেরেস্তান পাদ্রীরা মুসলমানদের শব্দ বদলে হিন্দু সংস্কৃতিঘেঁষা বাংলা শব্দকে গুরুত্ব দিচ্ছে। আমরা এই হেঁদুর ভাষায় পড়বো না- ২ কোটি ২২ লক্ষ বাংলাভাষী মুসলমানের বিপরীতে ১৮ লক্ষ উর্দু ভাষী মুসলমানকে গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় উর্দুকে ব্যবহার করতে সুপারিশ করেছেন মুসলিম জমিদার শ্রেণীর নেতারা।
১৮৫৪ সালের শিক্ষা কমিশনের পরামর্শ অনুযায়ী এমন কি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের আবশ্যিক বিষয়ের কোথাও ধর্মশিক্ষার অস্তিত্ব ছিলো না- স্কুলগুলোতে খ্রীষ্টান-হিন্দু- কোনো ধর্মই শেখানো হতো না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন স্কুল সিলেবাসে ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষার অনুপস্থিতিতে খুব বেশী উদ্বিগ্ন ছিলো না কিন্তু মুসলমানদের মনে হয়েছে এই সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার একমাত্র লক্ষ্য মুসলমানদের ধর্মনাশ করা। ধর্মান্তরিত করণের সংশয়- সন্দেহ থেকে তারা ইংরেজী শিক্ষায় আগ্রহী ছিলেন না। ১৯৩৪ সালের মুসলিম শিক্ষা কমিটির প্রস্তাবিত শিক্ষানীতিতেও ধর্ম শিক্ষার বাহুল্য ছিলো না, ১৯৪০ সালে জাকির হোসেইনের সর্বভারতীয় শিক্ষানীতিতেও বাধ্যতামূলক ধর্ম শিক্ষার অস্তিত্ব নেই।
বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা প্রচলিত হয়েছে ১৯৮৫ সালে, প্রথমে স্কুল সিলেবাসে আরবী ভাষাশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রথমে ৫০ নম্বর এবং পরবর্তীতে ১০০ নম্বরের চুড়ান্ত পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে।
প্রায় ৩০ বছর ধরে আমরা স্কুলের পাঠ্যবইয়ে ধর্ম ও নৈতিকতা শিখছি। আমাদের জাতীয় জীবনে স্কুলপাঠ্যবইয়ে শেখা ধর্ম ও নৈতিকতার প্রভাব পরেছে কতটুকু? সময়ের সাথে বিভিন্ন সরকারী- বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতিগ্রস্ত এবং অপরাধপ্রবন কর্মকর্তা কর্মচারীর পরিমাণ বৃদ্ধির পরিসংখ্যান দেখে মনে হয় বাধ্যতামূলক নৈতিকতা শিক্ষা শিক্ষার্থীদের অপরাধপ্রবন করে। যদি ধর্মবাদীদের সুপারিশ মেনে আরও বেশী মুসলিমায়িত সিলেবাস তৈরী করা হয়, আমরা শতভাগ চোরের দেশে পরিণত হবো।
৯২ শতাংশ মুসলমানের দেশের স্কুলের পাঠ্য বইয়ে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্তি নেই। এখানে পাঠ্যবিষয়গুলোতে মুসলিম ঐতিহ্য উপেক্ষিত। সুতরাং পাঠ্যবই সংস্কার করতে হবে। সম্ভবত মুসলিমায়িত সিলেবাস যুগোপযোগী করতে তৃতীয় শ্রেণী থেকেই রসায়ন বইয়ে বোমা তৈরীর কৌশল শেখানো হবো, চতুর্থ শ্রেণী থেকেই ফিজিক্স এন্ড ইলেক্ট্রনিক্স কোর্সে শেখানো হবো রিমোট ডিটেনেটর তৈরীর বিভিন্ন কৌশল। বাধ্যতামূলক শাররীক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে চাপাতি চালানোর কৌশল।
মন্তব্য করুন