বাংলাদেশ ডায়েরি ০২
গত রাতেও যেখানে ছিলাম, শুনশান নিরব মফঃস্বল, পাশের বাসার মানুষটা বিছানায় পাশ ফিরলেও চাদরের খসখস শব্দ কানে আসে। পাখীরাও চুপচাপ। যন্ত্রের যন্ত্রনাকাতর দীর্ঘশ্বাস জমাট বেধে আছে শহরের বাতাসে। শিহরন নেই, বরং অহেতুক উৎকণ্ঠা ভাবনায়। ধুলার গন্ধ নাকে আসে, ভয় হয় যদি বুক ভরে শ্বাস নেই, এইসব ধুলো জমে ফুসফুস খসখসে হয়ে যাবে।
শহরে কোলাহল, হট্টগোল, ধুলা আর আবর্জনা বেড়েছে। শহরের বাসিন্দারা নিজেরাই কারাগার বানিয়ে জীবনযাপন করছে। পুরোনো মহল্লার সবগুলো রাস্তায় আলাদা আলাদা দরজা। রাত ১২টার পর শুধু একটা গলি দিয়েই ভেতরে প্রবেশ করা যায়। শিশুদের সাথে খুনসুটি, হকারের চিৎকার, রিকশাওয়ালার বিশ্রাম আর পথচলতি মানুষের নাকখোঁটানো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে কেউ না কেউ। সম্ভবত কেউই দেখছে না, তবে শমন পাঠালে যেকোনো দিনের যেকোনো মুহূর্তে কে কোন দরজা খুলে রাস্তায় নামলো জানা সম্ভব এখন। বিপনীবিতান আর কাঁচা বাজারের মাঝামাঝি যতটুকু পথ সব পথেই কোথাও না কোথাও একটা ক্যামেরা অদৃশ্য নজরদারিতে ব্যস্ত। এর মাঝেই ছিনতাই হচ্ছে, খুন হয়ে যাচ্ছে মানুষ।
শহরে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাশঙ্কিত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। যানজটে পর্যুদস্ত শহরে এদের যন্ত্রনায় রাস্তায় নামা কঠিন। প্রধানমন্ত্রী কি যেনো উদ্বোধন করবেন, রাস্তার দুইপাশে ব্যস্ত পুলিশ। ফুটপাতে দাঁড়ানো মানুষেরা অসস্তিতে পাশ ফিরলেও হন্তদন্ত দৌড়ে আসছে। সভ্য ফুটওভারব্রীজে ওঠা বারণ, স্থবির রাস্তা পেরুনো বারণ। ফুটপাতে ছবির মতো স্থির দাঁড়িয়ে আর বাসের ভেতরে অশালীন গালিগালাজে মেতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনযাত্রা উদযাপন শহরবাসীর নিত্যদিনের বিনোদন। তিনি যদি অনুগ্রহ করে মাসের শুরুতে তার যাত্রাপথ এবং উদ্বোধনযজ্ঞের হালনাগাদ তথ্য দিতেন, আমরা সেভাবে আমাদের গতিপথ নির্ধারণ করতাম। উন্নয়নের ধুলাঝড়ে শ্বাসকষ্ট না হলে এই শহরে পায়ে হেঁটে বাসের আগে গন্তব্যে পৌঁছানো যায়। আমার গন্তব্য অবশ্য ট্রেন স্টেশন। প্রধানমন্ত্রীর চলমান নিরাপত্তাবেষ্টনী পার হয়ে যাওয়ার পর ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতই পৌঁছানো সম্ভব হলো।
অনেক অনেক দিন পর বাংলাদেশের ট্রেনে উঠলাম। প্রথম প্রথম আন্তঃনগর ট্রেনসার্ভিস শুরু হওয়ার পর প্রতিটি স্টেশনের আলাদা বৈশিষ্ঠ্য ছিলো। পার্ব্বতীপুর স্টেশনের পাশের হোটেলে সকালের নাস্তা করে কাউনিয়া জংশনের মাংসের চপ খেতে হবে, গফরগাঁওয়ে থেমে বড় বড় গোল বেগুন নিয়ে আস্তে ধীরে ঢাকা নগরীতে প্রবেশের ঐতিহ্যমন্দ্রিত ভ্রমণ এখন অতীত স্মৃতির অংশ, যমুনা ব্রীজ হওয়ার পর যাত্রাপথ বদল হয়েছে। নাটোরের কাঁচাগোল্লা যদিও প্রসিদ্ধ কিন্তু আমার পছন্দের তালিকায় নেই। সপরিবারে বছরে একবার বাড়ী যাওয়ার সময় এইসব স্টেশনে নেমে অবশ্যকর্তব্য তালিকা তৈরী এখন প্রায় অসম্ভব। উদ্বিগ্ন হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চলতি ট্রেনের যেকোনো দরজা ধরে উঠে যাওয়া কিংবা ট্রেন ফেল করে পরের যেকোনো ট্রেনে উঠে গন্তব্যে যাওয়ার বিলাসিতা করা কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়কালীন সময়ে যেভাবে ট্রেনের পাদানীতে দাঁড়িয়ে আয়েশ করে সিগারেট টানা যেতো, তেমনটা অনেক দিন করা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটির পরদিন সবান্ধব বাড়ীফেরার ট্রেনে উঠে যাওয়ার মতো বন্ধুরা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অফিসরুমে দাসখত লিখে দিয়ে উদয়াস্ত দস্তখত দিচ্ছে।
এক হাত শর্ট আছে, স্পেড-ট্রাম না কি টুয়েন্টি নাইন কোনটা খেলতে পারেন বলার মতো মানুষগুলো ট্রেনে নেই। যতসব উজবুক পার্শ্ববর্তী মানুষের অনুমতির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে মাথা বাঁকিয়ে ছবি তোলা আর ভিডিও সংলাপে ব্যস্ত আত্মতুষ্ট, নিজের ভেতরে বন্দী মানুষগুলো ট্রেনে ভীড় করে আছে। মুঠোফোনের ৬ ইঞ্চি স্ক্রীনের বাইরে দেখতে না পারার ব্যাধি সামষ্টিক আত্মপ্রেম নয় বরং স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতা। আপনি আমাদের ওখানে আসলে অবশ্যই আমাদের বাসায় আসবেন, না তো আমি ভীষণ রাগ করবো। স্টেশন থেকে নেমে রিকশায় আমাদের বাসা যেতে ১৫ মিনিট লাগবে। রিকশাওয়ালাকে বললেই হবে- নিজের নাম ঠিকানা অবলীলায় জানিয়ে দেওয়া ট্রেনতুতো সম্পর্কগুলো এই সময়ে তৈরী হবে না।
মন্তব্য করুন