মিষ্টি, দই, রসমালাই
গতকাল একটি কন্সট্রাকশন আইটেম চেক করার সময় ধরা পড়ল আইটেমটির রিকুইজিশনে (চাহিদা পত্র) পরিমাণ কম দেয়া হয়েছে। রেশপেক্টিভ ইঞ্জিনিয়ারসহ অনেকেই একাউন্টেড এর রুমে বসে কথা বলছিলাম। আমি বললাম যা চেয়েছি তাই আসুক পরে দেখা যাবে। একজন বললেন স্যার যে পরিমাণ ওয়েস্টেজ দেয়া হয়েছে কাভার হয়ে যাবে। শ্মশ্রুমণ্ডিত আমার এক প্রিয় সহকর্মী প্রাক্কলন ও সাইটের কাজে পাকা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি যা জবাব দিলেন তা বলার আগে একটু ভুমিকায় যেতে হয়। যদিও ভুমিকাটি উনি বলেন নি, সরাসরিই বলেছিলেন।
এক ব্যাক্তির অন্য আর একজনের সাথে বিরোধ থাকার কারনে সখ হল, সে প্রতিপক্ষের সেরা গরুটি বিষ প্রয়োগে হত্যা করবে। কিন্তু এত বড় গরু মারতে হলে তাঁর জন্য কটটুকু বিষ কিনতে হবে তা তাঁর জানা ছিল না। তাই সে চাচা সম্পর্কিত এক মুরুব্বীর কাছ থেকে পরামর্শ চাইল। চাচাজানটি ছিলেন আবার হাজী মানুষ, তিনি কি করে এহেন খারাপ কাজ করার পরামর্শ দিতে পারেন। তাই তিনি ছন্দাকারে বললেন,
হাজী মানুষ কিছু কইতেও পারি না,
যত বড় গরু এক পোয়ার কম মরবেও না।
আমি প্রথমে ঠিক বুঝতে না পেরে বললাম আবার বলেন তো, উনি আবার বললেন এবার সাবাই হা হা করে হেসে দিলাম। আমরা অনেকেই এমন ছন্দাকার উপদেশটির মত কাজ করি। আজ সকালেও তাঁর প্রমাণ পেলাম,যার সাথে আমি মাঝে মাঝেই যুক্ত হই। আমার বউটির মিষ্টির প্রতি ছিল অশেষ দুর্বলতা। কিন্তু গত চার বছর ওর ডায়াবেটিস ধরা পড়াতে ওর মিষ্টি খাওয়া বারন। আমার নিজেরও মিষ্টি দই, রসমালাই এর প্রতি দুর্বলতা আছে বৈ কি? আমি মাঝে মাঝে কিনি, তাছাড়া প্রজেক্ট, বিশেষ করে কুমিল্লা বিবিয়ানা প্রজেক্টে গেলে, প্রজেক্ট ম্যানেজার উত্তম কোয়ালিটির এই উপাদেয় খাবার গুলো আসার সময় দিয়ে দিত। আমরা খেতাম ও তাকিয়ে থাকত, আমার তখন এত কষ্ট হত, আমি বলতাম অল্প একটু খাও কিছু হবে না, ছেলে মেয়ে বাঘের মত গর্জ্জন উঠত, না খাওয়া যাবে না। মরার এত সখ কেন? আমি বুঝায় বলতাম বাবারা আমরা খাচ্ছি, ওর ও তো মন চায়।
আমরা কিছুই বলব না। তোমাদের যা খুশি কর। (বিশেষ করে মেয়ে)
বাসায় এই জাতীয় খাবার থাকলে ছেলে মেয়ে সব সময় খেয়াল রাখবে, ওর মা কখনো মিষ্টি, দই বা রসমালাই খায় কি না। আমার টুনটুনি পক্ষীটি আবার ফুরুত ফারুত করে মাঝে মাঝেই এই সুকর্ম বা অকর্মটি করে ফেলেন। ধরা যখন খায় তখন শুধু ধরাই খায় না এক গাধা গালও খেতে হয় ছেলেমেয়ের কাছে।
লজ্জা হয় না, এত বলি লজ্জা হয় না। মরার এত সখ তো আমাদের দুনিয়াতে আনলে কেন? বলেই বিশেষ করে মেয়েটি অনেক সময় কেঁদে ফেলে। আমি বাসায় থাকলে শুধু বলি ছেলে মেয়ে না করে কেন খাও। ও চোখের পানি মুছে। আমার তখন কষ্টটা আরও বাড়ে।
আজ সকালে ছেলে অভিযোগ করল আব্বু , আম্মু তো আমাদের কথাই শোনে না। আমি বললাম তোমার আম্মুর শাস্তি হল আমি সাতদিন তোমার আম্মুর সাথে কথা বলব না, তাহলেই যব্দ হবে। আচ্ছা তাই হবে। গিন্নিও রাজি। সাত দিন ত অনেক পরে সাত মিনিট না যেতেই ও ওয়াদা ভংগ করল। আমি ওর মোবাইলে কল দিলাম, ও ধরে প্রথম প্রশ্ন, ফোন দিলে কেন? আমি তোমাকে কল দেইনি। মেয়ের সাথে কথা বলি নি তাই মেয়েকে কল দিতে গিয়ে তোমার নম্বরে চলে গেছে। তুমি রিসিভ করলে কেন? ছেলেও বলল তুমি রিসিভ করলে কেন? তুমিই ওয়াদা ভংগ করেছ। আমি জানি ও হাসপাতালে আবার কল দিলাম, কি ব্যাপার, ও তোমার নম্বরে চলে গেছে। আমি তো ছেলের নম্বরে কল দিয়েছি, তুমি রিসিভ করলে কেন? বুঝুন ঠেলা ওয়াদা ভংগ করার কি কৌশল। বলুন তো এমন ওয়াদা ভংগ কারীর কি শাস্তি হওয়া উচিত?
লেখাটা এখানেই শেষ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত আসতেই আমার এক আপার কথা মনে পড়ে গেল। রক্তের সম্পর্কের বাইরেও যে রক্ত সম্পর্কের মত বা তার চেয়েও বেশী হয় উনার সাথে পরিচয় না হলে বুঝতাম না, কারন আজও এমন কাউকে পাইনি।
আমি (বি,আই,টি, রাজশাহী) আমার দল সহ একটি দলীয় সঙ্গীত গেয়ে স্টেজ থেকে নেমে এসেছি, মেজর শাহ আলম ভাই আমাকে ডেকে ভাবির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, ভাবি সাথে সাথে বলে উঠলেন, আরে ও তো আমার ছোট ভাই বাহরাইন প্রবাসী ওর মত (উনার ভাইটির নাম আমার মনে নেই) দেখতে। আজ থেকে ও আমার ভাই, আমিও সাথে সাথে ঠিক আছে বললাম। ক্ষনিকে মেজর শাহ আলম ভাই হয়ে গেলেন দুলাভাই। আগে ও পরে উনারা বোন ও দুলাভাই হিসেবে উনাদের দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করেছেন।
আমি থিসিস করার সময় আমার বউকে নিয়ে রাজশাহী যাই। উনার বাসায় উঠি। পরদিন ওকে নিয়ে আমার হোস্টেলে আসি। আমার বন্ধুরা সেদিন ওকে যে সন্মান ও সংবর্ধনা দিয়েছিল, ও আজও তা স্মরণ করে। রাতে আমার রুমমেট ও ওই ফ্লোরের অন্য বন্ধুরা আমাদের যেতে দেয়নি। আমার রুমমেট রায়হান বাদশা এখন এল জি ই ডিতে কর্মরত, রুম ছেড়ে অন্য রুমে ঘুমাল। এদিকে মেজর শাহ আলম ভাই ও আপা তো মহা চিন্তায়, রাতে হোস্টেলে ফোন করল। আমরা জানালাম আজ আমাদের বন্ধুরা আমাদের আসতে দিচ্ছে না। তাই আজ নয় কাল যাব। গেলাম পরদিন রাতে। এদিকে আপা তো এটা সেটা রান্না করে রেখেছেন। রাতে গিয়ে আর কত খাওয়া যায়। আমাদের তিন দিনের প্রোগাম থাকলেও থাকতে হল এক সপ্তাহ।
পাশ করার পর কোন একটি সেনানিবাসে আমি দুটি প্রজেক্ট করতে যাই। সেই প্রজেক্টে মেজর শাহ আলম ভাইয়ের সাথে দেখা। এত খুশি হলাম যে কি বলব, উনি সাথে করে বাসায় নিয়ে গেলেন। উনাদের দুটি ফুটফুটে সন্তান মামা করে যখন ডাকত মনটা ভরে যেত। আমি সময়ে অসময়ে ভাগ্নাটা ছিল ছোট তাই ওকে মটর সাইকেলে চড়াতাম না, ভাগ্নিটাকে নিয়ে কাজ শেষে বিকাল বেলা ঘুড়ে বেড়াতাম। আমার প্রজেক্টের পাশে আপা অন্যান্য অফিসার ভাবিদের সাথে আসত। আমাকে অনেক ভাবির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। বাসায় ভাল কোন খাবার রান্না হলে ভাগ্না ভাগ্নি চলে আসত আমার রুমে। মামা মা যেতে বলেছেন। আমি বাধ্য ভাইটি, সাথে সাথে চলে যেতাম। আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার ছিল আপার হাতের আচার। দুলাভাই মাঝে মাঝে গান শুনাতেন। আপা ছিল স্বাস্থ্যবান। একদিন আপা মিষ্টি, রসমালাই আরও অনেক খাবার আমাকেও দিলেন উনি নিজেও খাচ্ছিলেন। আমি বললাম,আপনি এত খাচ্ছেন মোটা হয়ে যাবেন তো, আর এত মিষ্টি খেলে আপনার তো ডায়াবেটিস হবে। উনি বললেন, ভাই আমি যদি খাই তবুও আমাকে মরতে হবে, না খেলেও মরতে হবে। তাই খেয়ে মরাই ভাল। আর আল্লাহ যখন ডাক দিবেন, কেউ কি আটকাতে পারবে।
আমার কষ্ট হয় আমরা যখন মজার মজার খাবার খাই কিন্তু ও(আমার গিন্নি) তাকিয়ে থাকে, আমি আড়ালে ডেকে বলি, খাও পরে ঔষধ খেয়ে নিও। আর ওই আপাটির কথা খুব মনে পড়ে। আল্লায় যখন ডাক দিবেন কেউ কি আটকাতে পারবে। আপা হয়ত সাধারন ভাবেই বলেছিলেন, কিন্তু আসলেই তো আল্লাহ সবার মৃত্যুক্ষন নির্ধারন করে রেখেছেন।
প্রায় ১২ বছর আমি দেশের বাইরে থাকাতে আর আপা দুলাভাইয়ের সাথে দেখা হয় নাই। দেশে আসার পর উনারা কোথায় আছেন না জানা থাকায় দেখা করতে পারি নি।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসর প্রাপ্ত) আব্দুর রশিদ ভাই একদিন আমার অফিসে আসলেন, একটি টেন্ডারের বিষয়ে। আজ উনি একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মালিক। অনেকদিন পর দেখা, উনি নিজে থেকেই আমার কোম্পানির এম ডি স্যারকে জানালেন আমরা একসাথে পড়েছি। এম ডি স্যার বুঝতে পেরেছিলেন কি না জানিনা, তবে পরে আমাকে জিজ্ঞস করেছিলেন কি করে উনি তোমার ক্লাস ফ্রেন্ড হয়।
আমি এম ডি স্যারকে জানালাম, আমরা যখন বি,আই, টি তে ভর্তি হই, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে আমাদের সাথে ছয় জন আর্মি অফিসার ভর্তি হন প্রকৌশল বিদ্যা গ্রহণ করার জন্য। সে সুত্রে তারা আমাদের এত সিনিয়র হওয়াতেও আমাদেরকে বন্ধু হিসেবেই মনে করেন। কখনও উনাদের কারও মাঝে অহংকার মূলক কিছু পাই নাই। বরং আমাদের কারও প্রয়োজনে উনারা উনাদের সহায়তার হাত সব সময় প্রসারিত করেছেন। আমরাও উনাদের যে সন্মান দেয়ার তা সব সময় দিয়ে এসেছি।
রশিদ ভাইয়ের কাছ থেকেই জানতে পারি শাহ আলম ভাই টিভিতে মাঝে মাঝে টক শো তে অংশ গ্রহণ করেন। ভাগ্নাটি এখন আর্মি অফিসার। ভাগ্নিটি পড়াশুনা শেষে আর্মি অফিসারের সহধর্মিনী। সে দিন রশিদ ভাইয়ের কাছে উনার সেল নম্বরটি না থাকায় আমি নম্বরটি নিতে পারিনি এবং যোগাযোগও করতে পারিনি। দিন কেমনে চলে যায়। চলার পথে কোথাও ভাগ্না ভাগ্নির সাথে দেখা হলে ওদের চিনতেও পারব না। ওরাও আমাকে চিনতে পারবে না। এটাই হয়ত বাস্তবতা।
আমি জানিনা আমার এ লেখাটি কটটুকু প্রাসঙ্গিক হয়েছে, তবে আমার বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ যদি আমার দুলাভাইয়ের সেল নম্বরটি কারও কাছে থাকে তবে আমার টাইম লাইনে দিও, কৃতজ্ঞ থাকব।
সিরাজগঞ্জ, ফেব্রোয়ারী,০৪,২০১৪ খ্রীঃ
মন্তব্য করুন