ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কি, তার দাবা খেলা ও তিনটি প্রেমকাহিনী
এক.
৭ নং আদমপুর ইউনিয়নের যে প্রত্যন্ত গ্রামে আমাদের উদীয়মান দাবা প্রতিভা ও বিষ্ময়বালক ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কির জন্ম হয় সেখানকার জনতাত্ত্বিক ইতিহাস গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে ৷ কথিত আছে একদা ঐ গ্রামের আইবুড়ো থেকে শিশুকিশোর প্রায় সকলেই বগলে দাবাবোর্ড নিয়ে ঘুরতো ৷ দাবা খেলাটি ঐ প্রত্যন্ত পল্লীর জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায় ৷ ফলে দুপুরের পর ৭ নং আদমপুর ইউনিয়নের টংদোকানগুলোর সামনে পেতে রাখা বেঞ্চগুলো দাবা খেলোয়ার ও সমাগত দর্শকসাধারন দ্বারা পরিপূর্ণ থাকত ৷ এই নৈমিত্তিক দৃশ্যের কোন ব্যতিক্রম ঘটলে পথচারী বা স্কুল থেকে ফেরা বালক বালিকারা কিছুটা বিষ্মিত হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত যে আজ ৭ নং আদমপুর ইউনিয়নে কি এমন ঘটল যার জন্য ঐ বেঞ্চগুলোকে শূণ্য হয়ে পড়ে থাকতে হল ৷
এই কারণে আমাদের উদীয়মান দাবা প্রতিভা ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কি যেদিন এই রাজধানী শহরে পা রাখেন সেদিন যুগপৎ বিষ্মিত ও হতাশ হয়ে লক্ষ করেন যে, এই শহরে কেউ দাবা খেলেনা ৷ শুধু তাই না, দাবা খেলা নিয়ে উন্নত জনপদে কোনপ্রকার উত্তাপ উত্তেজনা নাই ৷ কিন্তু আমাদের গল্পের নায়ক ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কি, যিনি একজন উদীয়মান দাবা প্রতিভা, যিনি পূর্বেও উদীয়মান ছিলেন, এবং নানান অসুবিধার কারণে যিনি উদয় হইতে পারেন নাই— তিনি এই ঘটনায় যারপরনাই দুঃখিত হয়ে পড়েন। বস্তুত জাগতিক জীবনের দৈব ঘুর্ণিপাকে শৈশবের নানান অনুষঙ্গ স্মৃত বিস্মৃত হলেও দাবা খেলাটিকে তিনি আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন৷ ৭ নং আদমপুর ইউনিয়নের স্মৃতি তাকে সর্বক্ষণ তাড়িত করতে থাকে ৷ ফলে পরদিন জুম্মাবার বিকালে দক্ষিণখান গাওয়াইর বাজারের অলিগলিতে মাথায় টাক পড়া এক ব্যক্তিকে বগলে দাবাবোর্ড নিয়ে ঘুরতে দেখা যায় । তাকে আলামিনের দোকানে, দক্ষিণখান স্টাফ কোয়ার্টার মাঠে, গাওয়াইর বাজার মসজিদের সামনে, রাইজিংসান স্কুলের গেটে, এবং এইরকম আরো কিছু জায়গায় নিবিষ্ট মনে দাবা খেলতে দেখা যায় । কখনও কখনও তার সঙ্গী জুটে যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জুটে না তখন সঙ্গীহীন একা খেলতে হয়৷
এহেন খেলোয়ারশূণ্যতা ও দর্শকশূণ্যতার ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় দাবা খেলা বিষয়ে লোকজনের ভিতর সেই পরিমাণ আগ্রহ তৈয়ার হয় নাই। কিন্তু ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কি যিনি একজন উদীয়মান দাবা প্রতিভা, এবং যিনি পূর্বেও তাই ছিলেন, তিনি মনে করেন দাবা খেলা বিষয়ে এহেন অনাগ্রহ অসচেতনতার মুলে রয়েছে রাষ্ট্রীয় আন্ত:রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাব ।
দুই.
আমরা দেখতে পাই যে, বগলে দাবা বোর্ড নিয়ে ঘুরন্ত লোকটিকে দক্ষিণখান গাওয়াইর বাজারের দোকানদার, কাষ্টমার, পথচারি ও স্কুলবালকেরা নানান প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করে, তিনি ধৈর্য্যধারন করে প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দেন। যেমন, কতদিন ধরে এই পাগলামি চলছে , ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কি এর উত্তরে বলেন শৈশবে তিনি যখন ৭ নং আদমপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামে থাকতেন তখনও এভাবেই দাবাবোর্ড নিয়ে ঘুরতেন, তিনি একা নন, তার গ্রামের অনেকেই বগলে দাবাবোর্ড নিয়ে ঘুরত।
কার কাছ থেকে দাবা খেলা শিখলেন এই কথার জবাবে তিনি বলেন, ইতোপুর্বে ৭ নং আদমপুর ইউনিয়নের ঐ প্রত্যন্ত গ্রামে যারা বগলে দাবাবোর্ড নিয়ে ঘুরতো তাদের কাছ থেকেই পরম্পরায় দাবা খেলা শেখা হয়েছে, যেমন করে এডলফ এন্ডারসন, লিওনেল কিয়েসেরিতস্কি, ডিউক অব ব্রান্সউইক, ইমান্যুয়েল ল্যাস্কার, ববি ফিশাররা দাবা শিখেছেন । চৌষট্টি ঘরের একটি সাদামাটা বোর্ডের উপর বত্রিশটি ঘুটিঁর বিস্ময়কর দাপাদাপি কিরকম চিত্তাকর্ষন ও মনোগ্রাহী হতে পারে সেই ব্যাখ্যা তিনি জনে জনে বয়ান করে বেড়ান।
এই সুবাদে দক্ষিণখান গাওয়াইর বাজারের মুস্তাফিজ, রিপন ও ছামেদুল যারা আলামিনের দোকান ও তার পাশের দোকানে কাজ করে তাদের দাবা খেলা শেখা হয়ে যায় । তারা এমনকি দাবার নানান ওপেনিং ষ্ট্র্যাটেজি যেমন কিংস গ্যাম্বিট, কুইনস গ্যাম্বিট, রুই লোপেজ, সিসিলিয়ান ডিফেন্স ইত্যাদির সাথেও পরিচিত হতে থাকে। ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কি তাদের সাথে দাবা খেলার ঐতিহাসিক সংকট সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন, যেমন এডলফ এন্ডারসন ও জাঁ দুফ্রেস্নের মধ্যকার ক্লাসিক খেলাটির ৯ নং চালটি ঠিক ছিল কিনা।
তিন.
এইভাবে দক্ষিণখান গাওয়াইর বাজারে ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কি বিখ্যাত হয়ে উঠেন, এবং একপর্যায়ে গাওয়াইর বাজারের লোকজন বিশেষত দোকানদার, কাষ্টমার, পথচারী ও স্কুলবালকেরা তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে। ক্রমে ক্রমে তারা 'কাকা কি বিবাহ করছেন' 'বউ বাচ্চা কিরাম আছে' অথবা 'জিএফের খবর কি' ইত্যাদি প্রশ্ন করতে থাকে ।
ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কি অতিকৌশলে বিষয়টা এড়িয়ে যেতে যান; প্রশ্নকর্তারা বুঝতে পারে জীবনের এই ঘোর রহস্যময় অধ্যায়টি তিনি কাউকে জানাতে চান না। যদিও কৈশোরে দাবাবোর্ড বগলে নিয়ে ঘুরার সময়টাতে তিনি প্রথম এক কন্ঠশিল্পীর প্রেমে পড়েছিলেন । রেডিওতে সেই নারীর গান শুনতে শুনতে তিনি একবার কেঁদেও ফেলেছিলেন এই কথা একদিন কথাচ্ছলে ছামেদুলকে বলেন । তিনি ঐ নারীর ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠান কিন্তু দিন যায় বছর যায় কোন উত্তর না আসায় প্রেমে পড়েন একজন নৃত্যশিল্পীর। বিটিভির ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে সেই নৃত্যশিল্পীর নৃত্য দেখতে তিনমাইল হেঁটে দুরবর্তী গোবিন্দপুর গ্রামে গিয়েছিলেন যেখানে বিদ্যূৎ না থাকলেও ব্যাটারিতে টেলিভিশন চলে। তিনি ঐ নারীর ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠান কিন্তু যথারীতি দিন যায় বছর যায় কোন উত্তর না আসায় প্রেমে পড়েন একজন অভিনয়শিল্পীর। তিনি ঐ অভিনয়শিল্পী নারীর ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠান কিন্তু এইবার তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে দুই মাসের মাথায় চিঠির জবাব চলে আসে।
নারী অভিনয়শিল্পী ঐ চিঠিতে লিখেন যে তিনি প্রেম করতে রাজী কিন্তু শর্ত রাখেন যে, তাকে দাবাবোর্ড বগলে নিয়ে ঘুরা বন্ধ করতে হবে, এবং দাবা খেলা ছেড়ে দিতে হবে। উদীয়মান দাবা প্রতিভা ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কি এই ঘটনায় চোখে অন্ধকার দেখেন। একদিকে নারীর দুকুল ভাসানো প্রেমের হাতছানি আরেকদিকে চৌষট্টি খোপের বোর্ডের উপর বত্রিশটি ঘুটিঁর মায়াময় আনাগোনা। বস্তুত তার জীবনের প্রেমময় অধ্যায়টি গীতি, নৃত্য ও নাট্য এই তিনটি শিল্পের নিকট পরাজিত হয়ে চিরবিদায় নেয় ।
ফলে ভ্লাদিমির ঝেলঝৎভস্কি, যিনি একজন উদীয়মান দাবা প্রতিভা, যিনি পূর্বেও উদীয়মান ছিলেন, এবং যার জীবনে সর্বমোট তিনটি প্রেম এসেছিল যার মধ্যে অন্তত একটিতে সম্ভাবনা জাগ্রত হয়েছিল , তাকে বগলে দাবাবোর্ড নিয়ে দক্ষিণখান গাওয়াইর বাজারের অলিগলিতে আজও ঘুরতে দেখা যায় ।
ফেবুতে পড়েছিলাম... ভালো লেগেছিল... আপনার লেখার হাত ভালো... সাহিত্যগুণ বিশেষ বুঝিনা বিধায় বলা যাচ্ছেনা... মাগার আপনার লেখা পড়ে আমার পুষায় ????... ফেবু পোস্টে আপনার সারকাস্টিক টোন সেইরকম... আগে ওয়েলকাম জানানো হয় নাই..। এই বেলা এবি তে স্বাগতম জানায়ে গেলাম.. এবি তে কন্টিন্যু কইরেন ????
থ্যাংকু ৷ মাঝে মাঝে ঢু মারি ৷ পোস্ট দেখি কিন্তু কমেন্ট করা হয় না ৷ নিয়মিত হবার ইচ্ছা আছে ৷
বাহ
পুরানা লোকজন দেখা যায়
এই আরকি
সুন্দর লেখা।
কুঙ্ কি খবর ?
মন্তব্য করুন