উপনির্বাচনের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি
[ভোলার উপনির্বাচন দেখে হঠাৎ করেই ক্লাশ এইটে দেখা একটি উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে ইচ্ছে হল]
আহমেদ তফিজউদ্দিন পারিবারিকভাবে আমার দাদার সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন । ৭০ এর গণপরিষদে নির্বাচিত এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত হন ।
সুজানগর থানার পুরোটা আর বেড়া থানার দক্ষিণভাগের অর্ধাংশ নিয়ে পদ্মা তীরবর্তী জাতীয় সংসদের এই আসন । ১৯৯৮ সালের শেষদিকে আহমেদ তফিজউদ্দিনের মৃত্যুর ফলে এই আসনটি শূন্য হয়ে যায় ।
উপনির্বাচনে বিএনপি থেকে প্রার্থী হলে অ্যাডভোকেট একেএম সেলিম রেজা হাবিব । তার বিপক্ষে দাঁড়ালেন আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক একে খন্দকার । একে খন্দকার মূলত পাবনা-১ সদর আসনের অধিবাসী হলেও উপনির্বাচন করার জন্য পাবনা-২ আসনে তাঁকে মননোয়ন দেয়া হয় ।
সময়টা ভাল করে মনে নেই , ৯৭ এর নভেম্ভর কি ডিসেম্বর।বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে গ্রামে যাবার প্রস্তুতি নিলাম । গ্রামের উপনির্বাচন দেখব বলে ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করছিলাম ।
গ্রামে পৌছার পর প্রথম অনুভূতিটা ছিল ভীষণ বিস্ময়ের । পদ্মার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের উপর দিয়ে চলে যাওয়া পাকা সড়ক থেকে নেমে ঢাল বেয়ে গ্রামে প্রবেশ করছি , আর দু'চোখ দিয়ে খুঁজে চলেছি প্রার্থীদের পোস্টার । কিন্তু একে খন্দকার ছাড়া অন্য কোন প্রার্থী একটা পোস্টারও চোখে পড়ল না ।
কি ঘটছে , সেটা বুঝতে শুরু করলাম দুপুরের পর থেকে । আমার কাজিন তখন সাতবাড়িয়া কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র । কাজিনের সাথে করে দুপুরে গেলাম পাশের গোপালপুর গ্রামে , যাবার পথে পড়ল হেমরাজপুর গ্রাম । এই দু'টি গ্রামেও হাবিবের একটি পোস্টারও চোখে পড়ল না । ফেরার পথে কয়েকটি বাড়ির কুপিয়ে ঝাঁঝড়া করে ফেলা টিনের বেড়া চোখে পড়ল । কাজিন জানালো , এগুলো স্থানীয় বিএনপি নেতাদের বাড়ি । কোপানোর আগেই পরিবারসহ সমস্ত বিএনপি নেতারা গা ঢাকা দিয়েছে ।
বিকেলে গ্রামে ঢুকে বুঝলাম পরিস্থিতি থমথমে । আমাদের কুড়িপাড়া গ্রামে বিএনপি আওয়ামী লীগের শক্তি মোটামুটি ৪৫:৫৫ । কিন্তু গ্রামের বিএনপি ভাবাপন্ন ছোটখাটো গোছের সব নেতাই পালিয়ে ঢাকা চলে গেছেন । গ্রামের প্রতিটা মানুষই কোন না কোনভাবে একে অন্যের আত্মীয় । নিজের আত্মীয়ের প্রতি শুধু রাজনৈতিক কারণে এটা ক্রুদ্ধ হতে পারে , সেটা ভেবে অবাক হলাম।
অবাক হওয়ার তখনও ঢের বাকি । রাতে কাজিনের বন্ধুরা আসল , রাত ১১ টার পর থেকে এলাকার সমস্ত ছেলেকে নিয়ে গ্রামের চারপাশ পাহাড়া দিতে নাকি হবে , নয়ত বিএনপির লোকেরা গোপনে গ্রামে চলে আসতে পারে । সেটা না হয় মেনে নেয়া গেল , কিন্তু পাহাড়ার কাজে যা সরবরাহ করা হয়েছে , সেটা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম । অসংখ্য রামদা আর লাঠি আনা হয়েছে , যেগুলো নিয়ে রাতভর পাহাড়া চলবে বিশাল এলাকা জুড়ে । ভোররাতের দিকে আয়োজন করা হবে ভুড়ি ভোজের ।
আমাকেও বলা হল তাদের সাথে যেতে , অন্তত খাওয়া দাওয়াতে অ্যাটেন্ড করতে । ভাল ছাত্র মনে করত বলে , গ্রামের সবাই আমাকে বেশ খাতির যত্ন করত । হঠাৎ কেন যেন আমার মনটা এসব দেখে বিষিয়ে উঠল , তাদের বললাম , না ভাইয়া আমি যাবো না
আমাদের গ্রামটা সুজানগর থানার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের অন্তর্ভূক্ত । সাতবাড়িয়া যেতে মটরসাইকেলে বড় জোড় ৭/৮ মিনিট লাগে , যাবার পথে দু'টি গ্রাম । অবাক ব্যাপার হল গ্রাম দু'টির মাঝে প্রথমটির ৯৯ ভাগ লোক ঐতিহ্যগত ভাবে আওয়ামী লীগের সাপোর্টার । আর পরের গ্রামটির ৯৯ ভাগ লোক বিএনপি সমর্থক । বিএনপি সমর্থক গ্রামটির অবস্থান তারাবাড়িয়া এবং সাতবাড়িয়ার মাঝে । ততদিন সাতবাড়িয়াতে যে কজন বিএনপি মনা ছিলেন , তারাও প্রাণভয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন । মাঝের গ্রামটির সব মানুষ বিএনপি বলে , তারা চরম বিপর্যয়ের মাঝে পড়ে গেলেন । পুরো গ্রাম ছেড়ে যাওয়া সম্ভব না , অন্যদিক গ্রামের দু'পাশের দু' গ্রাম থেকে শুরু হল হামলার আশঙ্কা । সাতবাড়িয়া যাবার পথে গ্রামটি ক্রস করলাম , গ্রামের মানুষজন তখন গ্রামের মাঝে অবরুদ্ধ ।
সাতবাড়িয়া গিয়েছিলাম মন্ত্রীদের দেখতে । সেদিন বিকেলে এসেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোঃ নাসিম । নাসিম আসতেই , নাসিমকে ঘিরে তুমুল স্লোগান দিতে শুরু করল আওয়ামী লীগের কর্মীরা । একটা স্লোগান খুব বেশি করে কানে বাজে "একটা করে বিএনপি ধর , ধরে ধরে জবাই কর" । আমার ধারণা ছিল , নাসিম হয়ত কর্মীদের নিরস্ত করবেন , কিন্তু নিরস্ত করা দূরের কথা , নাসিম বক্তব্য শুরুই করলেন উপনির্বাচনে বিএনপি জোর-জুলুম করছে সে অভিযোগ দিয়ে । একই বিকেলে বিএনপির হয়ে সুজানগর এসেছিলেন খলনায়ক ওয়াসিমুল বারী রাজীব । সুজানগরে রাজীবকে লাঞ্চিত করা হল ।
সেরাতে খিচুরির পরিবর্তে বিরানী-মুরগীর মাংসের আয়োজন হবে জানিয়ে আমার কাজিনের বন্ধুরা দাওয়াত দিয়ে গেল । আমার চেয়ে সবাই বয়েসে ৩ বছর বড় বলে কিছু বলারও ছিল না । তবে একবার মনে হয়েছিল , রামদা , বল্লম নিয়ে রাতভর এলাকা পাহাড়া কেমন চলে দেখে আসি ।
পরের দিন সাতবাড়িয়ার জনসভার কথা ভুলবার নয় । প্রধান বক্তা ছিলেন পানিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক । সাতবাড়িয়ার অবস্থান পদ্মা নদীর ধারে , নদীর ঠিক ওপারেই রাজবাড়ীর পাংশা , সে সূত্রে বহু মানুষ আত্মীয়তার সম্পর্কে নিয়মিত পাংশা যাতায়াত করেন । রাজ্জাক বললেন "আপনাদের আর কষ্ট করে নদী পার হতে হবে না , আমি এখান দিয়ে ব্রীজ করে দেব , হেঁটেই চলে যেতে পারবেন" । মাত্র ১৪ বছর বয়সে এত বড় মিথ্যাচার শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম । সাতবাড়িয়া পয়েন্ট দিয়ে পদ্মা সেতু হওয়ার আগে পদ্মার উপর অন্তত ২০ টি সেতু নির্মিত হবে (উল্লেখ্য , পদ্মার উপর সবেধন নীলমনি মাওয়া সেতুর নির্মাণকাজও এখনও শুরু হয়নি) । তবে , সহজ সরল এলাকাবাসীর মাঝে এই ঘোষণা তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করল । মিটিং থেকে ফেরার পথে লক্ষ্য করলাম সবার মুখে মুখে এক কথা , "ব্রীজ দিয়ে হেঁটে পাংশা যাওয়া যাবে"।
নির্বাচনের ঠিক দু'দিন আগে আওয়ামী লীগের মহিলা এমপিদের একটি দল আসলেন । পুরো উপজেলা কাভার করে তারা তখন সাতবাড়িয়াতে এসেছেন । সবার সাথে কোরান শরীফ । ঘরে ঘরে প্রবেশ করলেন তারা , মহিলাদেরকে কোরান শরীফ ছুঁইয়ে শপথ করাতে লাগলেন যে তারা নৌকা ছাড়া কোথাও ভোট দেবে না ।
জাতীয় মিডিয়াতে তখনকার অবস্থা পুরোপুরি জানা ছিল না । গ্রামে কেবল মাত্র জনকন্ঠ , আর ভোরের কাগজ আসত । সেসব পত্রিকায় এলাকার এসব ঘটনার একটিও আসতে দেখিনি । তবে নাজিরগঞ্জ এলাকায় বিএনপি লুন্ঠন সন্ত্রাস করছে বলে খবর বেরিয়েছিল বলে মনে আছে । নির্বাচনের আগের দিন আরও বেশি কিছু বাড়িঘর তচনচ করা হল । হেমরাজপুরে আগে থেকেই তচনচ করে ফেলা দু'টি ঘর আওয়ামী লীগের কর্মীরা পুড়িয়ে দিল।
নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসল । বিশাল এলাকাজুড়ে বিএনপির একটি পোস্টার নেই , গ্রামগুলোতে বিএনপির সমস্ত নেতা পালিয়ে গেছেন , লুন্ঠন , জখম চলছে , এমন অবস্থায় শুরু হল ভোটগ্রহন ।
কুড়িপাড়া হাইস্কুল কেন্দ্রের সামনে গিয়ে সকালেই দাঁড়িয়ে গেলাম ভোটগ্রহন দেখতে । পুলিশ বিডিআর মোতায়েন ছিল , সেনাবাহিনীর কথা ঠিক করে মনে নেই । ভোটকেন্দ্রের আশে পাশে কোন বিএনপি পন্থীর দেখা মিলল না , তবে বিএনপির পোলিং এজেন্ট কেন্দ্রে আছে বলে জানলাম । পুলিশের পাশে বসেই "আলিম" নামের এক ব্যক্তি ভোটার লিস্ট নিয়ে সিরিয়াল ঠিক করছিলেন । ঢাকা সহ অন্যান্য অনেক শহরে বসবাসরত দের অনেকেই গ্রামে ভোটার হয়েছিলেন , তবে উপনির্বাচনে ভোট দিতে আসেননি । তাদের বিশাল তালিকা করা হল , কার ভোট কে দেবে , সেটা ওখানে বসেই বলে দেয়া হচ্ছিল । পরিচিত অনেককেই দেখলাম দায়িত্ব নিয়ে ৩/৪ টি করে ভোট দিয়ে আসছেন । অনেকগুলো মেয়ে ছিল মেয়েদের জাল ভোটগুলি দেয়ার জন্য । আলিম কাকা দুপুরের দিকে অদ্ভূত একটা আব্দার করে বসলেন "মেহরাব , একটা ভোট দিয়ে আসো" । বয়সে ছোট ছিলাম বলে ন্যায় অন্যায় বোধটা আরও তীব্র ছিল । ভোট দিতে অস্বীকার করলাম ।
ভোট চলাকালীন সময়েই বাঁশ হাতে বেশ কিছু ধাওয়ার ঘটনা ঘটল । বিএনপির কিছু চিহ্নিত পাতি নেতা ভোট দিতে এসেছেন , এই গুজব ছড়িয়ে গেলে , তাদের খুঁজে বের করতে আওয়ামী লীগের অল্প বয়েসীরা বেরিয়ে গেল । পুরো ব্যাপারটা ঘটছিল পুলিশ বিডিআর এর একদম সামনে ।
বিকেলের দিকে গেলাম কাদোয়া গ্রামে । সেখানে ততক্ষণে একজন মাস্টার্স করা ছাত্রলীগ নেতা ৬১ ভোট দিয়েছেন বলে গর্ব করছিলেন । এবার হঠাৎ করেই মুখ খুলে বলে ফেললাম "কি নির্লজ্জ চুরি চামারী" । সবাই আমার চেনা , আর বয়েসে আমি ছোট বলে কেউ বিশেষ মাইন্ড করল না । একজন হাসিমুখে বোঝালো "ঢালার চর" এ বিএনপি একই রকম চুরি করতে পারে , চান্স আছে , কাজেই ব্যালেন্স করতে হবে না ?
সন্ধ্যার পর পর কুড়িপাড়া হাইস্কুলের ফলাফল কেন্দ্রের সামনে ঘোষণা করা হল । নৌকা ১৩০০ , ধানের শীষ ৯০০ । এত কিছুর পরেও ধানের শীষে ৯০০ ভোট পড়েছে শুনে , অনেককে দিশেহারা হয়ে যেতে দেখলাম । উপলব্ধি করলাম , কোনভাবে বিএনপি জিতে গেলে বিরাট খুন খারাবি আসন্ন ।
আল্লাহর রহমতে ফলাফল ঠিকঠাক মতই হল , একে খন্দকার ৮০০০০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হলেন , সেলিম পেলেন ৬০০০০।
পরিশিষ্ট : সেলিম ২০০১ এ বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন , তবে তার সময়টায় সুজানগর আস্তাকুঁড়ে পরিণত হয় , এলাকার জন্য তিনি কিছুই করেননি । তবে উপনির্বাচনে বিজয়ী একে খন্দকার বহিরাগত হয়েও সে সময় বেশ কিছু কাজ করেছিলেন । এলাকায় তিনি খুব বেশি যদিও যাননি , ফলে ব্যক্তিগতভাবে তিনি আওয়ামী জোর জুলুমের সাথে সেভাবে সংশ্লিষ্ট নন বলেই আমার মনে হয়েছিল । ২০০৮ এ একে খন্দকার পুনরায় বিজয়ী হন
সময়টা ৯৭ কি ৯৮ সেটা ভাল করে স্মরণ করতে পারছি না । সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী
রাজনীতিকে কাছে থেকে দেখা হয় নাই। যতোবারই দেখছি, খারাপ লাগছে। সম্ভবত তলের পাতিদের দেখি বলেই...উপরে এখনো ভাল মানুষ আছে বিশ্বাস করি
একদম ঠিক কথা , বহু লোক বলে , এখনও নাকি অনেক ভালো মানুষ বাকি আছে । কিন্তু আমি তো দেখলাম না । বিএনপিও যে একদম ছেড়ে দিসে তা না , ২০০১ এর নির্বাচনের ফলাফলের পর তারাও ডলা দিয়েছিল , হয়ত শুধু ইনটেনসিটিটা একটু কম ছিল
আরও একটা ব্যাপার । শহরের পলিটিক্স বেশ পরিচ্ছন্, অন্তত মারামারি কাটাকাটি সেই অর্থে নেই। মফস্বল আর গ্রামের পলিটিক্স সিম্পলি নোংরামি
আবার বিএনপি সময়ের উপনির্বাচন দেখলে উল্টাটাই দেখতে পাবেন। কেউ কারো চেয়ে কম যায় না।
সেটাই !!
যে দলটি সবচেয়ে বেশি লম্ফঝম্প করে সেক্যুলারজিম নিয়ে , তারাই কিনা কোরান নিয়ে করল সবচেয়ে বড় ব্যবসা !! হিসাব মেলে না ...
আপনার পোস্টটি অন্য একটি ব্লগে একই সময়ে পোস্ট করেছেন বলে নীতিমালা অনুযায়ী আমরা বন্ধুর প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দেয়া হলো।
ঠিক আছে , নীতিমালাটা ঠিক জানা ছিল না । আপনার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান থাকল
কোনো দলই কারো চাইতে কম যায় না, সব শালাই হারামী।
সন্দেহ নাই
সময় এবং এলাকা অনুযায়ী চরিত্র বদলায় ... ঘটনা একি ঘটে...
আমরা জনগণও যেই বোকা সেই বোকাই রয়ে যাই !!
কতকিছু বদলে যায় , রাজনীতির মারপ্যাচ বদলায় না
মন্তব্য করুন