বাংলাদেশের আদিবাসি পরিস্থিতি
পাহাড়ে কিংবা সমতলে কোথায় আদিবাসীরা নিরাপদ নয়। রাজনৈতিক দুবৃত্বরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জোরে তাদের উ্চ্ছেদ করছে, তাদের বাপ-দাদার ভিটা দখল হয়ে যাচ্ছে। বড় পরিসরে মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হলে অধিকাংশ ঘটনাই সংবাদপত্রের পাতায় উঠে আসে না। অন লাইন সংবাদপত্র-ব্লগ আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আদিবাসীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সম্পাদকের সচেতন উপেক্ষায় লুকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা অমানবিকতার ইতিহাস প্রত্যক্ষ না করলেও একটি জনগোষ্ঠীর উপরে এর পরোক্ষ প্রভাব ঠিকই অনুভব করতে পারছি।
প্রথম প্রথম ঘটনাগুলো ক্ষুব্ধ করতো, এক ধরণের অপরাধবোধ তৈরি করতো, সরাসরি প্রতিরোধ করার অক্ষমতা আড়াল করতে অন্তত সরব প্রতিবাদের মানসিক তাড়না তৈরি হতো। আমরা যারা অপরাধবোধতাড়িত, আমরা যারা মনে করি রাষ্ট্রের নির্বিকার অমানবিকতার প্রতিবাদ হওয়া উচিত, আমরা যারা মনে করি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সকল নাগরিককে নিরাপত্তা প্রদান করা, রাজনীতিসচেতন মানুষেরা যাদুঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের অমানবিকতার নিন্দা জ্ঞাপন করি। রাষ্ট্রের চরিত্র সংশোধনের দাবী জানাই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনের অবহেলার সমালোচনা করি। রাষ্ট্রের মানসিকতা পরিবর্তিত হয় না। কয়েক দিন পরে পুনরায় রাষ্ট্রের প্রশাসনের উপস্থিতিতে আবার একই ধরণের অমানবিকতার চর্চা শুরু হয়।
গত ৪২ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে শুধুমাত্র পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর কতজন বিচার বহির্ভুত হত্যার শিকার হয়েছে? কতজন পাহাড়ী নারী নির্যাতিত হয়েছে? কতগুলো পাহাড়ী পরিবারের বসত ভিটায় আগুণ লাগানো হয়েছে? কতগুলো শিশুর শৈশব ধ্বংস হয়েছে? কতগুলো গ্রামে গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটেছে? পরিসংখ্যানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বিভিন্ন কেতায় সাজিয়ে, সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের গোচরে এনেও কি পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মানবিক অধিকার স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হয়েছে?
পাহাড়ের নির্যাতিত মানুষেরা উনমানুষে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদতে শতাধিক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বিমানবিকরণ ঘটেছে। প্রতিনিয়ত বর্বরতার মুখোমুখি হওয়া এইসব মানুষগুলো কখনও তাদের উপরে ঘটে যাওয়া অবিচারের ন্যায় বিচার পায় না। এসব ঘটনা মোটা দাগে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত নয়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি মানুষের অপরাধপ্রবনতা বৃদ্ধি করে। ধারাবাহিক অবিচারের শিকার মানুষ ধীরে ধীরে নির্যাতিত পরিচয় হারিয়ে ফেলে। সাধারণ মানুষ এসব বর্বরতায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। রাষ্ট্রের ক্রমাগত উপেক্ষায় মানুষ এসব বর্বরতায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।
অপরাধের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রয়োজন। আমাদের বিদ্যমান বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ গণ্য হলেও যেহেতু অপরাধের বয়ান লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব পুলিশের । পাহাড়ের স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন কোন কোন ঘটনাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করছে তার উপরে নির্ভর করে পাহাড়ী মানুষের উপরে যারা নির্যাতন করছে রাষ্ট্রের চোখে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে কি না। দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হলো পাহাড়ী মানুষের উপরে ঘটে যাওয়া অধিকাংশ নিপীড়নের ঘটনাই রাষ্ট্রের চোখে অপরাধ নয়। নির্যাতনে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদী মানুষ পুলিশের চোখে অপরাধী। তারা সংঘবদ্ধ হয়ে স্থানীয় পর্যায়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নথি ফাঁস করে আলোচিত উইকিলিকসের বাংলাদেশ অংশ ঘেঁটে দেখা যায় অধিকাংশ ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিতে বাংলাদেশের মার্কিন দুতাবাসের কর্মকর্তারা মূলত উচ্চতর প্রশিক্ষণে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাপ্রত্যাশী সামরিক কর্মকর্তাদের ভিসা দেওয়া হবে কি না এই সংক্রান্ত পরামর্শ চাইছে এবং অধিকাংশ সময়ই মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে " উল্লেখিত সামরিক কর্মকর্তা কোনো ধরণের মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার সাথে যুক্ত নয়।"
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে সেনাঘন অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেখানে মাথাপিছু সেনা সদস্যের পরিমাণ সবচেয়ে বেশী। এত এত সেনাসদস্যের উপস্থিতিতে ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘহনের ঘটনা ঘটছে, নির্যাতিত মানুষেরা জানাচ্ছে সেটলাররা আক্রমণের নেতৃত্বে থাকলেও তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে স্থানীয় বিজিবি এবং সেনা কর্মকর্তারা। কিন্তু এইসব সেনাকর্মকর্তা কখনও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন না।
পাহাড়ের বাস্তবতা হলো রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে নগদ সহযোগিতা দিয়ে পাহাড়ে সেটলার প্রতিপালন করা হচ্ছে, এই অভিবাসী মানুষেরা পাহাড়ীদের উপরে বিভিন্ন ধরণের নৃশংস নির্যাতন করছে, অধিকাংশ সময়ই রাষ্ট্র অস্ত্র চালানোয় প্রশিক্ষিত মানুষদের দিয়ে এইসব অভিবাসীদের নিরাপত্তা প্রদান করছে।
আমরা এমন একটা রাষ্ট্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম যেখানে মানুষের মর্যাদা থাকবে। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক তার রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে গর্বিত হবে। সাংস্কৃতিক ভিন্নতা থাকলেও তারা রাষ্ট্রের কাছে সমান মর্যাদা ও নিরাপত্তা পাবে। রাষ্ট্রের সকল সম্পদে তাদের সমান অধিকার জন্মাবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করবে না। আমাদের প্রত্যাশার রাষ্ট্র আমরা নির্মাণ করতে ব্যর্থ হয়েছি।
রাষ্ট্র নিছক একটি প্রতিষ্ঠান। একটি ক্ষুদ্র সার্বভৌম সীমানায় উপস্থিত সকল মানুষ এবং সকল সম্পদ যে নিয়ন্ত্রন করে। সেই প্রতিষ্ঠান তার সকল অংশের প্রতি সমান সহানুভুতিশীল হবে এমনটাই কাম্য ছিলো। বাস্তবে তেমনটা ঘটে নি। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন তারা বিভিন্ন ধরণের বৈষম্যমূলক পরিস্থিতি লালন পালন করেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে এক ধরণের স্থানীয় অরাজকতা তৈরি করে জনগণকে ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রন করতে চেয়েছেন। নাগরিককে ভীত-সন্ত্রস্ত রেখে তার আনুগত্য আদায় করে নেওয়ায় পারদর্শীতা অর্জন করেছেন তারা।
আমরা শাহবাগে দাঁড়াচ্ছি, রাষ্ট্রের সমালোচনা করছি কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তনে রাষ্ট্রকে বাধ্য করতে পারছি না। আমাদের সংঘবদ্ধতা রাষ্ট্রের বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোকে এমন কোনো ঝুঁকির মুখোমুখি করতে পারছে না যে রাষ্ট্র আমাদের সংঘবদ্ধতায় ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তার উদাসীনতার নীতি পরিবর্তনে বাধ্য হবে। বাংলাদেশের আদিবাসীরা যতবার অমানবিকতার মুখোমুখি হবে ততবার আমাদের দেশের উচ্চতর আদালতে প্রতিকার চাইতে হবে। প্রতিবারই স্থানীয় প্রশাসনকে তাদের নিস্ক্রিয়তার জবাবদিহি করতে বাধ্য করতে হবে। এটা প্রতিরোধের একটা প্রক্রিয়া।
যতদিন ঔপনিবেশিকতাচ্ছন্ন জনপ্রশাসণের মানসিকতা পরিবর্তিত না হয় তার আগ পর্যন্ত আদিবাসীবহুল সরকারী প্রশাসনিক অঞ্চলের সকল সরকারী কর্মকর্তা -কর্মচারীদের ৭০% আদিবাসী হতে হবে এমন একটা নীতি অনুসরণ করার নির্দেশনা দিতে হবে আদালতকে।
প্রশাসনের ভেতরে মানবিকতা তৈরি না হলে স্থানীয় জনগণের প্রতি সহানুভুতিশীল প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। পুলিশ প্রশাসনের সংস্কার করতে হবে এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের আওতা থেকে বের করে পুলিশ প্রশাসনকে বিচার বিভাগের দায়িত্বে নিয়ে আসতে হবে। অপরাধ সংজ্ঞায়ন এবং অপরাধ প্রতিরোধ এবং প্রতিকারের দায়িত্ব সরকারের একটি বিভাগের কতৃত্বে থাকাটা বাঞ্ছনীয়।
সবচেয়ে ভয়ানক বিষয় হল আমাদের নির্লিপ্ততা। ভারতের গুণ্ডে ছবির জন্য কিংবা স্টেডিয়ামে পাকি পতাকা দেখলে আমরা যতটা ক্ষুদ্ধ হই ততটাই নীরব থাকি আদিবাসীদের অত্যাচারের সময়।
আমাদের নির্লিপ্ততা বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। যখন ধারাবাহিক ভাবে এক ধরণের অপরাধ ঘটতে থাকে এবং যারা অপরাধ নিয়ন্ত্রনের কাজে জড়িত তারা সে অপরাধকে অস্বীকার করে বিচারহীনতা সংস্কৃতি চর্চা করে তখন সেসব অমানবিক ঘটনার অভিঘাত কমতে থাকে। আমরা নির্লিপ্ত কারণ আমাদের মনে হচ্ছে অনন্তকাল একই ধরণের ঘটনা ঘটতে থাকবে। আমাদের চাওয়া- না চাওয়ার উপরে এসব কোনোভাবেই নির্ভরশীল না।
দুর্ঘটনার সংবাদের ক্ষেত্রে যেমন আমরা মৃতের সংখ্যা দেখে পরের পৃষ্টার চলে যাই, আদিবাসী নির্যাতনের ঘটনাও এমন হয়ে যাচ্ছে।
আমরাই জাতি হিসাবে সবচেয়ে ভোঁতা। কারও দিকে আঙুল তুলছি না এ আমাকেই নির্দেশ করছি।
পাহাড় বা ভুমির কোনো আদিবাসীদের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন কিংবা নিদারুন যন্ত্রনাময় জীবন নিয়েই আমাদের শহুরে মধ্যবিত্তের স্পস্ট ধারনা নাই!
এটা একটা অদ্ভুত বিষয় যে, আমরা শহুরে সচেতন নাগরিক বলে যারা দাবি করি, যেমটি উপরে আরাফাত বলেছেন, তাদের বেশিরভাগের কাছেই এ নিপীড়নের ছবি স্পষ্ট নয়। আর নিপিড়নের বহুমাত্রিকতা চিন্তা করলে তো শিউরে উঠতে হবে। হঠাৎ হাঠাৎ যখন রক্তপাতের পর্যায়ে যায়, উচ্ছেদের পর্যায়ে যায়, তা তখন মূলমিডিয়ায় আসে। কিন্তু প্রান্তিকীকরণের সে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া জারি আছে, আনুষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিক দু’পর্যায়েই সেটি যেন কারোরই চোখে পড়ে না। বা পড়া উচিত নয় এমন বিষয়।
ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
মন্তব্য করুন