ইউজার লগইন

ভাদ্র বেলার গানঃ এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর...

গত বছরের শেষ বাদর বেলা আর ভরা ভাদর এর নৈসর্গিক রূপ দেখে, অনৃভব করে সমকাল পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলাম আত্ননুভুতি। শরতের সরোদও এ বছর সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তবে বিভাগীয় সম্পাদকের আকস্মিক অনুরোধের কারণে এবং সময়ের অভাবে গত বছরের লেখা থেকে কিছুটা চুরি(?) করে এ বছরের শরতের সরোদ সাজাতে হয়েছিল। পাঠক ও ব্লগারা, নিজের লেখা থেকে চুরিকে চুরি বলবেন কিনা জানি না। গত বছরের শারদীয় অনুভূতি আবার এখানে প্রকাশ করলাম--

‘এ সখি, হামারী দুঃখের নাহি ওর। এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর--শূন্য মন্দির মোর।।’--মধ্যযুগের মিথিলার কোকিল কবি, বিদ্যাপতির (1352? - 1448?) কবিতায় রাধার সুদীর্ঘ প্রতিক্ষাঃ বর্ষাকালের আষাঢ়-শ্রাবণ যায়, শরতের ভাদ্র আসে তবু কৃষ্ণের দেখা নেই, ছোঁয়া নেই; আছে শুধু, শারদীয় অনুভূতি। আমি বিদ্যাপতির কবিতার কৃষ্ণের রাধার মত দু’চোখের শ্রাবন ধারার ক্লান্তি শেষে ভাদ্রবেলায় হাহাকার হৃদয়ের শূন্য মন্দির নিয়ে অপেক্ষা করি আমার রাধার জন্য অথবা অনুভব করি, তার আগমন বার্তা। ধুপাগ্নি যাতনায় হৃদয় জ্বলে যায় তবুও এ শরৎ রূপসী আমার জীবনানন্দ হৃদয়ের আঙিনায় বসে আঁধারী কাশবনের জোনাকী আলোর মত শুধু স্বপ্ন দেখায়।
এমনি অপেক্ষা, ভাললাগা, না পাওয়ার কষ্ট--প্রতিটি মানুষের জীবনে এক বা একাধিক বার আসে। বর্ষার শ্রাবণ ধারায় যখন ঘর থেকে বের হওয়া যায় না; কাঁদামাটির মাখামাখিতে যখন নিজেকে সাজানো যায় না; তখন অপেক্ষায় থাকি কখন শরৎ আসবে। কাঁশফুলের ছবি, দূর্গা অথবা লক্ষীদেবীর আগমনে ডোল অথবা কাঁসারী ঘন্টার আওয়াজ, ভাদ্রবিলের শাপলার হাতছানি, মেঘমুক্ত নীলাকাশ--অপেক্ষায় থাকি আমি অধীর আগ্রহে, শরতের তারা ভরা রাত অথবা অন্য কারো জন্য।
শরৎ আসে। ভিজা দেহ মুছে যেন, রোদে আসে এ মন। প্রকৃতির শরৎকন্যা যেন হাসতে থাকে মিটিমিটি, বর্ষাসিক্ত দেহ তাকে লজ্জিত করে চোখ ঢেকেছিল মেঘের চাদরে। জলে ভরা মাঠ যেন, জেগে ওঠে নিজের উর্বর দেহ নিয়ে--হেমন্ত দেবতার কাছে নিজেকে অর্পণ করবে বলে। ডিঙ্গী চলে কলমীর গন্ধভরা সরু খালে-নদে-উপনদে-শাখায়-উপশাখায়। নিস্তরঙ্গ জলরাশি--দু’পাশে সারি সারি সাজানো কাশবাগান--নির্মল আকাশ--জলে নীল আকাশের ছবি। আকাশের নীলাভ নরম বুকে কখনও কখনও খন্ড খন্ড কিছু মেঘ পাহাড় অথবা শাখামৃগের মত মনে হয়। সন্ধ্যায় জোনাকীর নিভু নিভু প্রদীপ--ঝিঁ ঝিঁ পোকার অবিরাম ডেকে চলা--ছলাৎ করে জেগে ওঠা দু’একটা জলঢেউ যেন, হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মনে হয়, কে যেন নেই; অথবা কে যেন আসছে অথবা আসবে। সৌখিন মাঝি, সৌখিন জেলে অথবা বিকালটুকুর সৌন্দর্য ভাগ করে নেওয়া অতিথি মানুষগুলো অথবা শেষ বিকালের ঘরে ফেরা পাখিরা জলপোকা মুখে নিয়ে উপভোগ করে জলডাঙ্গার জলবেষ্টিত দোয়াল্লীর চরের প্রকৃতি। জলাঙ্গীর স্নিগ্ধ ভেজা বাংলার লালিমা মাখা গোধূলীবেলায় বলাকারা সারা দিনের কর্মক্লান্তি নিয়ে নীড়ে ফিরে যায়। আঁধার নামে ধীরে ধীরে, দিগন্তে ঘুমাতে যায় ক্লান্ত সূর্য। বাঁকা চাঁদ সূর্যের আলো ধার করে রাখে দিনের বেলা; রাতে জোৎস্ন্ায় ভরে দেয় জল আর কাঁশফুলে ঘেরা মাঠ, ঘাট আর গল্পে ভরা আঙিনা। রাতে লক্ষ্মীপেঁচা ডাকে শিমুলের ডালে অথবা নিমপেঁচা বসে থাকে নিমডালে।

শরতের সকালে পাখির কুজনে গতদিনের মত আবার শরৎ কন্যার সৌন্দর্যে ডুবে থাকি আমি। কি যেন চাই; বয়স যে কুঁড়ি। এত ক্ষুধা, এত হৃদয় দৃষ্টি কেন জাগে এ বয়সে! কেন ‘তুমি’ এলে, হৃদয় দৃষ্টি চোখের দৃষ্টিকে ছাপিয়ে যায় এ শরতে--আমি জানি না। ইচ্ছে করে বিল-ঝিল-হাওর-বাওর থেকে সব শাপলা তুলে এনে ঢেকে দেই তোমাকে। কবে যে দেবীর আসন সাজিয়ে বসেছ অথবা বসায়েছি আমি তোমাকে এ হৃদয়ে।
মায়ের বকুনি খেয়ে শরতের রাতে অন্য পাড়ার দিদিমার কাছে শুনি পুরনো শরতের গল্প। তোমাকে নিয়ে হারিয়ে যাই গল্প শুনতে শুনতে। ইচ্ছে করে, শেয়াকুল কাঁটার আঘাত সয়ে; উলুখড়ের সাদা ফুলে সাজিয়ে; তোমাকে নিয়ে হারিয়ে যাই কোন সন্ধ্যায়। কলমি, গাঁদামনি, বৌ-টুনটুনি, পুনর্বা, ক্ষুদে ননী, গোয়ালনটে, সাদানটে কতনা বীরৎ, লতাগুল্মের ছড়াছড়ি এ শরতে। চোখের সামনে সোঁদালী গাছের চারাগুলি বনঝোপে ছেয়ে যায়। ইচ্ছে করে, প্রিয়াকে সাজাই আশ্মিনের কুমুদফুল অথবা বনসিমফুলের বেগুনী রং দিয়ে, কেমন লাগবে? মনে পড়ে, গত শরতে আমি বনঝোপে ডুবে গেলেও সাপ, ব্যাঙ আর পোকামাকড়ের ভয়ে মরাকদমের ফুলের উপর দাঁড়িয়ে তুমি ভয়ে আঁতকে উঠেছিলে, আমারি জন্য অথবা শারদীয় প্রেমের টানে।
ডিঙ্গী বৈঠার ভালবাসায় নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ গান; সেই গানগুলিকে হঠাৎ করে যখন ভাওয়াইয়া অথবা ভাটিয়ালি সুর ঢেকে দিয়ে যায়--মন ছুটে যায় সাদা মেঘের ভেলায়। সেখান থেকে দেখতে ইচ্ছে হয়, কে তুমি মাঝি, গেয়ে যাও শরতের গান ভাটিয়ালী অথবা ভাওয়াইয়া সুরে? দেখতে মন চায়, কেমন করে গাঙচিল, শকুন আর শালিকেরা শিকার করে ছোট ছোট মাছ কালীদহ অথবা ধলেশ্বরী নদীর জলে।
মায়ের কানমলা খেয়ে হঠাৎ তন্দ্রা জাগে। ভাদ্রের শালুক-শাপলা দিয়ে রান্না তরকারী, রাঁঙ্গা আলুর শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক--কতনা সবজির সমাহার অথবা বকফুলের বড়া! আহ! কলমি শাক দিয়ে রান্না ছোট চিংড়ীর চচ্চরী অথবা বিল-ঝিল-বাওর-হাওর এর হিজল, করচ, শুল্লী, বলুয়া, বনতুসী, নলখাগড়া জলডোবা গাছ-গাছালীর বাঁকে বাঁকে ডিঙ্গী ভিড়িয়ে জাল, বরশী, টেঁটা অথবা লুঙ্গি-গামছা দিয়ে ধরে আনা আইর, মাগুর, বাইম, টেংরা, বউজ্জা, সিং, কই, পুটি, গুতুম, গুলশা, কাকিয়া, বেতি, তিতনা ইত্যাদি মাছের ঝোলে মায়ের বকুনি অথবা কানমলার স্বাদ যেন হারিয়ে যায়। শরতের মাঠে মাঠে কৃষকের ব্যস্ততা। রোপিত ফসলের কচি ডগা দেখে মন জুড়িয়ে যায়। আগাছা জেড়ে ফেলে নতুন উদ্দোমে জাগে সময়। বেলা বাড়ে, পাখির কলকাকলী, ভিনদেশী অতিথি কৃষকের বাঁশীর হৃদয় টানা সুর--চোখ বন্ধ হয়ে এ মন যেন অজানা প্রজাপতির দেশে হারিয়ে যায়। হাঁটুজলে নেমে ধঞ্চে অথবা শোলা ঘাস কাটা; আশ্মিনের শেষে ক্ষেতের আইল উঁচু করে পানি সেচে মাছ ধরা; পায়ের ছাপে ছাপে পানি শুকিয়ে যায়, আগাছা গজে উঠে ফসলের আগে। দক্ষিণা বাতাসের ছোঁয়ায় চোখ বুজে শুধু স্বপ্ন দেখে বেড়ায় এ মন। নরম ঘাসের বুকে, মৃদু ঠান্ডা জলে, কাঁশফুলের সাদা রংয়ে, ভোরের ফসলের স্তন্যের বোঁটায়--যেখান থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় শিশির ঝয়ে পড়ে--প্রিয়াকে পাওয়া যায় আত্মঅনুভুতিতে, এ রকম প্রকৃতিতে।

ভাদ্রের শাশ্বত ভালোবাসা, আশ্মিনে টুইটুম্বুর হয়ে উঠে। আমি বিস্মৃত হই বিশ্বামিত্রের কর্মে! হে দেবতা! কিভাবে তুমি ভরিয়ে দিয়েছ আমার অনুভূতির সমুদ্রকে; কিভাবে শরৎকালকে সাজিয়েছ নিপূণ হাতে; কি ভাবে রাঙিয়েছ আমার এ বয়সটাকে!

পোস্টটি ৩ জন ব্লগার পছন্দ করেছেন

তানবীরা's picture


ভাল লাগলো

সত্যজিৎ দাশ 's picture


আপনার বর্ননা ভাল কিন্তু অতি মাত্রায় কাবি্যক হওয়ায় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে যায়।

বিষণ্ণ বাউন্ডুলে's picture


ভাল লাগলো।

সাথেই আছি, নিয়মিত লিখতে থাকুন। ভাল থাকুন।

মন্তব্য করুন

(আপনার প্রদান কৃত তথ্য কখনোই প্রকাশ করা হবেনা অথবা অন্য কোন মাধ্যমে শেয়ার করা হবেনা।)
ইমোটিকন
:):D:bigsmile:;):p:O:|:(:~:((8):steve:J):glasses::party::love:
  • Web page addresses and e-mail addresses turn into links automatically.
  • Allowed HTML tags: <a> <em> <strong> <cite> <code> <ul> <ol> <li> <dl> <dt> <dd> <img> <b> <u> <i> <br /> <p> <blockquote>
  • Lines and paragraphs break automatically.
  • Textual smileys will be replaced with graphical ones.

পোস্ট সাজাতে বাড়তি সুবিধাদি - ফর্মেটিং অপশন।

CAPTCHA
This question is for testing whether you are a human visitor and to prevent automated spam submissions.

বন্ধুর কথা

শাশ্বত স্বপন's picture

নিজের সম্পর্কে

বাংলা সাহিত্য আমার খুব ভাল লাগে। আমি এখানে লেখতে চাই।