সাংবাদিক বনাম সাংবাদিকতা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রীক অভিজ্ঞতার কাটা ছেড়া
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তির পর প্রথম মাথায় এলো পত্রিকা বের করতে হবে। কি করা যায়, কিভাবে করা যায় ভাবতে ভাবতে সাজদার ভাইয়ের চায়ের দোকানের চা খেতে খেতে কখন যে বাকির খাতায় নাম উঠে গেছে টের পাইনি। যখন টের পেলাম তখনও সিদ্ধান্ত হয় নি। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো প্রথম বর্ষ থেকে একটি লিটলম্যাগ সাইজে ফটোকপির পত্রিকা বেরুবে। স্যারদের সাথে আলাপ হলো। অনেকে উৎসাহ দিলেন। একজন বললেন, মফস্বল থেকে এসেছো তো, এখনো মাথা ঠিক হয় নি। এরকম অনেক সিদ্ধান্ত নাকি ফিবছরই হয়। দুয়েকটা সংখ্যা বের হয়, তারপর বন্ধও হয়ে যায়। আর এধরনের ‘ফালতু ’ কাজে ডিপার্টমেন্টের নাম উল্লেখ করা যাবে না। পরের সংখ্যাই তিনিই অবশ্য একপাতার একটি বাণি দিয়েছিলেন।
এক বিকেলে আমরা কয়েকজন গ্রুপ ছবিও তুলে আসলাম। পত্রিকার নামের সাথে মিল রেখে ছবির গ্রুপের নামও রাখা হলো ‘ঠাঁই পরিবার’। প্রায় একমাসের রাতজাগা, পরিশ্রম আর চেষ্টার পর বের হলো দ্বি-মাসিক ঠাঁই এর প্রথম সংখ্যা। আমরা খুব কাছ থেকে যারা এই ‘ফালতু’ কাজের সাথে জড়িত ছিলাম এখন তারা প্রায় ওই ধরনের কাজের সাথেই জড়িত আছি। একজন একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সবচে ভালো রিপোর্টারদের ভেতর একজন। আরেকজন দেশের অন্যতম সেরা এ্যাডফার্মের ডিজাইনার। একজন দেশের সবচে সম্ভাবনাময় অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টারদের একজন। বাকিরাও করে কর্মে খাচ্ছি।
এতসব গালগল্প অবতারণা নিশ্চয় অহেতুক মনে হচ্ছে। হেতুটা বললে তার মনে হবে না। আমরা যখন পত্রিকা বের করেছিলাম , ২০০৩ সালে, তখন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা করেন না। ঢাকায় যারা সাংবাদিকতা করতেন তাদের সাথে ডিপার্টমেন্টের প্রায় যোগাযোগ ছিলোনা বলেই জানতাম।
আটবছর পর, ২০১১ তে এসে খোঁজ নিয়ে জানলাম , এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ জনের বেশি সাংবাদিক গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষার্থী। জাতীয় পর্যায়ে টেলিভিশন আর পত্রিকায়ও এই সংখ্যা এখন চোখে পড়ার মত। এসব হিসেব কষার পর ভালোই লাগছিলো। তবে খারাপ লাগাটা শুরু হলো সময় টেলিভিশনের তুষার আব্দুল্লাহ’র ব্লগের একটি লেখা পড়ে। মিডিয়ায় শ্রমিক যোগান দেবে কে? শীর্ষক লেখায় তিনি এক আলোচনা সভার রেফারেন্স দিয়ে বলেছেন
‘‘সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে নিশ্চিন্তে কাজ দেয়া যাচ্ছেনা। বলা যায় অন্যান্য সাধারন বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীর সংগে এই বিশেষায়িত বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা করা যাচ্ছেনা। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তারা পিছিয়েও পড়ছে।’’
এধরণের মন্তব্যের পেছনের দৃশ্যটা একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মত নয়। হালে দেশে মিডিয়ার ব্যাপক প্রসারের ফলে, বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার প্রসারের ফলে সাংবাদিকতা এখন সবচেয়ে ‘গ্লামারিয়াস’ জব। তাই সবখানেই এখন প্রতিযোগিতা সাংবাদিক হবার। কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই গত কয়েক বছরে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সাংবাদিকের সংখ্যাও বেড়েছে কয়েকগুন। পত্রিকার চেয়ে সাংবাদিক বেশি হবার কারণে অনেকে এখন নাকি শিক্ষানবীশ পরিচয়েও সাংবাদিকতা করে যাচ্ছেন।
ফিরে আসি তুষার আব্দুল্লাহ’র কথায়। তিনি সাংবাদিকতা বিভাগের ‘সাংবাদিকদের’ যে অবস্থার কথা বলেছেন তার সাথে এই প্রতিযোগিতার একটি নিগুঢ় সংযোগ রয়েছে। এখন সবাই আসেন সাংবাদিক হবার জন্য, সাংবাদিকতা শিখতে, জানতে আসা লোকের সংখ্যা খুবই কম। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতার যে পরম্পরা ছিলো তা আজ বিচ্ছিন্ন। এখন শেখানোর লোকও নেই, আর শেখার লোকের তো আরও আকাল। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা এখন ‘সুর্যমুখী’, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির নোংরামীর শিকার, পচ-গলা দুর্গন্ধযুক্ত অবশিষ্টাংশ মাত্র। এখন নিউজ মানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি। এর বাইরে ছোটখাটো কিছু অনুষ্ঠানের কাভারেজ ছাড়া আর কিছু নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা করার কারণে এখনও টুকটাক খোঁজখবর রাখি। প্রায়ই কথাবার্তা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনকার ‘সাংবাদিকদের’ সাথে। তাদের কাঝ থেকেই খ¦র পেলাম নতুন এক ধরনের সাংবাদিকতা। এর নাম ‘সিসি’ (ঈঈ) সাংবাদিকতা। ইমেইলের সিসি অপশনের মাধ্যমে একজন নিউজ তৈরি করেন। আর বাকিরা নাকি ‘ক্রেডিট’ পাল্টে নিজের নিজের পত্রিকাতে পাঠান। ঢাকার কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোন খবর একটু মিলিয়ে দেখলেই আপনিও এই নতুন ঘরানার সাংবাদিকতার পরিচয় পাবেন।
এসব কান্ডকীর্তি সাংবাদিকতায় বিশেষায়িত শিক্ষার্থীদের যারা মোটামুটি একাডেমিক এবং বাস্ত অভিজ্ঞতার আলোকে আগামী দিনের সাংবাদিকতায় যাচ্ছেন তাদের। তাহলে যারা কেবল ক্লাসিক্যাল আমলে তৈরি কারিকুলামের একাডেমিক জ্ঞান নিয়ে সাংবাদিকতায় যান তাদের অবস্থাটা কতটা ভালো আশা করা যায়?
দূর্ভাগ্যজনক
আপনার কাছ থেকে আরো জানতে চাই এ ব্যাপারে
মন্তব্য করুন