এপ্রিলের এক সুন্দর সকালে ১০০% নিঁখুত মেয়েটাকে দেখে
{অনেক আগে তেলাপোকার ঠ্যাং মার্কা একটা অনুবাদ করছিলাম মুরাকামির একটা গল্পের। চারদিকে অনুবাদের ঢল দেইখা ঐটা পোস্টায় দিলাম এইখানে। অনুবাদটা মোটেও সুবিধার না, মুরাকামির একটা ক্যাযুয়াল টোন আছে, ঐটা আনতে গিয়া কেমন জানি উদ্ভট কইরা ফেলছি, তারপর জায়গায় জায়গায় টিপিকাল অনুবাদ অনুবাদ ব্যাপারটা আছে। এইসব কারনে যদি পড়তে না পারেন তাইলে গল্পটার ইংরেজী অনুবাদটা (হারুকি মুরাকামি জ্যাপানিজে লিখে) প্লিজ পইড়েন, অনেক অনেক সুন্দর একটা গল্প এইটা।}
-----------------------
এপ্রিলের এক সুন্দর সকালে, টোকিওর কেতাদুরস্ত হারুজুকু এলাকার এক গলিতে আমি ১০০% নিঁখুত মেয়েটার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম।
সত্যি কথা বলতে কি, মেয়েটা খুব একটা সুন্দর না। কোনভাবেই তাকে আলাদা করে দেখার কিছু নেই। তার পোশাক-ও তেমন বিশেষ কিছু না। এলোমেলো ঘুমের কারণে চুলের পিছন দিকটা এখনো বাঁকা হয়ে আছে। বয়সটাও নেহাত কমনা, কমপক্ষে ত্রিশের কাছাকাছি হবে, 'মেয়ে'-ও আসলে ঠিক বলা যায়না তাকে। কিন্তু তাও, ৫০ গজ দূর থেকেই আমি বলে দিতে পারি, সে-ই আমার জন্য ১০০% নিঁখুত মেয়ে। তাকে দেখার সাথে সাথেই আমার বুকের ভেতরটা গম গম করে উঠলো, মুখটা শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেল।
হয়ত মেয়েদের ব্যাপারে তোমার নিজের বিশেষ কোনো পছন্দ আছে, - ধরো সরু গোড়ালির কেউ, অথবা বড় চোখ, পেলব আঙ্গুলের কেউ, অথবা হয়ত তুমি কোনো কারণ ছাড়াই সেই ধরনের মেয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করো যারা অনেক সময় নিয়ে খেতে পছন্দ করে। অবশ্যই আমার নিজেরও কিছু পছন্দ আছে। মাঝে মাঝে হঠাত খেয়াল করি যে আমি পাশের টেবিলের মেয়েটার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছি, কারণ তার নাকের গড়নটা আমার পছন্দ।
কিন্তু কেউ জোর দিয়ে এটা বলতে পারবেনা যে তার ১০০% নিঁখুত মেয়ে তার পূর্বকল্পনার মতই হবে। নাক আমি যতই পছন্দ করিনা কেন, তার নাকের কোনকিছুই আমি মনে করতে পারিনা, এমনকি তার নাক আদৌ ছিল কিনা তাও। তার সম্পর্কে যতটুকু মনে করতে পারি তা হলো সে খুব একটা সুন্দর ছিলনা, অদ্ভূত!
''গতকাল রাস্তায় আমি ১০০% মেয়েটাকে দেখলাম'', একজনকে বললাম।
''তাই?'' সে বলল, ''অনেক সুন্দর?''
''না ঠিক সেটা না।''
''তোমার প্রিয় ধাঁচের তাহলে?''
''ঠিক জানিনা। আমি আসলে কিছুই মনে করতে পারছিনা তার সম্পর্কে - তার চোখের আকার, তার বুকের গড়ন।''
''আজব!''
''হুমম, আজব।''
''আচ্ছা যাই হোক'', ইতোমধ্যেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে সে, ''কি করলে তুমি? কথা বললে? পিছু নিলে?''
''নাহ, কেবল তাকে পার হয়ে চলে এলাম''
সে যাচ্ছিল পূব থেকে পশ্চিমে, আমি পশ্চিম থেকে পূবে। এপ্রিলের খুব সুন্দর একটা সকালে।
কথা বলতে পারলে ভালো হত। আধঘন্টাই যথেষ্ট, তার কথা জানতে চাইতাম, আমার সম্পর্কে বলতাম, আর - যেটা আসলেই করতে ইচ্ছা করছে - তাকে বোঝাতাম কত জটিল হিসাবনিকাশ করে ভাগ্য আজ আমাদেরকে হারাজুকুর এই গলিতে, ১৯৮১-র এপ্রিলের এই সুন্দর সকালে একসাথে এনে ফেলেছে। অতিপ্রাচিনকালে যখন পৃথিবীতে শুধুই শান্তি ছিল, তখনকার তৈরী হওয়া একটা ঘড়ির মতই রহস্যে ঠাঁসা একটা ঘটনা এটা।
কথাবার্তার পর আমরা কোথাও খেতে যেতাম, হয়ত একটা উডি এলেন এর মুভি দেখতাম, কোনো একটা হোটেল বারে থামতাম ককটেলের জন্য। ভাগ্য ভালো হলে হয়তো দিনটা শেষ হত বিছানায়।
সম্ভাবনা আমার হৃদয়ের দরজায় কড়া নাড়ে।
আমাদের মাঝে এখন দুরত্ব কমে ১৫ গজ।
কেমন করে তার কাছে যাই? কি বলি তাকে?
''গুড মর্নিং, আপনার কাছে কি আধঘন্টা সময় হবে কথা বলার জন্য?''
হাস্যকর। ইন্স্যুরেন্স সেলসম্যানের মত শোনাবে একদম।
''এক্সকিউজ মি, আপনি কি বলতে পারবেন এইদিকে সারারাত খোলা থাকে এমন ক্লিনার্স আছে কিনা?''
উহু, এটাও একইরকম হাস্যকর। আর আমার হাতে কোনো কাপড়-ও নেই। এইরকম একটা কথা কে বিশ্বাস করবে?
হয়ত সত্যি কথাটাই বলা উচিত। ''গুড মর্নিং, তুমি হচ্ছ আমার জন্য ১০০% নিঁখুত মেয়ে।''
না, সে এটা বিশ্বাস করবেনা। অথবা যদি করেও, সে আমার সাথে কথা বলতে নাও চাইতে পারে। দুঃখিত, সে বলবে, হয়ত আমি তোমার জন্য ১০০% নিঁখুত মেয়ে, কিন্তু তুমি আমার জন্য ১০০% নিঁখুত ছেলে নও। এটা হতে পারে। আর যদি এরকম একটা অবস্থায় পড়ি, আমি মনে হয় ভেঙ্গে একেবারে গুড়িয়ে যাব। এই ধাক্কা কখনই সামলে উঠতে পারবনা। আমি ৩২, আর বড় হওয়া আসলে এটাই।
আমরা একটা ফুলের দোকানের সামনে এসে মুখোমুখি হই। একটা মৃদু, উষ্ণ বাতাস আমার শরীর ছুঁয়ে যায়। পিচঢালা পথটা কেমন ভেজা ভেজা, আর আমার নাকে এসে লাগে গোলাপের গন্ধ। নিজেকে দিয়ে কথা বলাতে পারলাম না তার সাথে। তার পরনে ছিল একটা সাদা সোয়েটার, আর ডান হাতে ছিল একটা ধবধবে সাদা খাম, স্ট্যাম্পটাই শুধুমাত্র নেই। আচ্ছা, কাউকে চিঠি লিখেছে সে, হয়ত সারারাত জেগে জেগে, তার ঘুম ঘুম চোখ দেখেও তাই মনে হচ্ছে। তার সারাজীবনের সমস্ত গোপন কথা হয়ত এই খামটাতে বন্দী।
আমি আরো কিছুদুর এগিয়ে গিয়ে ফিরে তাকালাম, ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গ্যাছে সে।
অবশ্যই এখন আমি একদম ঠিকঠাক জানি আমার তাকে কি বলা দরকার ছিল। বিরাট বক্তৃতা হয়ে যেত অবশ্য, এতই বড় যে আমি হয়ত পুরোটা ঠিকঠাক বলেও উঠতে পারতাম না। আমার পরিকল্পনাগুলো কখনোই খুব একটা বাস্তবসম্মত হয়না।
যাই হোক। কথার শুরুটা হত 'অনেক অনেক দিন আগে' এই কথা দিয়ে আর শেষ করতাম এটা বলে, 'কি মন খারাপ করা গল্প, তাইনা?'
অনেক অনেক দিন আগে কোনো এক জায়গায় একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ছিল। ছেলেটার বয়স ছিল আঠারো, আর মেয়েটার ষোলো। ছেলেটাও অসাধারণ কোনো সুন্দর ছিলনা, মেয়েটাও ছিলনা বিশেষ কোনো সুন্দরী। অন্য সবার মতই তারা ছিল খুব সাধারণ একটা একলা ছেলে, আর খুব সাধারণ একটা একলা মেয়ে। কিন্তু তাদের দুজনেরই বিশ্বাস ছিল যে কোথাও না কোথাও তাদের জন্য ১০০% নিঁখুত একটা ছেলে, আর ১০০% নিঁখুত একটা মেয়ে আছে। হ্যা, তারা অলৌকিকে বিশ্বাস করত। আর সেই অলৌকিক ঘটনাটা একদিন ঘটেও গেল।
একদিন তাদের দুজনের দেখা হলো একটা রাস্তার কোণে।
'কি আশ্চর্য!' ছেলেটা বলল, 'আমি তো সারাজীবন তোমাকে খুঁজেছি। তোমার হয়ত বিশ্বাস হবেনা, কিন্তু তুমি আমার জন্য ১০০% নিঁখুত মেয়ে।'
'আর তুমি', বলল মেয়েটা, 'আমার জন্য ১০০% নিঁখুত ছেলে, ঠিক যেরকমটা আমি কল্পনা করেছিলাম, তুমি পুরোপুরি তাই। একেবারে স্বপ্নের মত ব্যাপার।'
তারা একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসলো, হাত রাখল হাতে, আর দুজন দুজনকে নিজেদের গল্প শোনালো সারাদিন ধরে। তারা আর একলা নেই এখন। তারা খুঁজে পেয়েছে, এবং খুঁজে নিয়েছে তাদের জন্য ১০০% নিঁখুত অন্যজনকে। নিজের জন্য ১০০% নিঁখুত মানুষটাকে খুঁজে পাওয়া, অথবা খুঁজে নেয়াটা অপূর্ব একটা ব্যাপার। এটা একটা অলৌকিক ঘটনা, একটা মহাজাগতিক অলৌকিক ঘটনা।
কিন্তু কথা বলতে বলতেই তাদের মনে ছোট্ট, খুব ছোট্ট একটা সন্দেহ দানা বেঁধে উঠতে লাগলো: স্বপ্ন কি এত সহজে সত্যি হতে পারে?
কথাবার্তার এক মুহুর্তের বিরতি এলে ছেলেটা তাই বলল, 'চল শুধু একবারের জন্য আমরা একটা পরীক্ষা করি। আমরা যদি আসলেই আমাদের দুজনের জন্য ১০০% নিঁখুত হই, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের কোথাও না কোথাও, অন্য কোনো এক সময়ে আবার দেখা হবে। আর যখন সেটা হবে তখন তো আমরা নিশ্চিত হয়ে যাব যে আমরা দুজনের জন্য ১০০% নিঁখুত মানুষ, আমরা ঠিক সেদিন-ই সেখানেই বিয়ে করে ফেলবো। কি বল?'
'হ্যা', মেয়েটা বলল, 'আমাদের এটাই করা উচিত।'
তারা বিদায় নিল, মেয়েটা গেল পূবে, ছেলেটা পশ্চিমে।
এইযে পরীক্ষাটা করতে তারা রাজি হলো, এটা পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় ছিল। এটা তাদের একেবারেই ঠিক হয়নি কারণ সত্যিকারেই তারা একজন আরেকজনের জন্য ১০০% নিঁখুত ছিল, আর তাদের দেখা হওয়াটাই ছিল দৈব একটা ব্যাপার। কিন্তু তারা ছিল কমবয়েসী, তাই এই কথা বোঝা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। ভাগ্যের শীতল, নির্লিপ্ত ঢেউ এগিয়ে এলো তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে।
এক শীতে, ছেলেটা আর মেয়েটা দুজনেই সেই ঋতুর ভয়ানক ইনফ্লুএনজাতে পড়ল, কয়েক সপ্তাহ জীবন মৃত্যুর মাঝামাঝি থেকে পুরনো বছরগুলোর সমস্ত স্মৃতি তারা হারিয়ে ফেলল। যখন তারা জেগে উঠলো, তাদের মাথা একদম ডি এইচ লরেন্স এর পিগি ব্যাঙ্কের মতই খালি।
কিন্তু তাদের বয়স ছিল অল্প আর ছিল প্রবল আত্মবিশ্বাস, অক্লান্ত পরিশ্রম করে সমাজের পূর্ণ সদস্য হবার জন্য যেইসব জ্ঞান আর অনুভূতি দরকার তা আবার তারা অর্জন করে ফেলল। সুযোগ্য নাগরিকে পরিনত হলো যারা জানে কিভাবে সাবওয়েতে লাইন পাল্টাতে হয়, কিংবা কিভাবে স্পেশাল ডেলিভারি চিঠি ঠিকঠাক মতন পোস্ট অফিস-এ পাঠাতে হয়। তারা এমনকি প্রেমেও পড়ল , কখনো কখনো ৭৫% প্রেম এমনকি মাঝে মাঝে ৮৫% পর্যন্ত।
সময় চলে গেল খুব তাড়াতাড়ি, আর খুব শিগগিরই ছেলেটার বয়স হলো ৩২, আর মেয়েটার ৩০।
এক সুন্দর এপ্রিলের সকালে, ছেলেটা দিনের শুরুর কফিটার খোঁজে পশ্চিম থেকে পূবে যাচ্ছিল, আর মেয়েটা একটা স্পেশাল ডেলিভারি চিঠি পাঠাবার উদ্দেশ্যে হাঁটছিল পূব থেকে পশ্চিমে, টোকিও-র হারাজুকু এলাকার একটা সরু গলি ধরে। তারা একে অপরকে পার হয়ে গেল গলির ঠিক মাঝামাঝি জায়গাটায়। সেই হারানো স্মৃতির একটুক আভা ছোট্ট একটা সময়ের জন্য জ্বলে উঠলো তাদের মনে। দুজনের হৃদয়-ই দুরু দুরু। এবং তারা জানত:
এই আমার জন্য ১০০% নিঁখুত মেয়ে।
এই আমার জন্য ১০০% নিঁখুত ছেলে।
কিন্তু স্মৃতির সেই আলোটা ছিল খুবই ক্ষীন, আর তাদের চিন্তাও ১৫ বছর আগেকার মত অত স্পষ্ট ছিলনা। কোনো কথা না বলেই তারা একজন আরেকজনকে পার হয়ে ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। চিরদিনের জন্য।
কি মন খারাপ করা গল্প, তাইনা?
হ্যা, এটাই, এই গল্পটাই আমার তাকে বলার কথা ছিল।
আগে ইংরেজীটা পইড়ে তারপর আসলাম। অনুবাদ ভালো হইসে। গল্পটা অনুভব করতে পারসি, এইটাই হলো আসল কথা। কিন্তু, নিজের জন্য কাউকে তো আজ পর্যন্ত দেইখা মনে হইল না,১০০% নিঁখুত।ঃ(
অনুবাদ ও মূল, দুইটাই অসাধারণ!
এছাড়া আর কিছু বলার নাই।
এতদিন পরে অনুবাদটা যে দিলি তাতেই আমি খুশি। ইংরেজী অনুবাদটাও বেশ ভালো, আর তুই মুরাকামির সেই ক্যাজুয়াল ভাবটা ঠিকমতই ধরতে পারসিশ। আরো দু-একটা করে ফেল।
মূল গল্পটা পড়ি নাই এখনও, তবে অনুবাদটা ভালো লাগছে বেশ... গল্প বলার ভঙ্গিটার কারনেই...
গল্পটা ভালো লাগছে।
গল্পটা অনেক ফাইন হৈছেগো আপা...
ভাল লাগলো।
বাংলা ভাষায় এতো সুন্দর করে লেখা গল্পটা পড়লাম। কষ্ট কইরা ইংরেজি পড়তে যাবো কোন দুঃখে?
বাংলা ভাষায় এতো সুন্দর করে লেখা গল্পটা পড়লাম।
মৌসুম কি লিখালিখি ছেড়ে দিয়েছেন? দেখছি না যে মোটেও
হেলো। আছেন কিরাম? এই লেখাটার হেডিংএর সঙ্গে আমার একটা হেডিংএর গঠনগত মিল পাইলাম। পেয়ে খুশি হইলাম। তাই আপনেরে জানাইতে আসলাম।
বাংলা ভাষায় এতো সুন্দর করে লেখা গল্পটা পড়লাম। কষ্ট কইরা ইংরেজি পড়তে যাবো কোন দুঃখে?
তেলাপোকার ঠ্যাং যে এতো উপাদেয় আগে জানতাম না।
মন্তব্য করুন