অনুপম অনুপম!
শিরোনামের দ্বিতীয় শব্দটুকু বিশেষ্য, প্রথম অংশটুকু বিশেষণ!
বলছি আমার একজন প্রিয় শিল্পী অনুপম রায়ের কথা। আমাদের সবার চেনা ভারতীয় বাংলা সিনেমার সুরকার কাম প্লেব্যাক শিল্পী নয়, আজ বরং একটু অচেনা কেবলই শিল্পী অনুপম রায়ের গান নিয়ে কিছু কথকতা হয়ে যাক।
অনুপম রায় কে কেবলই একজন প্লেব্যাক শিল্পী ভাবলে ভয়ংকর একটা অন্যায় হবে। কারন সে একই সাথে তার বেশিরভাগ গানের লেখক এবং সুরকারও বটে। আমার মতে একটা কবিতা বা গান তখনই সত্যিকার পূর্ণতা পেয়ে থাকে যখন কবি নিজেই তার কবিতাকে তার অনুভূতির সুরে সাজিয়ে একটি গানে পরিণত করে তুলতে পারেন। বর্তমান সময়ে দুই বাংলা মিলিয়েও এরকম শিল্পী হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র পাওয়া যায়। এজন্যই আমার মতে, অনুপম সত্যিই অনুপম।
শুধুমাত্র একটা গান দিয়ে যে দুই দুইটা দেশের সময়ের জনপ্রিয়তম শিল্পীতে পরিনত হওয়া যায় তাই দেখিয়ে দিয়েছিল ২০১০ এর 'অটোগ্রাফ' মুভির 'আমাকে আমার মত থাকতে দাও' । তার পরের বছর আবারও সবার মন জয় করে নিতে এলো 'বাইশে শ্রাবণ' মুভির গান 'একবার বল' ।
এই দুইটা গান হাজারো বার শোনার কারনেই হয়তো তার প্রতি প্রত্যাশাটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আকাশ সমান।
যা ক্রমশ বাড়ছিল বৈ কমছিল না, বিভিন্ন মুভির চমৎকার সুরের কিছু ভালো লাগা গানের কল্যাণে।
এরই মাঝে ২০১২ এর শুরুতে এলো প্রিয় শিল্পীর প্রথম একক গানের এ্যালবাম 'দূরবীনে চোখ রাখবো না' । শুনলাম এবং যারপরনাই হতাশ করল তা আমাকে, ঐ যে আকাশছোঁয়া প্রত্যাশ্যার কথা বলেছিলাম সেজন্যই হয়তো। ওরকম ভাল লেগেছিল কেবল 'তিস্তান ২' আর 'উড়ে যাক' । ব্যাস!
তারপর আর কি, আবার বেশ কিছু দারুন সুরের মুভির অসাধারন গান।
অতঃপর ২০১৩'র শুরুতে এলো তার দ্বিতীয় একক 'দ্বিতীয় পুরুষ'। প্রায় প্রত্যেকটা গানেই কবি অনুপমের চমৎকার ভাবনার ছাপের স্পষ্টতা বহন করা একটা এ্যালবাম, এলো এবং অবশেষে প্রত্যাশার যথাযত মূল্য দিয়ে আমায় জয় করে নিল!
এ্যালবামের প্রথম চারটা গানকে বলা চলে ইদানিংকালে আমার শোনা সবচাইতে সেরা বাংলা সফট রক গান।
প্রথম গানের নাম 'ফাঁকা ফ্রেম' ।
গানটার কিছু চমৎকার লাইন এরকম।
ফাঁকা ফ্রেম আর অকেজো হাতঘড়ি
নিয়ে এখন আমি কি করি
এন্টেনায় আর অশ্বত্থের ডালে
ঝুলে থাকি প্রত্যেক সকালে।শহুরে সন্ধ্যায় - বন্দরে -
রুমাল নেড়ে আমি জাহাজ তাড়াই
অনেক রাত্তের স্টেশানে
প্লাটফর্ম গুলোতে পিকনিক(?!) সাজাই।আর দেড়শো বছর আগেও আমি
তোমায় খুঁজে পথের ধারে
ক্লান্ত হয়ে শুয়ে ছিলাম
এভাবেই ঠিক অন্ধকারে।এখন তুমি খুঁজতে এলে..
দেড়শো বছর আগেও আমি
তোমায় চেয়ে গান লিখেছি
পুকুর ধারে জলের গন্ধে
বাংলা ভাষায় চোখ ধুয়েছি।এখন তুমি খুঁজতে এলে..
তার পরের গান 'অদ্ভুত মুগ্ধতা' ।
শুরুর কথাগুলি এরকম -
কত কত দিন
কাব্যহীন থেকে যায়
ডিমের সাদায়।কিছু কিছু নাম
প্রেমিকার জিভে জড়িয়ে যায়
কখনো বা কাঁদায়।মধুর হাতে আবছায়াতে চোখের উপর চুল
প্রতিমাসে সর্বনাশে জমতে থাকা ভুল।আমি এত সব বলতে চাই না
যদি বিনা আহ্বানে আমার ঘরে ঢুকে যাও
আলমারি নেড়ে ঘেঁটে যদি কিছু খুঁজে পাও
তোমার কাছে রেখে দিও আমি কিছু চাই না
নিজেকে ভেঙ্গে ফেলে জুড়ে নিও আয়নায়।তোমার এ মহাসন কালোতে ঢাকা সে
পুরনো প্রেমিকার মত তারা আকাশে
কখনো খসে পড়ে কখনো সে কবিতায়
কলমে কাগজে গলাকাটা দাম চায়।চাই চাই এক অদ্ভুত মুগ্ধতা দাও দাও এক অদ্ভুত মুগ্ধতা
চাই চাই এক অদ্ভুত মুগ্ধতা দাও দাও এক অদ্ভুত মুগ্ধতা ।
তিন নাম্বারে 'রাত পোশাক' ।
চমৎকার গানটার কথাগুলো এরকম -
যদি ওর সাথে ভালো থাকো
থাকতে পারো
আমার দেহে বন্ধ হয়ে
আমার গানের ছন্দ কেটো না।
আমি এত সব বলেই থাকি
কিছু মনে করো না
তোমার হৃদয় হারেম হলে
আমার জন্যে ছোট্ট এক কোনা - রেখো।আমারই আদরে খুলো চোখ প্রতি সকালে
আমাকে পাবে রোজ তুমি যেই ডাক পাঠালে।দরজায় তালা থাক
আমি তোমারই রাত পোশাক হয়েছি
আধ ঘুমে নির্বাক
আমি তোমারই রাত পোশাক।তোমাকে খুঁজে পেয়ে, হারাতে চাই না আবার।
তোমার পাশেই হাঁটছি আমি
তোমার কবিতায়
আমার কথায়, আমার শব্দে
তুমি কেন ধরা পড়বে না - বলো?
তুমি আমি সেই অন্ধকারে
আটকে পড়েছি
আমার দু হাত তোমায় ছুঁলে
তোমার শরীর নেই আর দোটানায় - কেন?আমারই আদরে খুলো চোখ প্রতি সকালে
আমাকে পাবে রোজ তুমি যেই ডাক পাঠালে।দরজায় তালা থাক
আমি তোমারই রাত পোশাক হয়েছি
আধ ঘুমে নির্বাক
আমি তোমারই রাত পোশাক।তোমাকে খুঁজে পেয়ে, হারাতে চাই না আবার।
চারে আছে 'তারার মত' ।
কয়েকটা লাইন এরকম -
আমি মেঘের মত একা
আর তোমার সাথে দেখা
যদি কোথাও হয়ে যায়।আমি ছুটে যাবো আবার
কিছু থাক বা না থাক পাবার
দেখি আমায় কে আটকায়।তোমার এথিক্স থাকে পাহারায়
যতবার
আমি তোমাকে দু হাতে পাই
ততবার।ভেবে দেখো অন্য সকাল
নয়তো পর্দার আড়াল
বুকের ভেতরে এখনও
এখনও লাল।ভেবে দেখো অন্য শহর
কিংবা পরের বছর
বুকের ভেতরে এখনও
এখনও ঝড়।
পাঁচে 'অঙ্কের খাতা' । আমার খুব একটা ভালো লাগে নাই।
ছয়-এ একটা ইনস্ট্রুমেন্টাল 'অন্তর্বর্তী শুন্যতা', খারাপ না।
সাতে আছে 'আমি আজকাল ভাল আছি', আরেকটা চমৎকার বিষাদমাখা ভালো লাগা গান।
এর কয়েকটা প্রিয় লাইন এরকম -
শোন অভ্যাস বলে কিছু হয় না এ পৃথিবীতে
পালটে ফেলাই বেঁচে থাকা।
আর একশো বছর আমি বাঁচবই, জেনে রাখ,
হোক না এ পথঘাট ফাঁকা।আমি আজকাল ভালো আছি
তোকে ছাড়া রাতগুলো আলো - হয়ে আছে
আমি আজকাল ভালো আছি।
আট-এ আছে 'আরও শীত', এর শেষের কথাগুলো চমৎকার।
এই যে -
অবাধ যত্নে সামলে চলা, ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়।
ভাবলি কেন দুঃখ পাব, দুঃখ আমার নয়।আমি কাঁটাতারেই সুখী,
এই কুয়াশাতে উঁকি দিয়ে।
রাজি মিথ্যে নিতে,
আসলে সত্যি বলে সত্যিই কিছু নেই।
নয়ে আর দশে আছে আগেই শোনা দুটি গান,
'একবার বল' আর 'আমার মতে তোর মতন কেউ নেই', দুটোই একটু নতুন করে গাওয়া। ভালোই লেগেছে শুনতে।
আর কি বলবো, এই তো। এখানেই শেষ আপাতত আমার গানালাপ।
অনুপমের অনুপম পথচলা সুদীর্ঘ হোক, এই শুভকামনা থাকবে সবসময়।
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা, তারপরই শুরু বাংলা নববর্ষ ১৪২০।
নববর্ষের শুভেচ্ছা রইল সকল বন্ধুদের জন্য।
ভালো থাকুন, অনেক ভালো। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ।
খুব ভাল লাগল ভাই। গানগুলো শুনব।
পশ্চিম বঙ্গের ব্যন্ডগুলোর অনেকেই নিজে লিখে, নিজে গায়, সুর করে।
একমত
শুনে ভাইজ্জা খাওয়া শেষ আর এতোদিনে দিলা পোস্ট!
তাও ভালো পোস্ট। থ্যাঙ্কু!
বেটার লেট দেন নেভার!
তোমাদের প্রিয় গান শুনলাম... তুমি শুনলা আমাদের প্রিয় গান... দুইটা সম্পর্কে ভালো ধারনা...
এভাবেই আসলে জেনারেশন গ্যাপ কমে
ধইন্যা
টুটুল ভাই কথাটা দারুন বলছেন।
আমি অবশ্য আপনাদের জেনারেশনের গানই বেশি শুনি,
ক্যাম্নে জানি বেশ খানিকটা ব্যাকডেটেড রইয়া গেছি এইসব বিষয়ে!
আমারো এই লোকের বেশিরভাগ পছনদ
আমারও..
আল্লারে মাইরা লাইসে, আমগ ব্যাকডেটেড কই, খেলপ না, মতিকন্ঠে গিয়া বিচার দিব, উনারা আফনার প্যারোডি করিবে।আপনি এত ভাল লেখেন, আমাদের মজাই হবে। যদিও আমি এখানে নতুন, আসলে নতুন না। পুরান, ব্যকডেটেড।
ওল্ড ইজ গোল্ড!
আমার কিন্তু কিঞ্চিত আধুনিক আমার চাইতে ব্যাকডেটেড আমাকেই বেশি ভাল লাগে!
মন্তব্য করুন