আরীব ও প্রকৃতি
তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ফেসবুকে। আমার স্ট্যাটাসে কমেন্ট করেন, লাইক করেন। একদিন কৌতূহলবশত তাঁর প্রোফাইলে ঢুঁ মারলাম। সরকারের অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ কর্মকর্তা তিনি। শখ তাঁর শিশু পালন। প্রিয় উদ্ধৃতি-'প্রকৃতি প্রার্থনার বশ নয়। প্রকৃতি প্রার্থনার বশ হলে পৃথিবীর চেহারা বদলে যেত। পৃথিবীর জন্য প্রার্থনা তো কম করা হয়নি'।
কিন্তু তাঁর ওয়ালে কিছু মন খারাপ করা কথাবার্তা দেখে কষ্ট লাগল।
ফেসবুক ছাড়াও বিভিন্ন ব্লগ এবং প্রথম আলোতে আমার লেখা পড়ে তিনি প্রতিক্রিয়া জানান।
একদিন আমার ইনবক্সে তাঁর একটি মেসেজ পেলাম এরকম-'''আপনি তো অনেক লিখেন । ১ বছর ৯ মাস বয়সের একটি জীবন্ত জড়মানবকে নিয়ে লিখতে পারেন ? যার শ্রবণযন্ত্র ছাড়া আর কিছুই স্বাভাবিক নয়, যাকে সুস্থ করে তুলবার কোনো ব্যবস্থা এখনও কেউ করতে পারলো না ! মৃত্যুই যাকে তার সকল কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারে, তেমন কাউকে নিয়ে কিছু লিখতে পারেন আপনি?'
আমি বললাম-'আপনার কথাগুলো পড়ে খুব মন খারাপ হলো।
আদরের শিশুটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানালে আমি লেখার চেষ্টা করব।'
উত্তরে তাঁর শোকার্ত বয়ান-''আপনার মন খারাপ করে দেবার জন্য দুঃখিত ।
''২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি । অদ্বয় আরীব ইমতিয়াজের জন্ম । তারপর অনেক কথা, অনেক কষ্ট । অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হল তাকে । মাস চারেক বয়সে জানলাম সে দেখতে পায় না । মুখ দিয়ে খেতে কষ্ট হয়, তাই টিউব ফিডিং । এ পর্যন্ত ৪ বার নিউমোনিয়া হয়েছে । হাত ও পা কোনো কাজে লাগে না । মাথাটা ছোট্ট, ঘন চুলে ভরা । আমার মেয়েটি ডায়াবেটিস ও অন্যান্য রোগে ওর যত্ন নিতে পারে না । সে চাকরিও করে। হতভাগ্য নানা আমি তাকে টেনে নিয়ে বেড়াই । এ বয়সে আর সম্ভব হচ্ছে না । সে বাঁচবে না, মৃত্যু ছাড়া তার কষ্টের অবসান হবে না । তার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কোনো সংস্থা/প্রতিষ্ঠান যদি তাকে রাখত তবে সে এবং আমি ও আমরা ভাগ্যবান বলে ভাবতাম নিজেদের । সব ঝাপসা হয়ে আসছে - আজ শেষ করি । তাকে নিয়ে লেখার দরকার নেই।"
আমি বললাম, ''আমি লিখতে চাই। আপনি কি অনুমতি দেবেন?'
তিনি লিখলেন-'' বাতাসের যৎসামান্য অক্সিজেন - তাও এ পৃথিবীর শত কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে অবলীলায় । অথচ আরীব ভোগে শ্বাসকষ্টে । দিনে এখনও অন্ততঃ দু'বার নেবুলাইজার দিতে হয় তাকে । রাজপুত্রের মত না হয়ে ওর চেহারা যদি কুৎসিৎ কদাকার হত, আর এসব ত্রুটি না থাকত তা হলে তাকে নিয়ে অনেক সুন্দর গল্প হত । বারবার যে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছে, তার চেয়ে বলা ভাল আমি ফিরিয়ে এনেছি, তাকে নিয়ে গল্প কি হয় ? আমার প্রফাইলে ওর নামে একটা এ্যালবাম (I am Areeb ) করেছি, ওর হয়ে আমি আবেদন জানিয়েছি এ পৃথিবীর দরদী মানুষদের - কেউ সাড়া দেয়নি । আপনি আমার মনের অবস্থা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন এবং সহানুভূতি দেখিয়েছেন এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ । বিষয়টি এখন সার্বজনীন - এখানে অনুমতির প্রয়োজন কি ? আপনি লেখক - যা লিখবেন সেটিই বাস্তব । আপনি লিখুন - আরও যা জানতে চান আমি জানাতে চেষ্টা করব।''
না, প্রিয় পাঠক, আরীবকে নিয়ে আমি লিখতে পারিনি। আর কিছু জানতেও চাইনি। শিশু পালন যাঁর শখ, হুমায়ূন আহমেদের প্রকৃতি-প্রার্থনা বিষয়ক কথা যাঁর প্রিয় উদ্ধৃতি; নাতি আরীবকে নিয়ে তাঁর অনুভূতি-উপলব্ধি স্পর্শ করার ক্ষমতা আমার নেই।
আমার কলমে এত কালি নেই। আমাকে ক্ষমা করবেন।
কষ্টে মন অবশ হয়ে এল। আরীব থাকবে আমাদের প্রার্থনায়
কী করা যেতে পারে মামুন হক?
আমি তো দেশে থাকি না ভাই, থাকলে চেষ্টা করে দেখতাম কিছু করার।
বাকরুদ্ধ অবস্থা। মন খারাপ হয়ে গেল।
আরীবের জন্য কিছু কি করা যায় রশীদা?
মাইনুল এইচ সিরাজীকে ধন্যবাদ । আমি সেই হতভাগা নানা । মাইনুল এইচ সিরাজীর আহ্বানটি দেখে স্বাভাবিকভাবেই আমি অশ্রুসিক্ত । যাঁরা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ । সত্যিই কি, দেশ বা বিদেশে আরীবের কোন আশ্রয় মিলবে না, যেখানে সে মৃত্যুর আগে অসংখ্যবার মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করবে না ?
মাইনুল এইচ সিরাজীকে ধন্যবাদ । আমি সেই হতভাগা নানা । মাইনুল এইচ সিরাজীর আহ্বানটি দেখে স্বাভাবিকভাবেই আমি অশ্রুসিক্ত । যাঁরা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ । সত্যিই কি, দেশ বা বিদেশে আরীবের কোন আশ্রয় মিলবে না, যেখানে সে মৃত্যুর আগে অসংখ্যবার মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করবে না ?
খুব মন খারাপ হলো। কিছু বলতে পারছি না। ভাষা নেই।
''সত্যিই কি, দেশ বা বিদেশে আরীবের কোনো আশ্রয় মিলবে না, যেখানে সে মৃত্যুর আগে অসংখ্যবার মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করবে না ?''
কোন মন্তব্য নেই ।
............
''সত্যিই কি, দেশ বা বিদেশে আরীবের কোেনা আশ্রয় মিলবে না, যেখানে সে মৃত্যুর আগে অসংখ্যবার মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করবে না ?''
এই বিপন্ন শিশুটির পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে আমার ব্যর্থতাকে ক্ষমা করো প্রভু....।
মন্তব্য করুন