ক্যাম্পাস-স্মৃতি: জারুলতলার ৭
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসে অতি উৎসাহ নিয়ে ঢুকে ভাব নিয়ে বসলাম। মোটা ফ্রেমের চশমা পরে প্রবেশ করলেন ভূঁইয়া ইকবাল স্যার। তিনি পরিচিত একটি কবিতা রাশভারী গলায় আবৃত্তি শুরু করলেন- হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন...। আবৃত্তি শেষ করে স্যার বললেন, এবার অর্থ বলি- বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিধ ছাত্ররা এসে বাঙলায় ভর্তি হয়। আমি নিদারুণ হতাশ, লজ্জিত। স্যার বললেন, মন খারাপ কোরো না, এই বিবিধরাই শেষ নাগাদ ভালো করে। পরের ৪৫ মিনিট জমিয়ে রেখে স্যার যখন ক্লাস শেষ করলেন, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বেরুলাম স্যারের পিছুপিছু।
৪ বছরের কোর্স শেষ করতে ৭ বছর লেগে গেলেও বিরক্তি আর হতাশা ঢাকা পড়ে থাকতো স্বপ্নময় মুগ্ধতার সাদাকালো চাদরে। বলার দরকার নেই- সেই চাদরের আড়ালে একটা ঘর্মাক্ত আকুতি প্রায়শ হাসফাস করত- কবে বের হব, লেখাপড়া শেষ করে কবে একটা চাকরি পাব। ভালো চাকরি করব- ৭ বছরে এই বিশ্বাস কখনো টলেনি। পরে সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে বুঝলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনটাই ভালো ছিল। এখন কর্মজীবনের কঠিন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় যখন, স্বপ্নের দৃষ্টিসীমা যখন ইঞ্চিতে এসে ঠেকে- চোখ বন্ধ করে জারুলতলার ক্যাম্পাসের ফুল পাহাড়ে উড়ে বেড়াই, ঘুরে মরি। ওটাতেই যাবতীয় সুখ। জীবনের এই পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে, আমি সত্যিকারের বাঁচা বেঁচেছি মাত্র ৭ বছর!
কনীনিকা সেভেন ছিল আমার ঠিকানা। নতুন কটেজ। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ঠিক উল্টো পাশে। এক রাতে অনেকেই যখন পাশের আলাওল হলে রাতের খাবার খেতে গিয়েছিল, একদল অস্ত্রধারী ঢুকে গেল কনীনিকায়। লুটপাট হলো। পুলিশ এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল- কী অস্ত্র ছিল হাতে? আমি নাম বলতে পারিনি। পুলিশ ক্ষেপে গেল। বিব্রত আমি ভাবছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে অস্ত্র চিনতে না পারাটা বুঝি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে! এছাড়া কনীনিকার বাকি ইতিহাস সুখের। ক্যাডারদের তুষ্ট করতে না পারায় হল এ সিট পেয়েও উঠতে পারিনি। সেই কষ্ট ভুলে ছিলাম কটেজে আনন্দময় আর সৃজনশীল পরিবেশ পেয়ে।
বাঙলা বিভাগে একটা সাংস্কৃতিক আবহ পেয়ে গেলাম স্বাভাবিকভাবেই। ছোটবেলায় পাড়াগাঁয়ের অন্ধকারেও পারিবারিক আলোকবিন্দু জোনাকির মতো মিটিমিটি করত বুকের ভেতর। বাঙলা বিভাগে এসে সেটা হৃৎপিণ্ড উপচে ছড়িয়ে পড়ল অস্তিত্বের ভেতর-বাইরে। জোনাকির আলো জয় করে জোছনার পিপাসায় কাতর হয়ে উঠলাম। জাফর আহমদ রাশেদ- আমাদের তিন বছরের সিনিয়র- তখন থেকেই রীতিমতো সাহিত্য তারকা। আহসান আলম- আমাদের বন্ধু- উত্তরাধুনিকতার কর্মী। সৈয়দ আহমদ শামীমের কবিতা ছাপা হয় কলকাতার দেশ -এ। আমি ঢকঢক করে গিললাম ওদের সাহচর্য। ৯৪- ৯৫ সালের দিকে দৈনিক পত্রিকাগুলো নতুন যুগে প্রবেশ করল, যায়যায়দিন শুরু করল ভালোবাসা সংখ্যা বের করা। আমরা লুফে নিলাম সুযোগগুলো।
জোছনায় ভূত দেখার অভিজ্ঞতাও আছে। সেটা বলে শেষ করি। বৃষ্টি গল্পটা আগেই পড়েছি। আলাউদ্দিন আল আজাদকে যখন সামনাসামনি পেলাম, মনে হলো এ তো মানব নয়, দেবতা- বেশে আবেশে। ভোরের কাগজের মুক্তচিন্তা পাতায় একটা বিভাগ ছিল ''আমার আমি''। বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিজের কথা ছাপা হতো ওখানে। আমি তখন ওই পত্রিকার ফিচার পাতার প্রদায়ক হিসেবে কাজ করি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। একদিন বন্ধু আনোয়ার সাঈদ পলাশকে নিয়ে স্যারের কাছে গিয়ে একটা ''আমার আমি'' চাইলাম। স্যার তো হেসেই খুন। বললেন, ভোরের কাগজ আমার কথা ছাপাবে না। আমি অবাক। তবু আত্মবিশ্বাস নিয়ে নাছোড় রইলাম। স্যার রাজি হলেন। নিজ হাতে লিখে দিলেন অনেক না জানা কথা। পাঠালাম। কিন্তু সেটা আর ছাপা হয় না। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, এরশাদের কাব্য-সহযোগী হওয়ায় আলাউদ্দিন আল আজাদ ভোরের কাগজের ব্ল্যাক লিস্টেড। ফিচার সম্পাদক বললেন, এটা ছাপা না হলে কি তোমার টিউটোরিয়াল নম্বর পেতে কোনো সমস্যা হবে? আমি বললাম, না। উনি আবার বললেন, সমস্যা হলে বলো, অন্য পত্রিকায় ছেপে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। আমি বললাম, না। আলাউদ্দিন আল আজাদের মৃত্যুর পর ওই লোকগুলোই যখন তাঁর স্তুতি গাইতে শুরু করলেন, আমি মুচকি হেসেছি; যেমন হাসতেন আজাদ স্যার আমাকে দেখে- যখন তাঁর ''আমার আমি'' টা ছাপা হচ্ছিল না।
ভালো লাগলো। এটার কি আর পর্ব আসবে না?
আসতে পারে, মীর
আমি সত্যিকারের বাঁচা বেঁচেছি মাত্র ৭ বছর! ভাগ্যবান(?) ! আমার সত্যিকারের বাঁচার সময় অ নে ক কম । একটা টাইম মেশিন যদি পেতাম !
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় বিতিকিচ্ছিরি সব সাবজেক্টে না পড়ে বাংলায় পড়লে ভাল লাগতো
চমৎকার লেখা।
ব্যাপক কমন পড়লো!
কনীনিকা সেভেন তো সিরাজীর লেখার সুবাদে পাফো পাতায় বিখ্যাত ঠিকানা ছিলো।
আপনাদের ডিপার্টমেন্টে যাওয়া হতো-- এক আপা, এক আপা-কাম-চাচী আর চাচাসহ পারিবারিকসূত্রে পরিচিত কয়েকজন আপনাদের শিক্ষক ছিলেন। প্রোক্টরের তলবে একবার আলাউদ্দিন আল আজাদ স্যারের সঙ্গে একটা কারণে সাক্ষাত ঘটেছিলো, উপলক্ষটা খুব প্রীতিকর ছিল না (এখানে বলার মতোও না) তবে স্যারের অমায়িক ব্যবহার ভোলার মতো না।
কিছুকিছু নামও ব্যাপক বিখ্যাত ছিল।
আরো পর্ব আশাকরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটো বিষয় ছিলো পছন্দের প্রথম আইন নইলে বাংলা। বাংলা পড়া হয় নাই
পাফো'র কল্যাণে আপনার কনীনিকা সেভেন খুব পরিচিত ঠিকানা ছিল। আপনার নামটাও। তবে আমার ধারণা ছিল ওই ঠিকানা স্টেশানের ধারে কাছে কোথাও হবে।
চবি নিয়ে এখনো একটা যুতসই লেখা লিখতে পারলাম না। তাই অন্য কেউ চবি'র স্মৃতিচারণ করলে স্বাভাবিকভাবেই খুব ভালো লাগে। আপনার ৭ বছর হলেতো আপনি ভাগ্যবান। আমার গিয়েছিল ৮ বছর (১৯৮৭-১৯৯৫)। আপনি কোন ব্যাচ? আমার ব্যাচ ৯১ কিন্তু পরীক্ষা ৯৫। যার মধ্যে এরশাদ খেয়েছে দুই বছর শিবির খেয়েছে দুই।
জারুলতলা আর কুঞ্জবন......আহ কি অসাধারণ। চায়ের ঝুপড়িগুলো যখন লাইব্রেরী পাহাড় ছেড়ে এদিকে এল, তখন থেকেই জায়গাটা জমজমাট। কিন্তু চা সিগারেটের আড্ডা বাদে সাহিত্য সংস্কৃতির বাকী ব্যাপারগুলো শিবির আতংকে বরাবর আড়ষ্ট ছিল। ক্যাম্পাসে থেকে যারা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতো তারা সত্যি সাহসের পরিচয় দিয়েছে।
আরো ক্যাম্পাস স্মৃতি চাই আপনার কাছ থেকে।
হাহাহা আমার্ও ধারণা ছিল কনীনিকা স্টেশনের কাছে কোথাও হবে। সেখানে বোধহয় কণিকা, ক্ষণিকা এমন সব নামের কটেজ ছিলো।
লাইব্রেরির পাহাড়ে ঝুপড়ি ছিলো কখন নীড়দা? আমরা দেখিনি। তখন সিঁড়িগুলো হয়নি? কেমন দেখাতো অত সু্ন্দর পাহাড়টা?
আমাদের প্রথমদিকে লাইব্রেরী পাহাড় পুরোটাই আদিম জঙ্গল ছিল। তার নীচের দিকেই সারি সারি ঝুপড়ি দোকানগুলো দাঁড়ানো ছিল। শিবিরের তাড়া খেয়ে ওই জঙ্গলাবৃত পাহাড়টা যেদিন হরিনের দৌড়ে পেরিয়েছিলাম (তখন লাইব্রেরী ভবনের কাজ শুরু হয়েছে মাত্র) বাপ্রে....সৌন্দর্য নয় জঙ্গলের ঘনত্ব সেদিন মর্মে মর্মে টের পেয়েছি।
আমার ব্যাচ ৯৫, পরীক্ষা ৯৮। লেখালেখি করতাম, তাও ভোরের কাগজে। এই 'অপরাধে' হল-এ উঠতে দেয়নি শিবির। আলাওলে মাঝেমাঝে খেতে যেতাম। ওরা 'বাইরের ছেলে' বলে টিজ করত। কটেজে আমরা মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতাম, তবে গোপনে। মনে পড়ে ৯৬ তে আ লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম নববর্ষে আমাদের কটেজের সামনের জমিতে লাউড স্পিকার বাজিয়ে নেচে গেয়ে উৎসব করেছিলাম। নববর্ষ উদযাপনের জন্য নয়, শিবিরকে একহাত নেয়ার জন্য। সেদিন আলাওলের মা বাপ খালেদ, মুজিবদের অসহায় মুুখ দেখে কী যে ভালো লেগেছে!
আমি সত্যিকারের বাঁচা বেঁচেছি মাত্র ৭ বছ...........
স্মৃতিচারণ ভালো লাগলো।
চবি আমার খুব প্রিয় জায়গা। সেই কনীনিকা সেভেন যেখানে থাকতেন আমাদের প্রিয় লেখক মাইনুল এইচ সিরাজী!
েসই সব এখন অতীতকাল রশীদা। খুব মিস করি, খুব!
আহা... স্মৃতীকাতরতা
চলুক কিন্তু
মন্তব্য করুন