সম্পর্কের মূল্যহ্রাস
১৯৯০ সালের দিকের একটি ঘটনা। বড় বোন আর তার নতুন বর গেছে ঢাকায়। মধুচন্দ্রিমার মতো কোনো ব্যাপার নয়; উদ্দেশ্য শুধু দুটো দিন নতুন জীবনকে একটু ভিন্নভাবে উদযাপন করা, স্বপ্নের শহর ঢাকাকে দুজন মিলে দেখা। মধুচন্দ্রিমা শব্দটা আমাদের কাছে তখন স্বল্পপরিচিত। নিম্নমধ্যবিত্তের কাছে যা এক বিলাসী স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
ঢাকায় তারা উঠেছিল বড়লোক মামার বাসায়। দুদিন পর গ্রামে এসে বড় বোনের সে কী কান্নাকাটি- লজ্জা- সংকোচ! এই অতি আপন আত্মীয়টি নতুন এই দম্পতিকে নানাভাবে অমর্যাদা দিয়েছে। মেঝেতে ঘুমাতে দিয়েছে, তাদের নেওয়া মিষ্টি পঁচা বলে উপহাস করেছে। বোনের প্রশ্ন- কেন উনারা আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করলেন? আমরা তো পর নই। ছোটবেলায় বোনকে কত্তো কোলে নিয়েছে সেই মামাটি। মেলায় নিয়ে গিয়ে চিনিবাতাসা আর ভেঁপু কিনে দিয়েছে! এখন শহরের বাসিন্দা হয়েছে, কিছু টাকাপয়সা হয়েছে, তাই কি এত পরিবর্তন?
কারো পকেটে টাকাপয়সা বাড়তে থাকলে তার মানবিক বোধগুলো ভোঁতা হয়ে যেতে থাকে বুঝি। এ কাজে অনুঘটকের কাজ করে যান্ত্রিক জীবনের উৎসব-কোলাহল। বিজ্ঞান আমাদের দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ- যাযাবরের এই কথটা আমাদের শহরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে ফলতে শুরু করেছে সম্ভবত আশির দশক থেকে। গিজগিজে নগরায়ণ আর জীবিকার চাপে অনুভূতিগুলো চিড়েচ্যাপ্টা হতে শুরু করেছে, আধুনিক শহুরে মানুষের সঙ্গে মানবিকতার বিস্তর দূরত্ব তখন থেকেই প্রকট হয়ে উঠেছে। স্বজন-প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতি আর ভাবাবেগ ধীরে ধীরে বিদায় নিয়েছে। শহরের এই প্রবণতার সঙ্গে আমরা পরিচিত বলে এসব অসঙ্গতি, অমানবিকতা এখন আর আমাদের ভাবায় না, স্পর্শ করে না।
তবু আমাদের একটা আশ্রয়ের জায়গা আছে- গ্রাম। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে গ্রামীণ শহরগুলো হয়তো ধীরে ধীরে বড় শহরের চরিত্র অর্জন করছে, কিন্তু বাকি বিশাল-বিস্তীর্ণ গ্রাম এখনো আমাদের কাছে ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড়। ছোটবেলায় পড়া কবিতা- আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর, থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর- এর প্রতিটি পঙক্তিকে সত্য বলে জেনেছি।
কুড়ে ঘর। থাকার জায়গা নাই। তবু আত্মীয়-স্বজন এলে সে কী আনন্দের বন্যা! গল্প করে সারারাত কাটিয়ে দেওয়া। গল্প তো নয়, জীবনের এক একটা উপাখ্যান, মহাকাব্য যেন।
বাড়িতে অতিথি এলে যত গরিবই হোক খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে দেখিনি। ঘরে চাল-ডাল-আটা আছে। পুকুরে মাছ, খোঁয়াড়ে মুরগি আছে। সবাই মিলে রেধে খাওয়া। অতিথির সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করাটাই আসল।
কিন্তু গ্রামের এই চিত্র এখন পুরোপুরি আগের মতো নেই। কয়েক বছর থেকে লক্ষ্য করছি, অতিথি এলে গ্রামের বাড়িতে এখন আর উৎসব বসে না। বরং গম্ভীর একটা পরিবেশের সৃষ্টি হয়। হবে না কেন? চাল-ডাল তো আছে মাত্র হিসাব করা বা তারও কম। নিজেদেরই চলে না, অতিথি খাবে কী? অতিথি এলে এখন তাই গৃহস্থ প্রথমে বিব্রত-লজ্জিত হয়, পরে বিরক্তি আর অসন্তোষ প্রকাশ করে। এই অসন্তোষ অতিথি যাতে বুঝতে না পারে সেই সতর্কতাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্ষিত হয় না। কোনো বাড়িতে অতিথি হয়ে যেতে গ্রামের মানুষরাও এখন নিদারুণ সংকোচ বোধ করে। তা সেটা বোনের, ভাইয়ের, এমনকী বাবার বাড়ি- যাই হোক না কেন।
মূল্যস্ফীতি পারিবারিক-সামাজিক বন্ধন, ভদ্রতা, আত্মসম্মানবোধ, লজ্জাবোধ, শালীনতা সর্বোপরি মানবিক গুণাবলীকে কীভাবে ধূলার মতো চুরমার করে উড়িয়ে দিচ্ছে- তা নিয়ে ভাবছি। শহর তো গেছে, গ্রামেও এখন মানবিকতার রাজ্যে বাজার এসে জুড়ে বসেছে। বাঙালি আবেগপ্রবণ, বাঙালি অতিথিপরায়ণ- এ কথাগুলো এখন বর্তমান থেকে খসে গিয়ে অতীতের গর্তের মুখে ঝুলছে। যে কোনো সময় পতন ঘটবে।
শিরোনামটা খুব চমৎকার। বিষয়বস্তুও অভিনব।
এই বিষয়গুলো নিয়ে তেমন আলাপ হয় না। কিন্তু এই বাস্তবতার চিহ্ন আমার আপনার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। আজকাল সম্পর্কগুলো রক্তের চ্যানেলের চেয়েও অর্থনৈতিক চ্যানেলেই যুক্ত থাকে বেশী, কিছু ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক চ্যানেলও। ফলে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে আসা যাওয়ার আগের সেই সংস্কৃতি বদলে গিয়ে নাগরিক চেহারায় যে রূপ নিয়েছে তা দেখে দেখে 'আতিক্কা' ঘাবড়ে উঠি।
আবার আমার মতো অনেকে সামাজিক বন্ধনের মধ্যে আত্মীয় বিমূখ হয়ে বন্ধুবান্ধবমুখী হয়ে গেছে বেশী। ফলে আত্মীয় বাড়ীতে যাওয়ার চেয়ে বন্ধুর বাসায় আড্ডা পেটাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এটাকে কোন মাত্রার স্বার্থপরতার ভেতর ফেলা যাবে বুঝতে পারছি না।
বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডার অন্তরালেও স্বার্থ লুকিয়ে থাকে।
বিষয়টা মাঝেমধ্যে ভাবায়। ছোটবেলায় দেখতাম নিয়মিত আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা, কয়েকদিনের জন্য ভাগাভাগি করে বিছানা পাতা। মায়ের উপদেশ অনুযায়ী খাওয়ার টেবিলে মুরগির রানটা কি ইলিশের পেটিটা বিনা আপত্তিতে অতিথির পাতে দিতে দেওয়া। পাড়াপ্রতিবেশির বাসাবাড়িতেও একই চল দেখতাম। আজকাল দেখি সঙ্গতি থাকলেও মানুষ হঠাৎ করেই যেন হয়ে উঠেছে 'স্পেস-কনশাস', 'প্রাইভেসি-সচেতন'; ছোট বাচ্চারাও নিজের রুম, নিজের বিছানা একরাতের জন্য ছাড়তে চায় না।
চমৎকার মন্তব্য। ঈদে আমরা আট ভাই (কাজিন) বসার ঘরের মেঝেতে ঘুমাতাম।
েছাটবেলায় অতিথিদের সঙ্গে উঠোনে পাটি বিছিয়ে চাঁদের আলোয় রাত কাটিয়ে দিতাম। আনন্দটাই অন্যরকম ছিল।
দিন পাল্টায়। মানুষের ব্যস্ততা বাড়ে। । সাথে বাড়ে ফর্মালিটি। অথবা সবই নগরায়নের কুফল/সুফল।
আগে আত্নীয়-স্বজন বিনা নোটিশে চলে আসত। খাওয়া দাওয়াও তেমন জৌলুসপূর্ন হত না, খুব বেশি হলে ঘরের একটা মোরগ ধরে জবাই করা হত। আর এখন মেহমান এলে আগে জানাতে হয়। গলদা চিংড়ি, পোলাও, মাছ মাংস,গরু, খাসি সব আইটেমই থাকা চাই (চট্টগ্রামের কথা বলছি)। সেদিন বউ ফোনে বলল "মা'রা (আমার শাশুড়ি) আজ আসতে চেয়েছিল, আমি মানা করেছি, ঘরে কাজের লোক নাই, আমি তোমার মেয়েকে নিয়ে অস্থির। "

আগে অতিথিরা তিথি মেনে আসত না। এখন দিন, তারিখ, ভেন্যু ঠিক করে আসে। অতিথির সংজ্ঞাটাই পাল্টে গেছে।
আগে একজন একজনের বাড়ি গেলে খাওয়ার সময় এমনিই খেতো। এখন রাতের নয়টা সময় গেষ্ট বিদায় করে তারপরের শুক্রবারে খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে। যেনো দাওয়াত ছাড়া একবেলা আত্মীয়ের বাসায় খাওয়া যায় না।
সিরাজী ভাইএর এ বক্তব্যের প্রমাণ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে হরহামেশাই দেখা যায়।
সিরাজী, এত বাস্তব একটা চিত্র এঁকেছেন এবং তা অপরূপ কাঠিন্যে চিত্রায়িত করেছেন, সে জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ । সবকিছু এখন অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা হয়, অর্থকে কেন্দ্র করে সকল কিছু আবর্তিত হয় । মন, মনন, মানসিকতা, মানবিকতা দিন দিন গতায়ু হয়ে যাচ্ছে । মানুষে মানব-সদৃশ রোবট বানাবার আগে নিজেরাই রোবটে পরিণত হচ্ছে । আবেগ হয়ে যাচ্ছে মূল্যহীন এবং অর্থহীন ।
কিছু সত্য অপ্রিয়। কিছু সত্য অস্বস্তিকর।
লেখার শেষ অনুচ্ছেদটি অতি চমৎকার।
মানুষের টাকা যত বাড়ে তার সমানুপাতিক হারে আন্তরিকতা কমে।
সময়ে সব কিছুই ঝাপসা হয়ে যায়। একদিন যার জন্য জান দিতে রাজি ছিলাম তার জান গেলে খুশি হই
ভালোবাসা মমতা সব কিছুই কমে যায়
আমি বরাবরই ধনী আত্মীয়দের এড়িয়ে চলি।পারতপক্ষে কারো বাসায় যাই না। রাত্রীযাপনতো চিন্তাই করিনা...
সম্পর্কের উপর নির্ভর করে মনে হয়। আর শহুরে খোপের মতো বাসায় অতিথি অনেকসময়ই উপদ্রব
নানা অভিজ্ঞতায় আমিও ভরপুর। আমার কিছু ধনী আত্বীয় দেখা হলে বলে, কি রে আসিস না কেন? আমি নানা টাল বাহানা দেখাই! কিছু জানি, ওর কাছে গেলে আমার আত্ত্বার অমর্যদা হবে!
আমি নিজেও আর ভাল কি? বন্ধু বিয়ে করেছে নূতন, দাওয়াত দিব দিব করে দিন পার করছি!
সিরাজীভাইমামা, বইমেলায় গিয়েছিলাম। ব্লগারদের বই সংগ্রহ করলাম, আপনার 'প্রেম পৃথিবীর পাঁচালি'ও। নীড়দার জন্যও নিয়ে এলাম
পড়তে শুরু করিনি, তবে দেখে মনে হলো দৈর্ঘ বেশি নয়।
ৈদর্ঘ বেশি না। মাত্র ৬২-৬=৫৬ পৃষ্ঠা। এক বসাতেই শেষ হয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন