গল্প: ডুবে যাওয়া সন্ধ্যার মাস্তুল
১.
অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। বাড়ির টানা বারান্দায় বসে আনমনে মুখ, কপাল আর কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলোকে ভেজাচ্ছিলাম। যদিও কতক্ষণ ধরে ভেজাচ্ছিলাম মনে নেই। এর মধ্যে শরীফ এক কাপ রং চা দিয়ে গিয়েছিল। ওকে চা দিতে বলতে হয় নি। নিজে থেকেই আমায় বারান্দায় বসে থাকতে দেখা চা দিয়ে গেছে। বৃষ্টি নিয়ে কোনো কথাও বলে নি। অন্য কেউ, যেমন মা বা বাবা হলে বৃষ্টিতে ভেজা থেকে বিরত থাকার কথা বলতো হয়তো। শরীফটা আমার মনের ভাব বেশ ভাল বোঝে। তাই চুপচাপ চা রেখে চলে গেছে।
সেদিন সিগারেট, চা, বৃষ্টি, বারান্দা, উচুঁ দালানকোঠা, খোপ খোপ জানালা, আধো আলো আর আধো অন্ধকার- সবকিছু মিলিয়ে পরিবেশটা বেশ জমে উঠেছিল। বেতো ঘোড়ার মতো কয়েকটা নাগরিক বৃক্ষকে বাতাসের ঝাপটায় খুব করে দুলতে দেখে হঠাৎ আমার শৈশবের অনেকগুলো স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছিল।
শৈশবের আনন্দযজ্ঞের পত্রবিহীন নিমন্ত্রণগুলো আজও আমি অনুভব করতে পারি। একবার ঝুম বৃষ্টিতে ফুটবল মাঠে বিস্তর আছাড় খেয়ে আমরা এক দল উদ্বৃত্ত কিশোর নাগর নদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সাঁতার না জানা থাকায় আমি নিজেকে শুধু ঝাপাঝাপিতেই সীমাবদ্ধ রাখতে বাধ্য হই। বন্ধুদের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। তারা সাঁতরে নদের পানি উলোট-পালট করে ফেললো। অথচ কেউ বাঁধা দিল না!
শীতের ভোরের অভিযানগুলো গ্রামীণ কিশোরদের জীবনের অমূল্য ধন। কুয়াশার আচ্ছাদন ভেদ করে আমরা দূর-দুরান্তে চলে যেতাম পাখি শিকার করতে। তখনও অতিথি পাখি কি এবং কেন মারা নিষেধ, সে তত্ত্ব তালাশের সুযোগ হয় নি। আমরা গুলতিতে মার্বেল ভরে ধানী জমিতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বককে খুব সহজেই ভূপাতিত করতে পারতাম। তবে আনন্দের ঢেউ খেলে যেতো বিলের ধারের চীনা হাঁসগুলো কোনোদিন আমাদের খপ্পরে পড়লে। কতকটা পথ সাইকেলে চেপে, কতকটা পথ নৌকায় ভেসে এবং তারপর বিলের মধ্যে পড়ে যাওয়া চরায় জন্মানো আগাছা কেটে কেটে আমরা যখন নতুন নতুন জায়গা আবিস্কারের নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুরতাম, সে সময় আমার মনে বারবার ডেভিড লিভিংস্টোনের কথা ফিরে ফিরে আসতো। পাড়াগেঁয়ে ওই শৈশবে তখন অন্ধকার মহাদেশের রহস্যভেদী মহাপুরুষটি যেন আলোকবর্তিকা হয়ে ধরা দিতেন।
২.
চীনা হাঁস, কানি বক, ডাহুক আর ঘুঘুর মতো কয়েকটা পরিচিত পাখি না চাইতেই আমার শৈশবকে ভীষণ জোরালোভাবে আন্দোলিত করতে পেরেছিল। অনেকটা যেন পনি-টেইল স্টাইলে চুল বেঁধে যে মেয়েটি সেবার বছরের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে আমাদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়েছিল, তার মতো করে।
ভর্তি হওয়ার পর থেকে সে ফি বছর প্রথম হতো। ক্লাসের ক্যাপ্টেন হতো। সকালের পিটি'র সময় হারমোনিয়ামে জাতীয় সঙ্গীত গাইতো। আমরা ওর কিন্নর কণ্ঠের সঙ্গে আমাদের ফেঁসে যাওয়া গলা মেলানোর চেষ্টা করতাম। "আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি-ইইইই।"
অথচ মেয়েটি ডেভিড লিভিংস্টোনকে চিনতো না। অ্যাডভেঞ্চারের কথা শুনলে বড় বড় চোখে অবাক বিস্ময় ফুটিয়ে তাকিয়ে থাকতো। সে কেবল তার পড়ার বই মুখস্ত করতে আর পরীক্ষার খাতায় সেসব পড়া গুছিয়ে লিখে দিয়ে আসতে জানতো। এমনকি ওর হাতের লেখাও খুব বেশি সুবিধের ছিল না।
ওর চেয়ে আমাদের অনিন্দ্যের পরীক্ষার খাতা ছিল অনেক ঝকঝকে, অনেক চেকনাই আর রোশনাইওয়ালা। তবে অনিন্দ্যের খাতায় সারবস্তু বিশেষ কিছু থাকতো না। আমাদের জিল্লুর স্যার বলতেন, পরীক্ষার খাতায় চ্যাং-ব্যাং কিছুতো রেখে আসবি, যাতে নম্বর দেয়া যায়। অনিন্দ্য সেই তত্ত্বও অনুসরণ করতে চাইতো না। ওর সব সময় চলে যেতো খাতার সৌন্দর্যবর্ধনের পেছনেই। মাঝখান থেকে পনি-টেইল বারবার আমাকে টপকে প্রথম হয়ে যেতো। অথচ ও আসার আগে ক্লাসের একচ্ছত্র আধিপত্য আমার হাতেই ছিল।
আমাদের বাসার অদূরেই ছিল মেয়েটির বাসা। সে সময় জেলা শহরে দায়রা জজদের একটা করে বাড়ি দেয়া হতো। আমাদের শহরের জজ সাহেবের বাড়িটি ছিল সুবিশাল এলাকা ঘিরে বানানো একটা রাজপ্রাসাদ। আমরা বিকেলে ওই বাড়ির দেয়াল টপকে ভেতরে গিয়ে ক্রিকেট খেলতাম। আমাদের খেলার জায়গাটা ছিল মূল বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে আর পেছনের দিকে। বাড়ির বাসিন্দারা কখনও সেখানে আসতো না। একদিন বিকেলে খেলতে খেলতে বল চলে যায় বাড়ির কাছাকাছি একটা জায়গায়। বলটা আনতে গিয়ে দেখি পনি-টেইল কয়েকজন সমবয়সীর সাথে ব্যাডমিন্টন খেলছে। সেদিনের আগ পর্যন্ত জানতাম না, পনি-টেইল জজ সাহেবেরই মেয়ে।
মাঝে মাঝে স্কুলে ওর সাথে আমার কথা হতো। ওকে আমি "অ্যাডভেঞ্চারের" কথা বলতাম। কিভাবে স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখা, পার্কে ঘোরা আর ভিডিও গেম খেলতে হয় তার দিকনির্দেশনামূলক বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করতাম। মেয়েটি বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, ফিক করে হেসে বলতো, যাহ্ আর গুল মারিস না।
আমি "গুরুবচনের" এহেন অবহেলা দেখে মাঝে মাঝে ক্ষেপে উঠতাম। একবার তো ওর হাতই টেনে ধরেছিলাম! ধরে বলেছিলাম, চল তাহলে আজই তোকে দেখাই কিভাবে অ্যাডভেঞ্চার করতে হয়।
মেয়েটি হাত ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য ততক্ষণে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। চোখে ভীত-সন্ত্রস্ত দৃষ্টি ফুটিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বার বার বলছে, ছেড়ে দে, ছেড়ে দে, কে না কে দেখে ফেলবে।
আমি অবশ্য কিছুটা অতিরিক্ত সময় ইচ্ছে করেই ওর হাতটা ধরে রেখেছিলাম। ছাড়ছিলাম না। আমার কথা বিশ্বাস করো না, হুম?
তবে যখন সে আতঙ্কের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে গিয়েছিল, তখন আমি হাতের বাঁধন আলগা করে দিয়েছিলাম। সাথে সাথে মেয়েটি দৌঁড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। যেতে যেতে কি কি যেন বলে আমায় শাপশাপান্তও করেছিল। আমি গায়ে মাখি নি একরত্তিও!
তারপর কয়েকদিন সে আমার সাথে খুব একটা কথা-টথা আর বলে নি। সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এমন ভাব করেছিল যে সে আমাকে জীবনেও কোনোদিন দেখে নি এবং চেনে না মোটেও।
সেভাবে কয়েকদিন চলার পর, আমিই একদিন ক্লাসের দরজার আড়াল থেকে ওকে ভয় দেখিয়ে পরিস্থিতি মোটামুটি স্বাভাবিক বানিয়েছিলাম। সেদিন ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
-কিরে ভাব নিচ্ছিস মনে হচ্ছে?
-নিবোই তো। তুই একটা অসভ্য!
-কেন?
-সেদিন হাত ধরে টানলি কেন?
-তুই আমার কথা বিশ্বাস করিস নি কেন?
-করবো না। তোর গুল-গাপ্পা আমি জীবনেও বিশ্বাস করবো না।
-তাহলে দাঁড়া তোকে আজ আবার মজা দেখাই।
মজা দেখানোর জন্য ওকে আবার হাত ধরে টান দেয়ার আগেই দেখলাম ছুটে চলে গেছে অন্যদিকে। আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে একটা ভেংচি দিয়ে কেটে পড়েছে। তাতে করে অবশ্য আমার কোনো ক্ষতি হয় নি। বরং সেই ঘটনার পর আমাদের বেশ গভীর একটা বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। সেই বন্ধুত্বের সোপানে চড়ে কখন যে দু'দুটো বছর কেটে গিয়েছে, আমরা টেরই পাই নি।
৩.
টের পেয়েছিলাম সেদিন, যেদিন সকালে স্কুলে এসে মেয়েটি তার বাবার বদলির খবর জানিয়েছিলো। আমার মনে হয়েছিলো প্রাণের গভীরে কেউ যেন একটা আঘাত করে বসলো!
অথচ প্রেম কিংবা ভালবাসা সম্পর্কে তখনও আমার বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। আমি খবরটা শুনে নিজের অন্তদর্হন নিজের ভেতর চেপে রেখে হাসিমুখে বললাম, ভালোই হলো, এখন থেকে আবার আমি প্রথম হবো।
ভেবেছিলাম মেয়েটি আমার কথা শুনে রেগে উঠবে বা ভেংচি কাটবে। কিছুই করলো না। হঠাৎ মাথা নিচু করে স্কুলের ব্যাগের মধ্যে গভীর মনোযোগ সহকারে কি যেন খুঁজতে লেগে গেলো। আমি আবার বললাম, আরও যেটা ভালো হলো সেটা হচ্ছে, এখন থেকে কেউ আমার সত্যিকারের অভিযানের গল্পগুলোকে "গুল-গাপ্পা" বলে উড়িয়ে দেবে না।
মেয়েটির ব্যাগের মধ্যে সেদিন কি যে হাতি-ঘোড়া হারিয়েছিল আমার মনে নেই। কেবল মনে আছে, ওর আর কোনোদিকে নজর নেই, সে কেবলি নিজের ব্যাগ হাতড়ে যাচ্ছে আর প্রাণপনে চেষ্টা করছে পুরো মাথাটাকেই ওই ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে। দেখতে দেখতে আমার নিজেরই খানিকটা রাগ উঠে গেলো। বললাম, এবং সবচেয়ে ভাল যেটা হলো সেটা হচ্ছে, এখন থেকে আমারও কারো জন্য খারাপ লাগবে না। কেউ একজন ক্লাসে না আসা পর্যন্ত বারবার দরজার দিকে তাকাতে হবে না, এবং কারো রাগ ভাঙানোর জন্য আর কখনোই আমাকে ক্লাসরুমের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হবে না।
এবার মেয়েটি মুখ তুললো এবং ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। আমি হঠাৎই বুঝে ফেললাম সে ব্যাগের ভেতর আসলে কিছুই খুঁজছিল না।
সেদিনও ক্লাসরুমের বাইরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিলো। বৃষ্টি আর বাতাসের তোড়ে স্কুলের সীমানা নির্দেশক নারিকেল গাছগুলো বারবার বেঁকে যাচ্ছিলো।
৪.
আমি শরীফকে ডেকে আরও এক কাপ চা দিয়ে যেতে বললাম। সে সাধারণত আমাকে সন্ধ্যায় পর পর দুই কাপ চা পান করতে দেখে না। দোকানে যাওয়ার সময়ও হয়ে গেছে। সেদিকেও আমার ভ্রুক্ষেপ নেই। দেখে-শুনে শরীফও কোন কথা না বলে চা বানাতে চলে গেল। আমার মনে হলো, সে যেন বুঝতে পেরেছে তার স্যারের আজ কিছু একটা হয়েছে। হয়তো মন খারাপ কিংবা কোনো পুরোনো কথা মনে পড়েছে।
শরীফটা বুদ্ধিমান ছেলে। কখনো বাড়তি প্রশ্ন করে না।
---
মন্তব্য করুন