জীবনটা আনন্দময়, তাই না?
সেদিন একটা আমলকি গাছের নিচে বসে ভাবছিলাম তোমার কথা! জীবনের যে সময়টায় গাছের নিচে, পার্কের বেঞ্চিতে কিংবা রিকশায় চড়ে তোমায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে আনন্দ করার কথা ছিল, সে সময়টায় কৈলাশ খেরের গান কানের হেডফোনে, আর অচেনা-অজানা-অগোছালো চিন্তাদেরকে মাথার নিউরণে নিউরণে নিয়ে; অলিতে-গলিতে ঘুরেছি আমি, আর সূর্য্য ঘুরেছে নিজের অক্ষ আর কক্ষপথের ওপর, আহ্নিক ও বার্ষিক গতিতে।
সেসব সময়েও- কোন কোন দিন, কদম ফোয়ারার পানি মুখে ছিটকে এসে ভিজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল লাল হৃৎপিণ্ডটাকেও। আকাশে জমে ওঠা মেঘেরা অন্ধকার করে এনেছিল চারিদিক। আমার রিকশা সেগুনবাগিচা হয়ে ধীরে ধীরে শিল্পকলা, সেবা প্রকাশনী, কাকরাইল, সিনেমা প্রযোজক সংস্থার অফিসভরা গলি এবং আরো যে কত কত জায়গা পেরিয়ে, ধীরে ধীরে ঢাকার কোন এক আঁধার গলিতে চলে গিয়েছিল, কে দেখেছে সেটা! রিকশা থেকে নামতে মহল্লার সিগারেট বিক্রেতা রাকিব দূর থেকে হাঁক দিয়েছে "ভাই, গত মাসের বাকি টাকাটা?"
শুনেও না শোনার ভান করে বাড়ির কেঁচি গেট খুলে ঢুকে গিয়েছিলাম। কিন্তু আধা ঘন্টা পরেই আবার বের হয়ে রাতের ধূম্রশলাকাগুলো ওর কাছে থেকেই বাকিতে নিয়েছিলাম। জীবন আমাদের কাছে যদি কিছু নেয় তো সমপরিমাণ ফিরিয়েও দেয়। বুক ভরা ধূম্রশলাকার ধোঁয়া- গলির মুখে দাঁড়িয়ে, অন্ধকারের পানে তাকিয়ে, উড়িয়ে দেয়ার ভেতরে ছিল- নিষিদ্ধ আনন্দ উপভোগের আনন্দ। মনে হতো এভাবে কোনদিন যদি দু'টো চোখের আলোও মহল্লার গলিটার মতো আধাঁর হয়ে যেতো!
কিন্তু সেসব চিন্তা, সেখানেই রয়ে গেল যেখানে তাদের বসবাস। ধূম্রশলাকায় দেয়া শেষ টানটায় চোখ খুলে যাওয়ার পর দেখি রাকিবের দোকান বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে। দূরের চায়ের কাপ থেকে টুংটাং আওয়াজ ভেসে আসছিল। তুমি কড়া-পাতির-চিনি-ছাড়া-দুধ-চা খেতে ভালবাসতে। দূরের চায়ের কাপ থেকে ভেসে আসা টুংটাং আওয়াজ শুনে মস্তিষ্কের কোন এক 'অশরীরী' তোমার সম্পর্কে সেই তথ্যটি মনে করিয়ে দিতেই যেন উঠে এসেছিলো।
তারপর ধীরে খুব ধীরে, যখন পূর্বাকাশে সামান্য রক্তিম ছটা দেখা দিতে শুরু করলো তখন বাসার দিকে পা বাড়িয়েছিলাম। মাঝখানে তিন কিংবা চার ঘন্টা, তোমার প্রিয় চায়ের কথা মনে পড়ে যাবার পর, ঘোরের মধ্যে শহরের অলিতে আর গলিতে হেঁটে বেড়িয়েছিলাম। দিনের বেলা রিকশায় করে কদম ফোয়ারা থেকে আমার গোরস্থানের পাশের বাড়িটায় আসা হয়েছিল। রাতের বেলা সেই গোরস্থান থেকে কদম ফোয়ারা পর্যন্ত হেঁটেই ঘুরে এসেছিলাম।
অবশেষে নিজের আড়াই বাই সাড়ে তিন বর্গমিটারের খুপরিতে পৌঁছে প্রথমেই কলপাড়ে গিয়ে খোঁজ নিয়েছিলাম, পানি আছে কিনা। ছিল না। প্রতিদিন বিকালের দিকে বোধহয় একটু সময়ের জন্য পানি এসে, তারপর হারিয়ে যেতো। আমি বুঝতাম না, পানি কিভাবে কল থেকে হারিয়ে যায়? পৃথিবীর জলাধারগুলো কি প্রতিদিন শুকিয়ে যায়? আমার যে দু'টো জলাধার শুকিয়ে গেছে অনেক আগে- সেই জলাধার দু'টোর মতো?
এককালে জলাধার দু'টো দিয়ে প্রায় অকারণেই পানি বেরিয়ে আসতো। কোনকিছু দেখে একটু ভাল লাগলেই দু'টো জলাধার পানিতে ভরে উঠে টলটল করতো। সামান্য খুশিতে বান ডেকে যেতো সেসব জলের আধারে। আজকাল কিছুতেই কিছু হয় না। কদম ফোয়ারাটাও তো ঢেকে গেছে কতকিছুর আড়ালে। শহরের ওপর থেকে আকাশটাই হারিয়ে গেছে এক নিমিষে। মানুষের ভেতর থেকে হারিয়ে গেছে মানুষ। ছোট্ট এক সলতে আগুনের সান্নিধ্য তাদের ফাঁপা ফানুসে রূপান্তরিত করেছিল বলে রক্ষে। উড়ে উড়ে মানবজগত থেকে হারিয়ে যাওয়ার বেলায় খারাপ লাগার কষ্টটা অন্তত টের পায় নি মনুষ্যত্ব।
আর আমরা? মনুষ্যত্ব যেবার আমাদের সবার মাঝ থেকে বিদায় নিয়ে নিলো, তারপর সবাই ঝাড়া হাত-পা হয়ে গেলাম। নিজের মনের ভেতর সকলেই নিজের একটা করে মন্দির বানিয়ে পূজাপাঠ চালু করে দিলাম। শুধুই নিজের কথা, নিজের ইচ্ছা আর নিজের স্বার্থ। এমনকি কেউ মানতে না চাইলে, নিজের মনের ভেতর নিজের নামে মন্দির গড়তে না চাইলে, তাকে মালাউন, কাফির, ফেরাউন আরো নানাবিধ বিশেষণ, যেসব মূলত দলছুটদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়; সেসবে বিশেষায়িত করা হতো। আর এভাবেই গড়ে উঠলো এক উত্তরাধুনিক প্রপঞ্চ, যাকে 'সমাজ' বলে আখ্যায়িত করা হলো।
সেই সমাজে নিজের যোগ্যতার কোন মূল্য নেই। থাকতে হতো জন্মদাতার অবৈধ সম্পত্তি। আর সততা অর্থ ছিল ভন্ডামী। কিন্তু সেই ভন্ডামীকে স্বীকার করা ছিল সকলের জন্য নিষিদ্ধ। সেই সমাজে সবাই সৎ, কিন্তু শুধু একলা সৎ। একজনের সমাজে আরেকটা সৎ মানুষ নেই। সেই সমাজে সবাই বিজ্ঞ, কিন্তু শুধু নিজেই বিজ্ঞ। সেই সমাজে সবাই সচেতন, কিন্তু শুধু নিজের ব্যাপারে। সেই সমাজে ভালোর বিনিময়ে ভালো আশা করা অপরাধ। সেই সমাজে ভালবাসাকে কিংবা ভালো কোন কাজ করাকে নিজে দায়িত্বে করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হতো। যাকে ভালবাসা হয় কিংবা যার জন্য ভাল কাজ করা হয়, তার কাছে আগে বন্ড সই দিয়ে আসতে হয়, এই ভালবাসা স্বেচ্ছায় এবং করণ কারকে বিলিয়ে দেয়া হলো। গ্রহণকারীর কোন দায় নেই। নাহলে ভালবাসার দায়ে শূলে চড়ানো হতো জলজ্যান্ত মানুষকে। মনুষ্যত্ববিহীন সে সমাজেও দু'য়েকটা মানুষ রয়ে গিয়েছিল। আর তাদেরকেই শূলে চড়ার দুর্ভাগ্য পোহাতে হয়েছিল।
সেই ভুল সময়ে, ভুল সমাজে তোমায় একবার পেয়েছিলাম। আজীবনের আরাধনালব্ধ পুরস্কার হাতে পেয়ে বুঝেছিলাম, কিচ্ছু চাই নি আমি। এমনকি ভালবাসাও না। এই ভুল সময়, এই ভুল সমাজ থেকে মুছে যেতে চেয়েছিলাম শুধু সবার অগোচরে।
কিন্তু হায়! আজকাল আমার চোখ দু'টোর মতো পৃথিবীর নদী-সাগরগুলোও হারিয়ে ফেলেছে জল। নিশ্চিন্তে সলিল সমাধি বোধহয় ওসামা বিন লাদেনের পর খুব বেশি হয় নি কারো আর। আজকাল তাই কদমফোয়ারা, শিল্পকলা একাডেমি কিংবা সেবা প্রকাশনী দেখতে যাওয়া হয় না আর। রাকিবের দোকান থেকে ধূম্রশলাকা আর মহল্লার গলি থেকে অন্ধকার কুড়িয়ে নিয়ে ফিরে যাই নিজের আড়াই বাই সাড়ে তিন বর্গমিটারের কুঠুরিটায়।
পোষা গেকোটাকে বলি, জীবনটা আনন্দময়, তাই না?
সে দেয়ালের কোনা থেকে ঝুলতে ঝুলতে উত্তর দেয়, ঠিক ঠিক ঠিক ঠিক ঠিক!
---
মন্তব্য করুন