যাপিত দহনের গল্প - ৩
“বহুদিন ছিলো আগুনখেলার দিন
বহুদিন ছিলো জলোৎসবের তোড়
বহুদিন ছিলো পথে পথে উড্ডীন
বহুদিন কত রাত হয়ে গেল ভোর।
শূন্যতা এসে শূন্যতে ছিলো মিশে
একাকার সেই পূর্ণতা থেকে কত
বহুদিনকার দিনানুদিনের বিষে
অকাতর ঐ মুখ ছিলো উদ্গত।
সে মুখের কোন সীমানা ছিলো না যেন
এ-কালে ও-কালে ছড়ানো হাজার সাজে
মূর্ছিত হয়ে পড়ে ছিলো সব জ্ঞানও
আধোরাত্রির দূরাগত পাখোয়াজে।
অশরীরী যত নাচের বিভঙ্গেরা
জ্ঞানহীন সেই শরীরে উঠেছে মেতে
ঐ মুখ ছিলো আমার দুহাতে ঘেরা
মগ্ন শিশির নগ্ন ফসলক্ষেতে।
ছন্দ আমার বুকের বাঁপাশে এসে
তুলে আনে আজ সেই রাত্রির ভার
ও যদি ঘুমোয় ঘুমোক না অক্লেশে
ভালোবাসি ছাড়া কী-বা ছিলো বলবার।"
অনেকর মতে কল্লোল-উত্তর যুগের শেষ কবি ছিলেন শঙ্খ ঘোষ। তাঁর "পাখোয়াজ" কবিতা এটা। আজ ফেসবুকের পুরোনো লেখা ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম। এক সময় কবিতার কি যে ভক্ত ছিলাম! সে হয়তো আজ থেকে বড়জোর বছর সাত বা আটেক আগের কথা হবে।
অল্প সময়ের ভেতর জীবন এত বেশি বাঁকে বদল নিলো যে, এখন সেই আগের আমায় দেখলে কেমন যেন অচেনা লাগে। আজকাল কর্পোরেটও হয়ে পড়েছি ভীষণ। নয়টা-পাঁচটা কেন্দ্রিক চিন্তা ছেড়ে যে কিছু ভাববো তাও করা হয় না। ঘাসের ডগায় জমে থাকা বছরের প্রথম শিশিরবিন্দুতে ঠিকরে পড়া দিনের প্রথম সূর্যকিরণ পথের পাশেই পড়ে রয়। আমি সাইকেল চালিয়ে অফিস পানে এগিয়ে যাই। একটু থেমে একটা ছবিও তোলা হয় না বেশিরভাগ দিন।
অথচ আমি জানি এক সময় অমন অবস্থায় অফিস যাওয়া বাদ দিয়ে সেই ঘাসের জমিতেই গড়াগড়ি দিয়ে কাটিয়ে দিতাম সারাদিন। জীবন কত সহজে রং বদলায়! যখন বদলায় তখন আমরা বুঝতে পারি না। বুঝতে পারি শুধু কষ্ট পেলে। আর একবার রংয়ের বদল হয়ে গেলে দেখা যায়- অনেক কিছুই আর আগের মতো নেই।
মানুষের জীবন নিয়ে আমার গভীর ভাবনাগুলো এক জায়গায় লিপিবদ্ধ করে রাখার ইচ্ছাতেই মূলত যাপিত দহনের গল্প সিরিজটির জন্ম। জীবন নিয়ে উপলব্ধি আমাদের সবার হয়। ঘুরেফিরে হয়। বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে উপলব্ধিরা পাল্টায়। আমরা পরিপক্বতা অর্জন করি। এই যেমন, আমি নিজে এক সময় ভাবতাম নয়টা-পাঁচটার জীবন আসলে পরাজিতের জীবন। সে জীবনে সৃষ্টিসুখের কোনো উল্লাস নেই। বাঁধনছেড়া আনন্দে ভেসে যাওয়ার কোনো উপলক্ষ নেই। অথচ আজ যখন অনেকগুলো লড়াই করে নিজের জন্য নয়টা-পাঁচটার একটা জীবন নিজেই গড়ে তুলেছি, তখন কিন্তু আমার খুব একটা খারাপ লাগে না।
তখন নয়টা-পাঁচটার বিপক্ষে যেমন ওকালতি করতাম, এখনও তেমনি করি, কিন্তু পক্ষে ওকালতি করি। কোন বেলাতেই এটাকে ভুল মনে হয় নি। তখনও না। এখনও হয় না। তবে এখন আগের বেলারটিকে ভুল মনে হয়। সুখ বা শান্তি যে আসলে যেকোন অবস্থাতেই মানুষের হাতে ধরা দিতে পারে এবং হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে- সেটাকেই এই দ্বন্দের মধ্য দিয়ে পাওয়া শিক্ষা বলে মনে হয়। আর মনে হয়, হয়তো এ শিক্ষাও কোনদিন পাল্টে যাবে।
আসলে আমাদের জীবনটা একটা অসামান্য সুন্দর বস্তু, তাই না? প্রচণ্ড অনিশ্চিত। আবার প্রচণ্ড মাদকতাময়ও। খুব কম মানুষই এ জীবন স্বেচ্ছায় হাতছাড়া হতে দেয়। যদিও পৃথিবীর কারো জীবনই অনন্ত কষ্ট বা অনন্ত সুখের হয় না- তারপরও।
অথচ আইরনিটা হচ্ছে, জীবনের সমাপ্তি। চাই আর না চাই, সমাপ্তি একদিন এসে দাঁড়াবেই সামনে। নিজেকে নিয়ে এত এত স্বপ্ন, চিন্তা, পরিকল্পনা, কাজ করা- সবকিছু এক মুহূর্তে অর্থহীন হয়ে যাবে। শঙ্খ ঘোষের মতো শিশিরভেজা কোন নগ্ন ফসলের ক্ষেতে জীবনের কোন হারিয়ে যাওয়া ভোরে দুই হাতে তুলে ধরা কারো নতমুখকে মনে হতে পারে, আহা আর একবার যদি ঘুরে আসা যেতো সেই সময়টা থেকে।
তবে আমার মনে হয়, মানুষ শুধু তার নিজের জন্য বাঁচে না। খানিকটা হয়তো অন্যদের জন্যও বাঁচে। নাহলে এমন মহাশূন্যতা, যার আদি কিংবা অন্ত কিছুই নেই- তার পানে প্রতিনিয়ত ছুটে চলা এ জীবনের যাত্রাপথ আমাদের 'এত' প্রিয় কেন?
---
মন্তব্য করুন