ঠিক কথা না ভুল কথা
১.
জিরুর মার সাথে ভোলুর বাবার বহুদিন ধরে ঝগড়া। নানান কারণে নানানভাবে সে ঝগড়ার জঙ্গল গড়ে উঠেছে। প্রথম প্রথম হয়তো ছিল একটা-দু'টো আগাছার ঝাড়, সেসবে রোদ-পানি কিচ্ছু ঠিক-ঠিকমতো পড়ে নি। শুধু অন্ধকারে চাপা দিয়ে দিয়ে রেখে যাওয়া হয়েছিল। সেসবই কালে কালে ভোলুর বাবার মনে যেমন, জিরুর মার মনেও তেমনি ডালপালা ছড়িয়ে জঙ্গল গড়েছিল। সেই সব নিয়েই তাদের দুজনের ঝগড়া। ভেতরের কথা কি- তা বাইরের মানুষ কি করে জানবে, কিন্তু উড়ো উড়ো সংবাদ বলতে পাওয়া গিয়েছিল এতটুকুই।
কিন্তু তারপরও যেন কিভাবে কিভাবে অনেকগুলো বছর তারা একসাথে কাটিয়ে দিয়েছিল ব্ল্যাক ফরেস্ট অঞ্চলের ছোট্ট একটা রাশিয়ান মহল্লার সেই ছয়তলা অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচতলা বাসাটায়। জিরু, ভোলুদের জন্ম হয়েছিল ওই বাসাটায়। অ্যাপার্টমেন্টের সবার সাথে পার্টির উপলক্ষ আমাদের জীবনে কমই আসে কিনা। তাই মনে আছে আরকি। তাদের দুজনকে দেখতাম প্রায়ই খুনসুটি করতো। শপিং মলে কেনাকাটা করতে গেলে- সারাক্ষণ লেগে থাকতো দুইটি একসাথে, যেন চড়াইয়ের জোড়া একটা।
সেবার যে কি হলো! দুজনকে আর একসাথে দেখা গেল না তারপর থেকে কোনদিন। ভোলুর বাবা থাকতো শুধু ওই অ্যাপার্টমেন্টটায়। জিরুর মা আর থাকতো না। দু'টি চড়াইকে ওইভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে দেখে নিজের কথা মনে পড়ে যাওয়াটা খুব ক্লিশে আমার জন্য, তাই সেটা হলো না। শুধু আকাশপানে তাকিয়ে একবার আনমনে প্রশ্ন করেছিলাম, আহা চড়াই। তুই আজও একবার পারলি না?
২.
পাহাড়ে একবার হালকা পেট খারাপ হওয়ার কারণে খোলা জায়গায় রেচন করা শেষে কলাপাতা দিয়ে পরিস্কার হতে হয়েছিল। ওসব শুধু পাহাড়েই সম্ভব। তখন আমি পুরোদস্তুর ট্রেকিং করার মোডে। গুগলে সবকিছুর খোঁজ এত বেশি চলছে যে, বেয়ার গ্রিলস্ নাকি সাপ খাওয়ার জন্য অনুতপ্ত- এমন ভিডিও আমার ফেসবুক-ফীডে স্বত:প্রণোদিত হয়ে আসছে। তাই টুকটাক পেট খারাপকে গ্রাহ্যই করলাম না। শিকারীরা হাতির ফাঁদ যেসব পথে পাতে তার সন্ধানে পা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। চারপাশে ঘন সবুজ পাহাড়। পায়ের নিচে কোন মাটি নেই। হয় পাথর নয় নূড়িপাথর। তারা সব শত শত সহস্রাব্দ ধরে পাহাড়ের মাটি থেকে বেরিয়েছে। বেরিয়ে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এক ঝিরঝিরে স্বচ্ছ জলের ধারার পথ গড়েছে।
গভীর জঙ্গলের ভেতর নিশ্ছিদ্র নৈ:শব্দের এক আলাদা জগত সেটি। মাঝে মাঝে পাহাড় থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় চুইয়ে পড়া পানি সে নিস্তব্ধতায় মহাকালের সুনিপুণ, পদ্ম-হাতে বাজানো মন্দিরার সুর মেশায়। টুং টাং, টুং টাং, টুং টাং, টুং।
এক মুহূর্ত, শুধু একটা পরিপূর্ণ মুহূর্ত ঠাহর করে সে সুর অনুধাবনের দেরি। মনের পেয়ালার সব জঞ্জাল ধুয়ে-মুছে যাওয়ার দেরি নেই।
সেই হালকা পেট খারাপ হওয়া সময়টায়, যদি খবরটা দেয়ার জন্যও একবার জেদ ভেঙ্গে ফোন করতাম! কিংবা আশপাশের দমবন্ধ করা সৌন্দর্যটা একবার দেখানোর জন্য, তাহলে হয়তো আমার এত অল্প সময়ের মধ্যে দুই-দুইটা চড়াইয়ের জোড়াছাড়ানি দেখতে হইতো না। একটা দেখলেও কাম চলতো। আবার সেও যদি কোন কারণে একটাবার ফোন করতো তাহলেও হয়তো হইতো।
৩.
পৃথিবীটা থেকে ভালবাসা বস্তুটা আস্তে আস্তে হারায়ে যাইতেছে, তাই না? রাগ, জেদ, অমিল- এইসবই সব। জীবনের শুরু থেকে ২০-২২ বছর পর্যন্ত, মানুষ যতদিন অবুঝ থাকে শুধু ততদিন; তারপর একবার বুঝতে শুনতে শিখে গেলে, মানুষের মনে ভালবাসা বস্তুটার আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না।
মন্তব্য করুন