দিনলিপিতে দু'হাজার বাইশ - ৫
বাসায় ঢুকে ব্যাকপ্যাক নামায় রেখে সরাসরি যে বিছানায় চলে যাই, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। সাধারণত প্রথমে রান্নাঘরে ঢুকে চারপাশটায় একবার চোখ বুলানো হয়। কেন যে কাজটা করা হয় জানি না। যেন ঘরে ঢুকে রান্নাঘরে একবার চোখ বুলিয়ে আমি মস্তিষ্ককে আশ্বস্ত করলাম ঘরে ঢুকেছি।
কাপড় ইত্যাদি পাল্টে তারপর শোবার জায়গাটায় আসি। বিছানাপাতি এখনও পুরোদমে ব্যাবহার করা শুরু করি নি। সামনে সপ্তাহে আলমারি আসবে। যেটা আবার নিজেকে সেট করতে হবে। পার্ট বাই পার্ট। এসব কাজে আমার দক্ষতা চিরকালই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে উদ্যম খুঁজে পেলে ঝাপিয়ে পড়তে পারি তেমন কোন সমস্যা ছাড়াই। তবে সমস্যাটা আসলে উদ্যম খুঁজে পাওয়াই। সে ব্যাটার খোঁজ ত্রিভুবনে যারা দিতে পারে তাদের খোঁজ পাওয়াটাই ভীষন দায়।
একটা নতুন অনুষঙ্গ জুড়েছে জীবনে। পাতালরেল। জাপানি বা কোরিয়ান সিনেমার মতো পুরা খালি পাতালরেলে একা একা গভীররাতে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর। যার বেশিরভাগটাই প্রোপাগান্ডা তথা ফ্যান্টাসি যদিও, তারপরও পরিবেশ থাকলে রোমাঞ্চিত হওয়াটা উপভোগ্য বলেই হয়তো, মাঝে মাঝে গভীররাতে পাতালরেলে ভ্রমণে যাই।
আমার যে মাসকাবারি টিকেটটা রয়েছে তা দিয়ে শহরের বাইরে যাওয়া যায় না অবশ্য। তাই আমি শহরের ভেতর চক্রাকারে যে রেলগুলো ঘোরে, সেগুলোর যেকোন একটা উঠে বসি। একেক স্টেশনে একেক রকম দৃশ্য। কোথাও শুনশান নিরিবিলি, একটাও মানুষ নেই। তারপরও বিকট আওয়াজ তুলে ট্রেনটা ব্রেক করলো। দরজা খুললো। কেউ নামার থাকলে নামলো। দরজা বন্ধ হলো। আবার চলাচল শুরু হলো। আবার কখনও দেখা যায় ভীষণ ব্যস্ত স্টেশন। সাধারণত শহরের বিখ্যাত স্টেশনগুলোতে যেমন হয় আরকি। একদল মানুষ ট্রেনে ওঠার জন্য দরজার একপাশে আগে থেকেই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায়। আরেকদল মানুষ অন্যপাশ দিয়ে নেমে গেলেই তারা উঠে পড়ে। ট্রেনটা কিছুক্ষণ নিরাপত্তার বাঁশি বাজিয়ে তারপর দরজার বন্ধ করে পরের গন্তব্যের পানে ছুট লাগায়।
আমার কাছে অবশ্য হৈ-হুল্লোড়ের চেয়ে নিরিবিলি স্টেশনই ভাল লাগে। ভাল লাগে নিরিবিলি বগিতে বসে জানালার বাইরের অন্ধকারের দিকে ঠায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছুটে চলা। সেদিন রাস্তাফারি মুভমেন্টের নিকোলকে দেখলাম একলা একা পুরো এক বগিতে বসে বসে কোথায় যেন যাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম স্টেশনে পছন্দসই একটা ট্রেনের আশায়, যাতে করে সে রাতের অভিযানটি আমি সারবো।
ট্রেনের বাইরে থেকেই নিকোলকে আমি স্পট করি। ও আমাকে দেখে নি। আমি বগিতে উঠি ওর সামনে দিয়েই। তখনও গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিল হাতের স্মার্টফোনটির দিকে। আমি পাশে গিয়ে জানতে চাইলাম, তোমার পাশে কি ফাঁকা আছে?
আনমনেই ফোন থেকে চোখ না সরিয়ে সায় দিয়েছিল সে। আমি বসে পড়েছিলাম ওর পাশে টুপ করে। না চাইতেও চোখ চলে গেল ফোনের দিকে। ক্ষুদেবার্তা পড়ছিল সে ফোনের স্ক্রিনে। যার কাছ থেকে এসেছে তার নামের আগে ও পরে অনেকগুলো লাল হৃদয়ের ইমোজি। একটা থেকে আবার একবিন্দু ভালবাসা চুইয়েও পড়ছে। নিকোল দেখে ফেলবে আমি ওর ফোনের দিকে তাকাচ্ছি ভেবে যেই না চোখ সরাতে যাবো, ওমনি দেখি কি সে আমার দিকে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রয়েছে! বিশ্বাস করতে পারছিল না বোধহয়, জীবনে এমনও হয়!
আমরা একসাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। ইলমিনাউয়ে থাকার সময়। তখন মেয়েটা আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন বন্ধু ছিল। একজন আরেকজনের ফোনের ওপর ঝুঁকে থাকা তো কোন ব্যাপারই ছিল না তখন। বরং বন্ধুর সঠিক খোঁজখবর রাখার অংশ হিসেবে মনে করা হতো কাজটাকে। তবে ওর সঙ্গে আমার অদ্ভুত অনন্দময় কিছু সময় কেটেছিল পাহাড় বেয়ে বেয়ে।
ইলমিনাউ শহরটাই ছিল চারপাশ থেকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা জনপদ। তাই পাহাড়ের অভাব সেখানে কোনকালেই ছিল না। বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক গোয়েথের জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ কেটেছিল ওখানে। সমস্যাটা ছিল একটাই। সঠিক সঙ্গী পাওয়া। সেদিক থেকে নিকোল ছিল পারফেক্ট একদম। পাহাড় বাওয়ার সঙ্গী পাওয়ার ক্ষেত্রে আমার ভাগ্য আবার দারুণ ভাল! নিকোল ছাড়াও জিয়াদ, হ্লা মং সবাই দারুন পাহাড় বাওয়ার সঙ্গী। এদের সঙ্গেই জীবনে যে কয়বার পাহাড়, টিলা ইত্যাদি সত্যি সত্যি ডিঙানো হয়েছে ডিঙিয়েছি আমি। এছাড়া আর কয়েকবার দলবদ্ধ ভ্রমণে।
নিকোলও ততক্ষণে বুঝে গেছে, আসলেই ঘটনাটা ঘটেছে। আমরা দুই জন একদম ভাগ্যক্রমে চলার পথে একদিন খুঁজে পেয়েছি একজন আরেকজনকে। সেই রাতেই নিকোল আমার শহরে এসে নেমেছে। সে যাচ্ছিল তার এক বান্ধবীর বাড়িতে। দুই সপ্তাহ দুই বান্ধবী একসঙ্গে থাকবে। ঘুরবে ফিরবে। এই ছিল আশা।
আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অবশ্য আমরা দুইজনই সেই রাতে আর বাড়ি ফিরি নি। সকাল পর্যন্ত এক সঙ্গে শহরের পথে পথে হেঁটেছি। ডেলিভারির দোকান থেকে গভীর রাত গরম ধোঁয়া ওঠা পিজ্জা খেয়েছি। অটোমেটিক মেশিন থেকে বের করেছিলাম ড্রিংকস্। আর গল্প করেছিলাম দুজন দুজনের সঙ্গে সারারাত।
চুটিয়ে প্রেম করছে মেয়েটা একটা ফরাসি ছেলের সঙ্গে। আর জীবনটাকে সহজ স্বাভাবিকের চেয়ে একটুও বেশি কোনকিছু ভাবছে না কখনোই। যা আসছে হাসিমুখে গ্রহণ করছে। যা আসছে না তা নিয়ে কোন আক্ষেপ করছে না। নিকোলের কথা শুনতে শুনতে আমিও প্রায় বিভোর হয়ে পড়ছিলাম। আসলেই জীবনটা কি ওরকম সহজ?
তাহলে যে চারপাশটা সব অসুখী মানুষদের দিয়ে ভরা, তাদের অসুখের কারণ কি? নিকোল বললো, তাদের কাছে জীবনটা অমন সহজ না। জীবনটা তাদের সামনে জটিল করে সাজিয়ে রাখা। এ সাজানোটা যে কে সাজিয়েছে কেউ জানে না। কিন্তু এই জটিলতাকেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি কিছু মনে না করার ক্ষমতা মানুষের নিয়ন্ত্রণে। যারা সেই মনে করাটা নিয়ন্ত্রণ করতে চায় না, তাদের কাছে জীবনটা অমন সহজ না।
রাতের অভিযানগুলো কেন যে শুধু কল্পনাতেই করা হয় আমার, বাস্তবে কখনো করা হয় না!
---
হাসিমুখে পড়তে পরতেই দেখি শেষ লাইন...
মন্তব্য করুন